জ্বালানি তেলের বাড়তি কর, জীবনযাত্রার নিম্নমান আর দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিসপত্রের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ফ্রান্সে চলছে ‘ইয়েলো ভেস্ট’ আন্দোলন। এ আন্দোলনের মুখে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে দেশটির সরকার। ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলন এখন কোন দিকে যাবে, আর কে এগিয়ে নেবে, সে প্রশ্ন উঠছে এখন।
জ্বালানি তেলের ওপর পরিবেশ কর আরোপের প্রতিবাদে গত অক্টোবর মাস থেকে ইয়েলো ভেস্ট বা ‘হলুদ জ্যাকেট’ আন্দোলন শুরু হয়। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আয়োজিত এসব প্রতিবাদ–বিক্ষোভে ট্যাক্সিচালকদের ব্যবহৃত হলুদ জ্যাকেট পরে প্রতিবাদকারীরা অংশ নেওয়ায় এই আন্দোলনের নাম দেওয়া হয় ‘ইয়েলো ভেস্ট’ বা ‘হলুদ জ্যাকেট’ আন্দোলন।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর ক্লিন এনার্জি উদ্যোগের প্রচেষ্টার অর্থ হিসেবে কর বাড়ানো হয়। কিন্তু মাখোঁর ওই সিদ্ধান্ত ভালোভাবে নেয়নি দেশটির মধ্যবিত্ত শ্রেণি। ফ্রান্সের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জ্বালানি তেলের দাম কমানো ও অন্যান্য দাবিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই মাখোঁর বিরুদ্ধে ‘বড়লোকের প্রেসিডেন্ট’, ‘সাধারণ মানুষের চিন্তা নেই’ বলে বিক্ষোভ করছেন।
টানা দুই সপ্তাহ দেশজুড়ে ব্যাপক প্রতিবাদ-বিক্ষোভের পর ৪ ডিসেম্বর জ্বালানির ওপর বর্ধিত কর প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় ফ্রান্সের সরকার। ৩ ডিসেম্বর রাতে ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী এদুয়া ফিলিপ এই ঘোষণা দেন।
এএফপির প্রতিবেদনে জানানো হয়, ফ্রান্সে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। তীব্র নাগরিক অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিবাদে ট্যাক্সিচালকদের ব্যবহৃত ‘ইয়েলো ভেস্ট’ পরে রাস্তায় নেমেছেন বিক্ষোভকারীরা। এই আন্দোলন ‘ইয়েলো ভেস্ট’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। বিভিন্ন সময়ে সংঘর্ষে এখনো পর্যন্ত তিনজন নিহত হয়েছেন।
আগামী ১ জানুয়ারি থেকে জ্বালানির ওপর বর্ধিত কর কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৭ নভেম্বর গ্যাসোলিন ও ডিজেলের দাম বাড়ার প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু হয়। সঙ্গে ১ হাজার ৩৫০ ডলার থেকে মাসিক ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর দাবিও উঠেছে। বিক্ষোভ গত শনিবার ভয়াবহ সহিংস আকার ধারণ করে। প্রেসিডেন্ট মাখোঁর পদত্যাগের দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে প্যারিসের রাজপথ।
প্রধানমন্ত্রী ফিলিপের জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে (কপ-২৪) অংশ নিতে পোল্যান্ড সফরে যাওয়ার কথা ছিল। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তিনি সফর বাতিল করতে বাধ্য হন। প্যারিসের শঁজ এলিজে সড়কে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের ব্যাপক দাঙ্গা বাধে। বিক্ষোভকারীরা ঢিল ছোড়েন। ভাঙচুর করেন। গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে পুলিশ। গ্রেপ্তার করে ৪০০ বিক্ষোভকারীকে। ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনুমান করছে, মোট ২ লাখ ৮০ হাজার মানুষ এ পর্যন্ত বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। শনিবারের তাণ্ডবে রাজধানীতে ৩৪ লাখ মার্কিন ডলারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে সরকার।
১৭ নভেম্বর থেকে রাস্তা অবরোধ করতে শুরু করে বিক্ষোভকারীরা। এরপর থেকে প্রতি শনিবার প্রতিবাদ করছে তারা। বিক্ষোভকারীরা বলছেন, এ ঘটনায় ২০০ গাড়ি পুড়েছে এবং ৪১২ জনকে পুলিশ আটক করেছে।
বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য কী?
এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, বিক্ষোভকারীদের একেকজনের লক্ষ্য একেক রকম। তাঁদের মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো নেতা নেই। তৃণমূলের এ আন্দোলন তাই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ঝড় তুলেছে। কেউ কেউ জ্বালানি তেলের মূল্য কমানোর দাবি করছেন বা কেউ কেউ অন্যান্য আর্থিক বোঝা কমাতে বলছেন। কেউ কেউ মাখোঁর পদত্যাগ চাইছেন। কেউ কেউ পেনশন বাড়ানোর বা সর্বনিম্ন মজুরি বাড়ানোর কথাও বলছেন।
পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর মতে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর গত ১৮ মাসের মধ্যে মাখোঁর সরকারের বিরুদ্ধে এটাই সবচেয়ে বড় ও ধারাবাহিক আন্দোলন। পরিস্থিতি সামাল দিতে আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে গত মঙ্গলবার বৈঠকে বসার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী ফিলিপ। তিনি কম মজুরির শ্রমিকদের বোনাস দেওয়ার ঘোষণা দেন।
মতামত জরিপে দেখা গেছে, ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ এ বিক্ষোভের পক্ষে মত দিয়েছে। বিক্ষোভকারীরাও বলছেন, তাঁরা খালি হাতে ফিরতে চান না। কিন্তু এর কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব না থাকায় কার সঙ্গে কথা বললে আন্দোলন থামবে, তা খুঁজে পেতে দিশেহারা সরকার।
ফ্রান্সের পেট্রোলিয়াম ইন্ডাস্ট্রি ফেডারেশনের (ইউএফআইপি) তথ্য অনুসারে, এ বছর ডিজেলের দাম বেড়েছে ১৬ শতাংশ। গত অক্টোবরে প্রতি লিটারে গড়ে ১ দশমিক ২৪ ইউরো (১ দশমিক ৪১ মার্কিন ডলার) থেকে ১ দশমিক ৪৮ ইউরো (১ দশমিক ৫৩ মার্কিন ডলার) দাম বেড়েছে ডিজেলের। তথ্যসূত্র: রয়টার্স, এএফপি