সুলতান সুলেমান। তুরস্কের ৬০০ বছরের অটোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম সফল শাসক। একটি টিভি সিরিয়ালের বদৌলতে নামটি এখন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে বেশ পরিচিত। সম্প্রতি সমর্থকদের রাস্তায় ডেকে এনে সেনা অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দিয়ে আলোচনায় আছেন ওই দেশেরই বর্তমান শাসক প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। দুই শাসকের মধ্যে কিছু বিষয়ে মিল থাকায় অনেকের মনে প্রশ্ন—এরদোয়ান কি এই যুগের সুলতান সুলেমান?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে অটোমান সম্রাট সুলতান সুলেমানের শাসনামলে একটু ঢুঁ মারতে হবে। ১২৯৯ সালে যাত্রা শুরু করা অটোমান সাম্রাজ্যের দশম শাসক ছিলেন সুলতান সুলেমান। প্রায় পাঁচ দশক সাম্রাজ্য শাসন করেছেন তিনি। তাঁর সময়ে অটোমানরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে অনেক বেশি শক্তিমান হয়ে ওঠে। ইউরোপের রোম, হাঙ্গেরিসহ অনেক অঞ্চল অটোমানদের অধীনে আসে। ইউরোপে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান জানান দেয় তুরস্ক।
এরদোয়ানও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী হয়ে ওঠার কৌশল নিয়েছেন। জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের উত্থান থেকে তিনি সুবিধা নিচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে। সিরিয়া ও ইরাকের একটি বড় ভূখণ্ড দখল করে খেলাফত ঘোষণা করেছে আইএস। এই দুই দেশের ক্ষমতাসীন নেতৃত্বের সঙ্গে মতাদর্শগত ভিন্নতা আছে এরদোয়ানের, ইরাক ও সিরিয়ার ক্ষমতাসীনরা শিয়াপন্থী আর এরদোয়ান সুন্নিপন্থী। তিনি সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের সরকারকে উৎখাতে আইএসের হামলায় সমর্থন দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে বরাবরই তিনি এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। আইএসকে তাঁর নীরব সমর্থনের কারণ হিসেবে বলা হয়, সিরিয়া ও ইরাক থেকে লুট করা জ্বালানি প্রচলিত মূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে তুরস্কের কাছে বিক্রি করে আইএস। এতে তুরস্কের অর্থনীতি অনেকটাই স্থিতিশীল থাকে। নিত্যপণ্যের মূল্য আয়ত্তে থাকায় জনগণও প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ওপর বেশ খুশি।
জনগণের এই সন্তুষ্টিকে সেনা অভ্যুত্থান ব্যর্থ করতে বেশ কৌশলে কাজে লাগিয়েছেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। ১৫ জুলাই রাতে তুরস্কের সেনাবাহিনীর একটি অংশ যখন ট্যাংক ও যুদ্ধবিমান নিয়ে রাজধানী আঙ্কারা ও ইস্তাম্বুলে অভ্যুত্থান করে, তখন অবকাশে থাকা প্রেসিডেন্ট তাঁর আইফোনে ‘ফেসটাইম’ অ্যাপ ব্যবহার করে সিএনএন তুর্কির সঙ্গে সংযুক্ত হন। সমর্থকসহ দেশের জনগণের প্রতি আহ্বান জানান, রাস্তায় নেমে আসার। এই অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দেওয়ার। এরপর দ্রুত পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। জনগণ রাস্তায় নেমে এসে সেনাদের অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দেয়।
সুলতান সুলেমান তখনকার ক্ষমতাশালী ইউরোপকে চাপের মুখে রেখেছিলেন। আর প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এখন পশ্চিমা বিশ্বে শক্তিশালী তুরস্ককে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। একসময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্যভুক্ত হওয়ার চেষ্টা করা তুরস্ক এখন নিজের একক শক্তিশালী অবস্থার কথা জানান দিতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক যেমন রেখেছেন, তেমনি বিপরীত মেরুর শক্তি রাশিয়ার সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক বজায় রাখছেন এরদোয়ান। এভাবেই প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চলছে।
ইসলাম ধর্মের প্রসারের ক্ষেত্রে বিশেষ মনোযোগী ছিলেন সুলতান সুলেমান। একটু ভিন্নভাবে একই পথের অনুসারী এরদোয়ান। কারণ, ১৯২৩ সালে কামাল আতাতুর্কের হাত ধরে ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কের যাত্রা শুরু। দেশটিতে নিষিদ্ধ হয় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। কিন্তু ইসলামপন্থী এরদোয়ান রক্ষণশীল রাজনৈতিক ও সামাজিক আদর্শের কথা বলে ২০০১ সালে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) গঠন করেন। তাঁর দল ২০০২, ২০০৭ ও ২০১১ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। উদারপন্থী তুরস্ক তখন থেকে কিছুটা রক্ষণশীলতার দিকে যেতে থাকে। তিনি ২০০৩ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন; পরে ওই বছরই প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব দেন।
ক্ষমতার ব্যাপারে সুলতান সুলেমান ছিলেন আপসহীন। সামান্যতম আনুগত্যহীনতা, ষড়যন্ত্র বা ষড়যন্ত্রের আভাসও তিনি বরদাশত করতেন না। তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন—এমন অভিযোগে তিনি তাঁর বন্ধু ও উজিরে আজম (প্রধানমন্ত্রী) ইব্রাহিম পাশা এবং সিংহাসনের প্রথম উত্তরাধিকারী বড় ছেলে শাহজাদা মোস্তাফার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন। এখানেও কেমন যেন মিল পাওয়া যায় এরদোয়ানের সঙ্গে। সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনায় ১০৪ সেনাসদস্যসহ প্রায় ৩০০ লোকের প্রাণহানির পর প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান অভিযোগের আঙুল তোলেন তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু ফেতুল্লাহ গুলেনের দিকে।
দেশটিতে এরদোয়ান জরুরি অবস্থা জারি করেছেন গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও জনগণের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্দেশ্যে। সরকার, সশস্ত্র বাহিনী, নিরাপত্তা বাহিনী, বিচার বিভাগ, গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক ধরপাকড় চালাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। অভ্যুত্থানের পর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৬০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আটক, বহিষ্কার বা সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, ব্যর্থ অভ্যুত্থানের অজুহাতে তিনি মূলত তুরস্কের উদারপন্থী অংশকে কোণঠাসা করতে চাইছেন। দেখিয়ে দিতে চাইছেন, তাঁর বিরোধিতার পরিণাম কী হতে পারে।