ইউক্রেন সংকট নিয়ে টান টান উত্তেজনা ও যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান প্রদর্শন করল চীন ও রাশিয়া। ঐক্য প্রদর্শনের নজির হিসেবে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আজ শুক্রবার বেইজিংয়ে মুখোমুখি বৈঠক করেছেন। খবর আল-জাজিরার
বেইজিং সফরে গিয়ে পুতিন সির কাছে তাঁর দেশের সঙ্গে রাশিয়ার ‘নজিরবিহীন’ সম্পর্কের প্রশংসা করেছেন। এই সফর ও প্রশংসা তিনি এমন এক সময় করলেন, যখন ইউক্রেনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে রাশিয়ার উত্তেজনা বেড়েই চলেছে।
এক যৌথ বিবৃতিতে দুই নেতা একে অপরের দেশের পররাষ্ট্রনীতির প্রতি নিজেদের সমর্থনের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। এর মধ্যে তাইওয়ান নিয়ে চীনের অবস্থানকে রাশিয়ার সমর্থন ও ব্যাপক পরিসরে দুই দেশের নিরাপত্তাসংক্রান্ত ইস্যুগুলোতে পরস্পরের সমর্থন জানানোর বিষয় রয়েছে। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সমন্বয়ে গড়া প্রতিরক্ষা জোট এইউকেইউএস নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন উভয় নেতা।
বিবৃতিতে দুই নেতাই ইউরোপ ও এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নেতিবাচক প্রভাবের সমালোচনায় যুক্ত হয়েছেন। তাঁরা পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর আরও সম্প্রসারণের উদ্যোগও প্রত্যাখ্যান করেছেন।
ইউক্রেন সংকটকে ঘিরে ন্যাটো জোটের দেশগুলোর সঙ্গে বিরোধে রাশিয়াকে জোরালোভাবে সমর্থন করছে চীন। তবে আল-জাজিরার সংবাদদাতা ক্যাটরিনা ইউ বলেছেন, এর অর্থ এ নয় যে, ইউক্রেনে সম্ভাব্য যেকোনো আক্রমণে চীন রাশিয়াকে স্বাগত জানাবে। কারণ হিসেবে তিনি কিয়েভের সঙ্গে বেইজিং সরকারের সুসম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন। ইউক্রেন চীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার ও দেশটির বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের পক্ষ।
ঠিক এই মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট সি তাঁর দেশে শীতকালীন অলিম্পিক সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ার দিকে তাকিয়ে আছেন। স্বাভাবিকভাবে কোনো ইস্যু এই আন্তর্জাতিক আসরকে বিঘ্নিত করুক, সেটি চান না তিনি। তারপরও সি-পুতিনের বৈঠকে শীর্ষ আলোচ্য বিষয় ছিল ইউক্রেন সংকট।
ক্যাটরিনা ইউ বলেন, প্রকৃতপক্ষে দুই নেতাই (পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে) এক ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণের চেষ্টা চালাচ্ছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান তিক্ত সম্পর্কের অভিজ্ঞতা রয়েছে দুজনেরই। তিনি আরও বলেন, চীন ইঙ্গিত দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, সে ক্ষেত্রে মস্কোকে অর্থনৈতিকভাবে সমর্থন জোগাবে তারা।
রাশিয়া তার ইউক্রেন সীমান্তের কাছে ১ লাখ সেনা মোতায়েন করেছে। এ পদক্ষেপের পক্ষে মিত্রদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে দেশটি। পশ্চিমা দেশগুলোও ইউক্রেনে আগ্রাসন না চালাতে রাশিয়াকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে। একই সঙ্গে ইউক্রেনে হামলা হলে রাশিয়াকে কঠিন পরিণতির সম্মুখীন করার হুমকি দিয়েছে তারা।
গত সপ্তাহে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই রাশিয়ার নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগকে যৌক্তিক বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, ‘এ উদ্বেগকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।’ গতকাল সি ও পুতিনের মধ্যে বৈঠক হওয়ার আগে গতকাল বৃহস্পতিবার ওয়াং রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে মুখোমুখি আলোচনা করেন।
ইউক্রেন সংকট ছাড়াও সি ও পুতিন বাণিজ্য বিষয়ে কথা বলেছেন। পুতিন বলেন, চীনে গ্যাস রপ্তানি বাড়াতে তাঁর দেশ নতুন চুক্তি করতে প্রস্তুত। দুই পরাশক্তির মধ্যে বাণিজ্যও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়াতে চান তিনি।
এদিকে প্রায় দুই বছরের মধ্যে সি চিন পিং এই প্রথম কোনো বিশ্বনেতার সঙ্গে সরাসরি বৈঠক করলেন। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে চীনে করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ওই সময়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত তিনি দেশের বাইরে যাননি।
ইউক্রেনে হামলার জন্য মিথ্যা অজুহাত দাঁড় করানোর ফন্দি আঁটছে রাশিয়া
বিবিসি জানায়, যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে, রাশিয়া একটা ভুয়া ইউক্রেনীয় হামলা সাজানোর পরিকল্পনা করছে; যাতে মস্কো এটিকে ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর একটা অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাতে পারে।
ওয়াশিংটনের অভিযোগ, মস্কো একটি গ্রাফিক ভিডিও প্রদর্শন করতে পারে; যেখানে দেখা যাবে, রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডে বা ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে রুশ ভাষাভাষী লোকজনের ওপর আক্রমণ চালানো হচ্ছে।
তবে ভুয়া হামলার এমন ফন্দি আঁটার অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে রাশিয়া। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রও তার দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ পেশ করেনি।
প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী এলাকায় রাশিয়া বিপুলসংখ্যক সেনা ও সমরাস্ত্র মোতায়েন করায় পশ্চিমাদের মধ্যে এ আশঙ্কা জন্মেছে যে, ইউক্রেনে যেকোনো মুহূর্তে হামলা চালাতে পারে দেশটি। অবশ্য রাশিয়া বলছে, তারা সেখানে সামরিক মহড়ার জন্য সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছে।
বৃহস্পতিবার পেন্টাগনের মুখপাত্র জন কিরবি সাংবাদিকদের বলেন, ‘সম্ভবত রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর একটা ভুয়া প্রেক্ষাপট তৈরি করছে—এ বিষয়ে আমাদের কাছে তথ্য আছে।’