রাশিয়ার হামলা ঠেকাতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেন। যুদ্ধের শুরুতে রুশ সেনাদের প্রতিহত করার ক্ষেত্রে সাফল্য দেখিয়েছেন ইউক্রেনের সেনারা। কিন্তু এখন ধীরে ধীরে কিছু এলাকায় রুশ সেনাদের আগ্রাসনের মুখে পিছু হটতে হচ্ছে তাঁদের। পরবর্তী সময়ে কী হতে চলেছে? ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
রুশ সেনারা ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ দখলের চেষ্টা করেছিলেন শুরুতেই। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরু করে রাশিয়া। কিন্তু শুরুর দিকের সেই লড়াইয়ে রুশ সেনাদের চমকে দিয়েছিলেন ইউক্রেনের সেনারা। রুশ সেনারা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েন। একপর্যায়ে কিয়েভ দখলের লক্ষ্য থেকে সরে আসে রাশিয়া। পরে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের দনবাস দখলের লক্ষ্য নির্ধারণ করেন রুশ সেনারা। সংক্ষিপ্ত সময়ের পরিবর্তে যুদ্ধ রূপ নেয় দীর্ঘ মেয়াদে। এ যুদ্ধে অসংখ্য যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহৃত হবে। প্রাণ যাবে অনেক মানুষের। এক পক্ষ পরাজয় না মানা পর্যন্ত নষ্ট হবে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। তবে এখন পর্যন্ত লড়াইয়ে রাশিয়ার দিকেই পাল্লা ভারী।
সম্প্রতি রুশ সেনারা ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের সেভেরোদোনেৎস্কের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দাবি করেছেন। লিসিচানস্ক শহরও রুশ সেনাদের কবজায়। লুহানস্ক অঞ্চলকেও স্বাধীন বলে ঘোষণা দিয়েছে মস্কো। এখন দোনেৎস্কের উত্তরের স্লোভিয়ানস্ক দখল নিতে আক্রমণ জোরদার করেছেন রুশ সেনারা। ইউক্রেনের নেতারা বলছেন, তাঁদের গোলাবারুদের স্বল্পতা রয়েছে। প্রতিদিন ২০০ সেনা নিহত হচ্ছেন বলে স্বীকার করেছে ইউক্রেন সরকার।
তবে ইউক্রেনের লড়াই এখনো শেষ হয়নি। রাশিয়া যতটুকু অগ্রসর হয়েছে, তার গতি অত্যন্ত ধীর ও ব্যয়বহুল। পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সরবরাহ করা আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র, নতুন কৌশল আর মিত্রদেশগুলোর আর্থিক সহযোগিতায় রুশ সেনাদের পিছু হটিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা এখনো আছে। তবে ইউক্রেনের জন্য হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধার করা কঠিন হলেও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের এই সামরিক অভিযানের অসারতা দেখাতে পারে ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ। ইউক্রেনকে পশ্চিমা-চেহারার রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে পিছপা হবেন না ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। ইতিমধ্যে সে প্রচেষ্টা শুরু করেছেন তিনি। তবে সে প্রচেষ্টা কতটুকু সফল হবে, তা নিয়ে সন্দেহ থাকছে।
অন্যদিকে রুশ প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ তাদের পক্ষে যাবে বলেই মনে হবে। যুদ্ধে উভয় পক্ষই ব্যাপক গোলাবারুদ ব্যবহার করছে। এর মধ্যে রাশিয়া গোলাবারুদ ব্যবহার করছে বেশি। ইউক্রেনের চেয়ে রাশিয়ার অর্থনীতি বড় ও অনেক বেশি ভালো অবস্থায় রয়েছে। বিজয়ের লক্ষ্যে রাশিয়া নির্বিচার আক্রমণ করে ইউক্রেনীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেবে। সম্প্রতি ক্রেমেনচুকের একটি বিপণিবিতানে হামলা করে এমনই আতঙ্ক তৈরি করেছিলেন রুশ সেনারা।
তবে যুদ্ধ যে পুতিনের হিসাবমতো হবে, তা নয়। ইউক্রেনের অনেক যোদ্ধা রয়েছেন, যাঁরা দেশরক্ষার জন্য অস্ত্র হাতে নিয়েছেন। পশ্চিমা সামরিক প্রশিক্ষণ তাঁদের দক্ষ করে তুলবে। নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগেই ২০২০ সালে রাশিয়ার অর্থনীতির চেয়ে ১০ গুণ বড় ছিল ন্যাটো দেশগুলোর অর্থনীতি।
রাশিয়ার অগ্রগতি বন্ধ করতে পারলেই ইউক্রেন যুদ্ধের পালাবদল শুরু হবে। পুতিনের জেনারেলদের কাছে এখন অনেক বেশি অস্ত্র রয়েছে। কিন্তু ন্যাটো জোটের কাছ থেকে আরও দূরপাল্লার নিখুঁত অস্ত্র পেতে শুরু করেছেন ইউক্রেনের সেনারা। এসবের ব্যবহার করে রুশ কমান্ড পোস্ট ও সরবরাহ স্থাপনাগুলো ধ্বংস করতে সক্ষম হবেন ইউক্রেনের সেনারা। গত ৩০ জুন ইউক্রেন এ কৌশলে সফলতা পেয়েছে। ন্যাটোর অস্ত্র ব্যবহার করে কৃষ্ণসাগরের স্নেক আইল্যান্ড থেকে রুশ সেনাদের হটিয়ে দিয়েছেন ইউক্রেনের সেনারা। একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ খেরসন শহরেও রুশ বাহিনীকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে।
যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়া যদি জায়গা হারাতে শুরু করে, তাহলে ক্রেমলিনে ভিন্নমত ও অন্তর্দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়তে পারে। পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মনে করছে, পুতিনকে তাঁর অধীনস্থরা যুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে জানান না। এদিকে জেনারেল পরিবর্তনের অভ্যাস রয়েছে পুতিনের। ইউক্রেন অভিযানের প্রথম সপ্তাহগুলো রুশ বাহিনীর জন্য গোলমেলে হওয়ার পর জেনারেল আলেকজান্ডার ডেভরনিকভকে অভিযানের দায়িত্বে নিয়ে আসেন তিনি।
এদিকে পশ্চিমা দেশগুলো মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত রেখে আরও চাপ তৈরি করতে পারে। এতে রাশিয়ার অর্থনীতি দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। এ ছাড়া পশ্চিমা দেশগুলো ব্যবসায়ী ও ভিন্নমতাবলম্বী রাজনীতিবিদদের স্বাগত জানানোর মাধ্যমে পুতিনের কাছ থেকে রাশিয়ার অভিজাতদের আলাদা করে ফেলতে পারে। ক্রেমলিনের ‘অর্থহীন ও ব্যয়বহুল’ যুদ্ধের ফলে তাঁদের ভবিষ্যৎ শঙ্কার মুখে পড়বে, এ বলে উসকানি দিতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে পশ্চিমারা কোন পথে হাঁটবে? গত ২৩ জুন এক সম্মেলনে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ইউক্রেনকে সদস্যপদের প্রার্থিতা অনুমোদন দিয়েছে। এতে পরের দশকে ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে ইউক্রেনের ঘনিষ্ঠতা বাড়বে। গত সপ্তাহে জার্মানিতে উন্নত দেশগুলোর জোট জি–৭–এর সম্মেলনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়। সর্বশেষ মাদ্রিদে ন্যাটো সম্মেলনে রাশিয়ার হুমকি বিবেচনায় পূর্বাঞ্চলে ন্যাটোর উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।
তারপরও ইউক্রেন এক বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পশ্চিমা প্রতিরক্ষা শিল্পখাতগুলো শক্তিশালী হলেও প্রচুর গোলাবারুদ উৎপাদনের ক্ষেত্রে হিমশিম খাচ্ছে। ইউক্রেন সরকারের মাসিক ঘাটতি ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং যুদ্ধের পরে দেশটিতে অবকাঠামো পুনর্নির্মাণের প্রয়োজন হবে। পশ্চিমা দেশগুলোতে ইউক্রেনের জন্য সাধারণ মানুষের সমর্থন বেশ ধাক্কা খাবে। কারণ হিসেবে থাকবে মুদ্রাস্ফীতি থেকে শুরু করে নির্বাচন পর্যন্ত নানা বিষয়। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফিরবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর রয়েছে ইউক্রেনভীতি ও পুতিনপ্রীতি।
এদিকে দীর্ঘ যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবে। রাশিয়া ইউক্রেনের বন্দরগুলো দিয়ে শস্য ও সূর্যমুখী তেল রপ্তানি বন্ধ করে দিচ্ছে, যা দরিদ্র আমদানিকারক দেশগুলোতে অস্থিরতা ও অনাহারের সৃষ্টি করবে। এ ছাড়া ইউরোপে গ্যাসের ঘাটতি তৈরির চেষ্টা করছে রাশিয়া। যদি জ্বালানিকে কেন্দ্র করে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য ভেঙে পড়ে তার প্রভাব ইউক্রেনের ওপর পড়বে। পরিস্থিতি জটিল হলে ইউক্রেনকে সহযোগিতাকারী দেশগুলোতেও যুদ্ধ নিয়ে যেতে পারেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন। এতে অন্য দেশগুলোও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে।
পুতিন কোন দিকে যাচ্ছেন, তা খোলা চোখেই দেখা যাচ্ছে। তিনি যতটা সম্ভব ইউক্রেনের দখল নেবেন। সেখানে বিজয় ঘোষণা করে ইউক্রেনের ওপর শর্ত চাপিয়ে দেবেন। এর বিনিময়ে তিনি ধ্বংস, ক্ষুধা, ঠান্ডা এবং পারমাণবিক যুদ্ধ থেকে বাকি বিশ্বকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেবেন। এতে ইউক্রেন রাশিয়ার স্থায়ী আগ্রাসনের মুখে পড়বে। এখানকার সফলতা তিনি অন্য ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করবেন।
ইংরেজি থেকে ভাষান্তর মো. মিন্টু হোসেন