পূর্ব ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলে নতুন ধাপে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে রুশ বাহিনী। এই অভিযানে রাশিয়া ২০ হাজার ভাড়াটে যোদ্ধা মোতায়েন করেছে। সিরিয়া, লিবিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এই ভাড়াটে যোদ্ধাদের সংগ্রহ করা হয়েছে। ইউরোপীয় এক কর্মকর্তা এমনটাই দাবি করেছেন। তবে তাঁর দাবি স্বাধীনভাবে যাচাই করা যায়নি। এ ব্যাপারে রাশিয়ারও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
পূর্ব ইউক্রেনের ক্রেমিন্না শহর দখলে নিয়েছে রুশ বাহিনী। দনবাস অঞ্চলে রুশ বাহিনীর নতুন ধাপের অভিযান শুরুর পর এটিই তাদের নিয়ন্ত্রণে যাওয়া প্রথম শহর।
ইউক্রেনের বন্দরনগরী মারিউপোলে অবস্থানরত দেশটির সেনাদের আত্মসমর্পণের জন্য নতুন সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে রাশিয়া। মস্কোর স্থানীয় সময় আজ বুধবার বেলা ২টা থেকে তাঁদের সামরিক কার্যক্রম বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের পর কানাডা রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দুই মেয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এ ছাড়া পুতিনের ১৪ ঘনিষ্ঠজনের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
ইউরোপের ৩১ জন কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে মস্কো। রুশ কূটনীতিক বহিষ্কারের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে মস্কো এ পদক্ষেপ নিল।
২০ এপ্রিল ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযান ৫৬তম দিনে গড়িয়েছে। চলমান ইউক্রেন সংকট নিয়ে পাঠকের মনে আছে নানা প্রশ্ন। বিবিসি অবলম্বনে সেসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা রইল এ প্রতিবেদনে।
সাম্প্রতিক ইতিহাস বিবেচনায় নিলে চলমান সংকটের সূত্রপাত ২০১৪ সালে। তবে এ সংকটের মূলে যেতে ফিরে তাকাতে হবে সোভিয়েত আমলে। তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল ইউক্রেন।
ইউক্রেনে দুটি রাজনৈতিক ধারা প্রবল। একটি ধারা পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চায়। তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) যোগ দেওয়ার পাশাপাশি পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য হতে আগ্রহী। অপর ধারাটি রুশপন্থী। তারা রাশিয়ার বলয়ে থাকতে চায়।
ইউক্রেনের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ রুশভাষী। তারা জাতিগতভাবেও রুশ। রাশিয়ার সঙ্গে তাদের সাংস্কৃতিক-সামাজিক ঘনিষ্ঠতা আছে।
বিক্ষোভের মুখে ২০১৪ সালে ইউক্রেনের রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের পতন হয়। তিনি দেশ ছেড়ে পালান।
ইয়ানুকোভিচ ইইউর সঙ্গে বড় ধরনের বাণিজ্য চুক্তি করতে চেয়েছিলেন। তখন পুতিন চাপ বাড়ান। চাপে পড়ে ইয়ানুকোভিচ ইইউর সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা থেকে বেরিয়ে আসেন। ফলে ইউক্রেনে তাঁর বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ শুরু হয়।
ইয়ানুকোভিচের পর যাঁরা ইউক্রেনের ক্ষমতায় আসেন, তাঁরা ইইউপন্থী বলে পরিচিত। তাঁদের নানা পদক্ষেপে পুতিন ক্ষুব্ধ হন।
ইয়ানুকোভিচের পতনের পর পূর্ব ইউক্রেনের ক্রিমিয়া অঞ্চল দখল করে নেয় রাশিয়া।
প্রায় ২০০ বছর ধরে রাশিয়ার অংশ ছিল ক্রিমিয়া। ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ তৎকালীন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র ইউক্রেনের কাছে ক্রিমিয়া হস্তান্তর করেন। তখন রুশ নেতৃত্ব ভাবতে পারেনি যে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হবে।
ক্রিমিয়ার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক। কৌশলগত কারণে রাশিয়ার কাছে ক্রিমিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই সুযোগ পেয়ে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া দখল করে নেয় রাশিয়া।
পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য নয় ইউক্রেন। তবে দেশটি ন্যাটোর সদস্য হতে চায়। বিষয়টি মানতে নারাজ রাশিয়া। এ কারণে রাশিয়া পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে এমন নিশ্চয়তা চায় যে ইউক্রেনকে কখনো ন্যাটোর সদস্য করা হবে না।
রাশিয়ার চাওয়া অনুযায়ী, এ ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা দিতে রাজি নয় পশ্চিমা দেশগুলো।
পুতিন মনে করেন, রাশিয়াকে চারদিক থেকে ঘিরে পশ্চিমা দেশগুলো ন্যাটোকে ব্যবহার করছে। ইউক্রেনকেও এ উদ্দেশ্যে ন্যাটোতে নেওয়া হতে পারে। এ কারণে পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিরোধিতা করছেন তিনি।
রাশিয়ার অভিযোগ, গত শতকের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোকে পূর্ব দিকে সম্প্রসারণ করা হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু এ প্রতিশ্রুতি রাখা হয়নি।
রাশিয়ার অভিযোগ প্রত্যাখ্যানের পাশাপাশি ইউক্রেনকে ন্যাটো জোটে অন্তর্ভুক্ত না করার যে দাবি মস্কো জানাচ্ছে, তা নাকচ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
অন্যদিকে ন্যাটো বলছে, এটি একটি আত্মরক্ষামূলক সামরিক জোট। প্রতিটি দেশের প্রতিরক্ষার পথ বেছে নেওয়ার অধিকার আছে।
১৯৯০-এর দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। এ ভাঙনকে রাশিয়ার জন্য একটি ভূরাজনৈতিক বিপর্যয় বলে মনে করেন পুতিন। তারপর থেকে রাশিয়া দেখছে, সামরিক জোট ন্যাটো ধীরে ধীরে তাদের ঘিরে ফেলছে। সংগত কারণেই রাশিয়া তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
১৯৯৯ সালে চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ড ন্যাটোতে যোগ দেয়। ২০০৪ সালে যোগ দেয় বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়া, রোমানিয়া ও স্লোভাকিয়া। ২০০৯ সালে যোগ দেয় আলবেনিয়া।
জর্জিয়া, মলদোভা বা ইউক্রেনেরও ন্যাটোতে যোগ দেওয়া আকাঙ্ক্ষা আছে। কিন্তু রাশিয়ার কারণে এখন পর্যন্ত তা হয়ে ওঠেনি। তবে এই তিন দেশে রুশপন্থী বিদ্রোহী আছে। এই দেশগুলোর কোনোটি যদি ন্যাটোতে যোগ দেয়, তবে তা রাশিয়ার জন্য মেনে নেওয়া কঠিন হবে।
সমরাস্ত্র ছাড়া রাশিয়ার একটি বড় হাতিয়ার হলো তার জ্বালানি। ইউরোপের মোট তেল-গ্যাস সরবরাহের ২৫ শতাংশ যায় রাশিয়া থেকে।
ইউরোপে গ্যাস সরবরাহে রাশিয়ার প্রবেশদ্বার ইউক্রেন। রাশিয়া থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রধান গ্যাস পাইপলাইনগুলো ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে গেছে।
ফলে ইউক্রেন যদি রাশিয়ার প্রভাববলয়ের বাইরে চলে যায়, তাহলে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে রাশিয়া তার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে।
ন্যাটোর প্রধান জেনস স্টলটেনবার্গ বলেছেন, এ জোটের মূল কাজ হলো সব মিত্রের সুরক্ষা দেওয়া। একজনের ওপর আক্রমণ মানে সবার ওপর আক্রমণ। জোটের নীতিনির্ধারণী পর্ষদ অন্যান্য দেশকে রক্ষার যে প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা রয়েছে, সেটা সক্রিয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্থাৎ যেখানে প্রয়োজন হবে, সেখানে ন্যাটো সেনা মোতায়েন করা হবে।
তবে পশ্চিমা কোনো দেশ এখন পর্যন্ত ইউক্রেনে সেনা পাঠাতে সম্মত হয়নি।
কিন্তু অস্ত্র, গোলাবারুদসহ সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ২৭টি দেশ।
মার্কিন গণমাধ্যম স্কাই নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউক্রেনে যেসব অস্ত্র পাঠানো হচ্ছে, তার মধ্যে গোলাবারুদ, ট্যাংক ও বিমান বিধ্বংসী অস্ত্রের মতো প্রাণঘাতী অস্ত্র রয়েছে।
ইউক্রেন সীমান্তে লাখো সেনা মোতায়েন নিয়ে পশ্চিমাদের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে ২১ ফেব্রুয়ারি দেশটির রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী-নিয়ন্ত্রিত দনবাসের দুটি অঞ্চল দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। একই সঙ্গে ‘প্রজাতন্ত্র’ দুটিতে রুশ সেনাদের ‘শান্তিরক্ষী’ হিসেবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন তিনি।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর রাশিয়াকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করতে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় বিশ্বের সব দেশকে ছাড়িয়ে গেছে রাশিয়া। হামলার ১৩ দিনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ২ হাজার ৭৭৮টি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এর আগে দেশটির বিরুদ্ধে ২ হাজার ৭৫৪টি নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল। এ নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার সংখ্যা সাড়ে ৫ হাজার ছাড়িয়েছে।
প্রেসিডেন্ট পুতিন ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের পাশাপাশি রাশিয়ার বিভিন্ন ব্যাংক–প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনের ব্যবস্থা সুইফট থেকে দেশটির কয়েকটি ব্যাংককে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাজ্য, জার্মানি, পোল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্রসহ ইউরোপের বেশির ভাগ দেশের আকাশসীমায় রাশিয়ার উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে ইউক্রেনে ৩০ দিনের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। ইউক্রেনের ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড ডিফেন্স কাউন্সিলের সেক্রেটারি ওলেক্সি দানিলভ জানান, দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক ছাড়া সারা দেশে জরুরি অবস্থা জারি থাকবে।
রুশ আক্রমণ প্রতিরোধে ইউক্রেন তাদের সংরক্ষিত সেনাদের নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত করে। যুদ্ধের জন্য ইউক্রেনের নাগরিকদেরও প্রস্তুত থাকতে বলা হয়।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে এক ভাষণে বলেন, তাঁর দেশে রুশ আক্রমণ ইউরোপে একটি বড় যুদ্ধের সূচনা করতে পারে।
পূর্ব ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার লাখো সেনা মোতায়েন নিয়ে পশ্চিমাদের সঙ্গে বেশ কিছুদিন ধরে মস্কোর উত্তেজনা চলছিল। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা বলে আসছিল, ইউক্রেনে হামলার পরিকল্পনা করছে রাশিয়া। তবে রাশিয়া বলে আসছিল, ইউক্রেনে হামলার পরিকল্পনা নেই মস্কোর। শেষ পর্যন্ত সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়।
২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে পূর্ব ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদী-নিয়ন্ত্রিত দনবাস অঞ্চলে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরুর নির্দেশ দেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন। সামরিক অভিযান শুরুর ঘোষণা দিয়ে পুতিন পূর্ব ইউক্রেনে থাকা ইউক্রেনের সেনাদের অস্ত্র ত্যাগ করে ঘরে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান।
পুতিনের নির্দেশের পরপরই স্থানীয় সময় ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে স্থল, আকাশ ও জলপথে ইউক্রেনে হামলা শুরু করেন রাশিয়ার সেনারা।
রাশিয়ার সেনাবাহিনী আক্রমণ চালায় উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব দিক থেকে। বেলারুশ থেকেও হামলা হয়। সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করছিলেন রুশ সেনারা।
পুতিন দুই দিনের মধ্যে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ দখলের পরিকল্পনা করেছিলেন বলে দাবি করেন মার্কিন গোয়েন্দাপ্রধান।
তবে প্রতিরোধসহ নানা কৌশলের মাধ্যমে রুশ সেনাদের অগ্রগতি ধীর করে দিতে সক্ষম হয়েছে ইউক্রেনের বাহিনী।
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম দুই সপ্তাহে রাশিয়ার আনুমানিক পাঁচ থেকে ছয় হাজার সেনা নিহত হয়েছেন বলে ধারণা করছেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা।