স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে জলবায়ু সম্মেলনের অন্যতম একটি বাগ্বিতণ্ডার বিষয় ছিল জলবায়ু তহবিল। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখা ধনী দেশগুলোর কাছ থেকে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র দেশগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে, তা নির্ধারণ করাটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, দরিদ্র দেশের জন্য ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনে কোন দেশের ঐতিহাসিক দায় কতটুকু, তা নির্ধারণ করা জরুরি। পাশাপাশি দেশগুলোর মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণের হারও শনাক্ত করা দরকার।
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান ও ইউরোপের পশ্চিমাঞ্চলের একটি বড় অংশজুড়ে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১২ শতাংশের বসবাস। অথচ এ দেশগুলোই বিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরণের ৫০ শতাংশের জন্য দায়ী। ১৭০ বছর ধরে জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে দেশগুলো। এ সময়ের মধ্যে ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস হারে বেড়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতা। আর এর ফলে বিশ্বে ঘটছে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ, বন্যা, খরা ও দাবানলের ঘটনা।
স্বল্পোন্নত ৪৭টি দেশের জোট-এলডিসি গ্রুপের নেতা সামিটের সভাপতি সোনম ওয়াংদি জলবায়ু সম্মেলনে বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে তাঁর দেশ ভুটানের দায় নেই বললেই চলে। বিভিন্ন গাড়ি ও বাড়ি থেকে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয়ে থাকে, তার তুলনায় অনেক বেশি কার্বন শোষণ করে দেশটি। বিশাল বন সে কার্বনগুলো শুষে নেয়। অথচ, বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার কারণে মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে ভুটান। উষ্ণতা বাড়ার কারণে হিমালয়ের হিমবাহ গলে বন্যা ও ভূমিধস হচ্ছে। গ্রামগুলো তছনছ হয়ে যাচ্ছে।
ওয়াংদি বলেন, ‘বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে দায় না থাকার পরও আমাদের মারাত্মকভাবে ভুগতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য সহায়তা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।’
এক দশক আগে বিশ্বের ধনী দেশগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় দরিদ্র দেশগুলোকে ২০২০ সাল নাগাদ বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেওয়া হবে। তবে সেই প্রতিশ্রুতি তারা ধরে রাখতে পারেনি। এ তহবিলে শতকোটি ডলার বার্ষিক ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। বন্যা ও খরার জন্য আগাম সতর্কতাব্যবস্থা স্থাপনসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের জন্য দরিদ্র দেশগুলো যে সহায়তা পায়, তা–ও যৎসামান্য।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিতে থাকা অন্য দেশগুলোও আলাদা করে তাদের ভবিষ্যৎ পরিণতি নিয়ে সতর্ক করেছে। তারা বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট ঝড়, হারিকেন কিংবা দুর্ভিক্ষজনিত সব পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সক্ষমতা তাদের নেই। বিশ্ব ক্রমাগত উষ্ণ হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দুর্যোগে মানুষের প্রাণহানির ঘটনা চলতে থাকবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়তে থাকলে গ্রামগুলোও পানিতে বিলীন হতে থাকবে।
খুব কম কার্বন নিঃসরণের পরও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে দেশগুলো আছে, তারা আলাদা তহবিল গঠনের দাবি জানিয়েছে। অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ করে জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখা ধনী দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে তহবিলে অনুদান দিতে হবে। অর্থাৎ, ইতিমধ্যে যে ক্ষতি তারা করে ফেলেছে, সেগুলোর মাশুল হবে এ তহবিল।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেছেন, অনেক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, তাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হচ্ছে। কাউকে না কাউকে এর দায় নিতে হবে।
জলবায়ু তহবিল নিয়ে বলতে গিয়ে ৯০–এর দশকে তামাক কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরকার যে ব্যবস্থা নিয়েছিল, সে প্রসঙ্গ টেনে আনেন এ কে মোমেন। ওই সময়ে ধূমপানের কারণে স্বাস্থ্য সুরক্ষা খাতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে শতকোটি ডলার খরচ করতে হয়েছিল। সে অর্থ পুনরুদ্ধারে যুক্তরাষ্ট্র সরকার তামাক কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করেছিল তখন।
ক্ষতিপূরণ হিসেবে সুনির্দিষ্ট তহবিল জোগানোর আহ্বান বরাবরই নাকচ করে আসছে ধনী দেশগুলো। তাদের আশঙ্কা, এর মধ্য দিয়ে অনেক অভিযোগ ওঠার সুযোগ তৈরি হয়ে যাবে। ধনী দেশগুলোর দায়বদ্ধতাজনিত বিভিন্ন প্রশ্ন সামনে আসবে। একমাত্র স্কটল্যান্ড সরকারই স্বেচ্ছায় সুনির্দিষ্ট পরিমাণে অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। জলবায়ু সম্মেলনে দেশটি ঘোষণা করেছে, জলবায়ু দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ২৭ লাখ ডলার সহায়তা দেবে তারা।
বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৮ শতাংশের বসবাস চীনে। ১৮৫০ সাল থেকে গোটা বিশ্বে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয়েছে, তার প্রায় ১৪ শতাংশের জন্য দায়ী দেশটি। এখন পর্যন্ত চীন বিশ্বের সর্বোচ্চ কার্বন নির্গমনকারী দেশ। চলতি বছর মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরিত হয়েছে, তার ৩১ শতাংশের জন্য চীন দায়ী। গ্লাসগো সম্মেলনে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর জন্য জলবায়ু তহবিল গঠনের ব্যাপারে সম্মতি জানিয়েছে চীন। তবে এ তহবিলে অনুদান দেওয়ার জন্য এখন পর্যন্ত দেশটিকে কোনো চাপ দেওয়া হয়নি।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতার জায়গাটি শনাক্ত করলেই ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কোনো দেশে মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণের হার কত, তা শনাক্ত করা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, চলতি বছর বিশ্বে যে পরিমাণ কার্বন ডাই–অক্সাইড নির্গত হয়েছে, তার ৭ শতাংশ ভারত একাই নির্গত করেছে। একই পরিমাণ নিঃসরণ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। আর যুক্তরাষ্ট্র করেছে ভারতের অর্ধেক নিঃসরণ। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন অঞ্চল ও যুক্তরাষ্ট্রে যত মানুষ বাস করে, তার তুলনায় ভারতে অনেক বেশি মানুষের বাস। অপেক্ষাকৃত দরিদ্রও। ভারতের লাখো মানুষ এখনো নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ–সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ফলে মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণের হার বিবেচনায় নিলে ভারতের মানুষেরা এখন মাথাপিছু কম কার্বন নিঃসরণ করে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দাবি, ভারতের মতো দেশগুলো কার্বন নিঃসরণ ঠেকাতে আরও বেশি পদক্ষেপ না নিলে বিশ্ব কখনোই উষ্ণতা বৃদ্ধিজনিত ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পারবে না। তবে ভারত সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে, ২০৭০ সাল নাগাদ কার্বন নিঃসরণ ‘নিট জিরো’তে নামিয়ে আনবে তারা। এর জন্য কয়লার ব্যবহার বন্ধ করে পরিবেশবান্ধব জ্বালানিব্যবস্থা চালুর জন্য আরও অনেক অর্থসহায়তার প্রয়োজন হবে বলে জানিয়েছে দেশটি।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, তহবিল–সংক্রান্ত এ বিরোধের সমাধান কীভাবে করা হচ্ছে তা খুব জরুরি। কারণ, ভবিষ্যৎ বৈশ্বিক উষ্ণতাজনিত ঝুঁকি সীমিত করতে দেশগুলো নতুন কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারবে কি না, তা এর মধ্য দিয়েই নির্ধারণ হবে।