ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার এক মাস হলো। এর মধ্য প্রাণহানির সঙ্গে দেশটির বাতাসে বারুদের গন্ধ। লাখো মানুষ ঘর ছেড়েছে। হতাহতের তালিকায় যোগ হচ্ছে নতুন নতুন মুখ। এ সমস্যার মূলে কী, আর সমাধানের পথ খোঁজারও চেষ্টা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জন জে মার্শেইমার। তিনি দেখার চেষ্টা করেছেন ইউক্রেন সমস্যার মূল কী, আর সমাধান কীভাবে করা যেতে পারে। যুক্তরাজ্য দ্য ইকনোমিস্টে প্রকাশিত তাঁর সেই লেখার পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।
১৯৬২ সালে কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে তৈরি সংকটের পর সবচেয়ে ভয়াবহ আন্তর্জাতিক সংকট এখন ইউক্রেন যুদ্ধ। যদি এ পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে যেতে দিতে না চাই এবং এর পরিবর্তে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করার উপায় খুঁজে বের করতে চাই, তাহলে ইউক্রেনে কেন এ যুদ্ধ শুরু হলো তার মূল কারণগুলো বোঝা আমাদের জন্য অপরিহার্য।
ভ্লাদিমির পুতিন হামলা শুরু করেছেন এবং এর সব দায় তাঁর, এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু কেন তিনি ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু করলেন, এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। পশ্চিমা দেশগুলোতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে একজন বিচারবুদ্ধিহীন ব্যক্তি মনে করা হয়। পশ্চিমা নেতাদের কাছে তাঁর ভাবমূর্তি এমন যে পুতিন ধরাছোঁয়ার বাইরে এমন একজন আগ্রাসী ব্যক্তি, যিনি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো করে বৃহত্তর রাশিয়াকে আবার এক করার স্বপ্নে বিভোর।
ইউক্রেনে যুদ্ধের সব দায় পুতিনের হলেও তাঁকে নিয়ে যে গল্পটা পশ্চিমে চালু আছে, সেটা ভুল। ২০১৪ সালে ইউক্রেনে যে সংকট শুরু হয়েছিল, সেই সংকটের জন্য মূলত পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র দায়ী। সেই সংকট এখন যুদ্ধের রূপ নিয়েছে। আর এতে শুধু ইউক্রেন ধ্বংসের ঝুঁকিতে পড়েনি, রাশিয়া ও ন্যাটোর মধ্যে সম্ভাব্য পারমাণবিক যুদ্ধের শঙ্কাও তৈরি হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে, এ সংকটের শুরু ২০০৮ সালের এপ্রিলে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসন ছিল সংকটের মূলে। যুক্তরাষ্ট্রের চাপে বুখারেস্ট সম্মেলনে ন্যাটো এমন ঘোষণা দিতে বাধ্য হয় যে ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে ন্যাটোর সদস্য করা হবে। রাশিয়ার নেতারা তাৎক্ষণিক এর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে ন্যাটোর সদস্য করার এ ঘোষণাকে রাশিয়া তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করে যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটোকে পিছু হটতে বাধ্য করার হুমকি দেয়।
রাশিয়ার এক সাংবাদিক তখন বলেছিলেন, ন্যাটোর এমন ঘোষণা শুনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ক্ষিপ্ত হন ও হুমকি দেন, ‘ইউক্রেন যদি ন্যাটোতে যোগ দেয়, তাহলে ক্রিমিয়া ও ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলকে ছাড়াই ন্যাটোতে যোগ দিতে হবে। ইউক্রেন টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।’ কিন্তু এই হুমকি যুক্তরাষ্ট্র আমলে নেয়নি। উল্টো রাশিয়া সীমান্তে ইউক্রেনকে পশ্চিমা স্বার্থরক্ষার ঢাল হিসেবে তৈরির চেষ্টা চালাতে থাকে। এতে দুটি বিষয় ঘটে। এক, ইউক্রেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কাছাকাছি চলে আসে। দুই, ইউক্রেন হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রপন্থী দেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের মদদে ২০১৪ সালে ইউক্রেনে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের মুখে ইউক্রেনের তৎকালীন রাশিয়া-সমর্থিত সরকারের পতন ঘটে এবং রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ দেশ ছেড়ে পালান। এর মধ্য দিয়েই দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের শুরু। এর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয় রাশিয়া এবং এরপরই গৃহযুদ্ধ শুরু হয় পূর্ব ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলে।
এরপর সর্বশেষ বড় ধরনের সংঘাত শুরু হয় গত ডিসেম্বরে এবং সেই সংঘাত থেকেই এখন যুদ্ধ চলছে ইউক্রেনে। যুদ্ধের মূল কারণ, সদস্য না হয়েও ইউক্রেনের ন্যাটোর অংশ হয়ে ওঠা। এই প্রক্রিয়া শুরু হয় ঠিক পাঁচ বছর আগে, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে যখন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কিয়েভের কাছে আত্মরক্ষামূলক অস্ত্র বিক্রির ঘোষণা দেন। আত্মরক্ষামূলক অস্ত্রের মানে মস্কো তা স্পষ্ট বুঝে যায়। ইউক্রেনের মার্কিন অস্ত্রকে মস্কো ও দনবাস অঞ্চলে রাশিয়ার মিত্ররা যে আত্মরক্ষামূলক হিসেবে বিবেচনা করেনি, সেটাও খুব স্বাভাবিক। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, ন্যাটোর অন্য দেশগুলোও দৃশ্যপটে চলে আসে। তারাও ইউক্রেনে অস্ত্র বিক্রি ও ইউক্রেনের সেনাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে। এমনকি যৌথ সামরিক বিমান ও নৌমহড়ায় ইউক্রেনকে যুক্ত করে। ২০২১ সালের জুলাইয়ে কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্রসহ ৩২ দেশ নৌমহড়া চালায়। ‘অপারেশন সি ব্রিজ’ নামের যৌথ মহড়া চলাকালে যুক্তরাজ্যের একটি জাহাজ রাশিয়ার জলসীমায় ঢুকেছে দাবি করে রাশিয়া তাতে গুলি ছুড়লে উত্তেজনা আরও বাড়ে।
জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের মধ্যে সম্পর্ক আরও জোরালো হতে শুরু করে। শুধু মুখে মুখে নয়, এর লিখিত রূপ দেওয়া হয় ‘যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেন চার্টার অন স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ’ নামের একটি নথির মাধ্যমে। গত বছরের নভেম্বরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্র কুলেবা কৌশলগত অংশীদারত্বের এ নথিতে সই করেন। এর লক্ষ্য, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ইইউ ও ন্যাটোর সদস্য করার জন্য ইউক্রেনে প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রমে সহায়তা করা। নথিটি স্পষ্টতই ইউক্রেন-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা এবং এই কৌশলগত অংশীদারত্বের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছেছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। চুক্তিতে আরও বলা হয়, ২০০৮ সালের বুখারেস্ট সম্মেলনের ঘোষণা মতো কাজ করবে দুই দেশ।
এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে দেখে মস্কোর সহ্য হয়নি, সেটা নিয়ে অবাক হওয়ারও কিছু নেই। যুক্তরাষ্ট্রের এমন কার্যকলাপ দেখে গত বসন্ত থেকে ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েন করতে শুরু করে রাশিয়া। এর মধ্য দিয়ে এ সমস্যা সমাধানেরও ইঙ্গিত দেয় মস্কো। কিন্তু এতে তো কোনো কাজ হয়নি, উল্টো কিয়েভের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হতে থাকে ওয়াশিংটন। এতে করে গত বছরের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পুরোদমে কূটনৈতিক টানাপোড়েন শুরু হয়। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেরগেই লাভরভ সে সময় সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘আমরা সহ্যের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেছি।’ এরপর রাশিয়া লিখিত অঙ্গীকার চায় যে ইউক্রেনকে কখনোই ন্যাটোর সদস্য করা হবে না এবং ১৯৯৭ সাল থেকে পূর্ব ইউরোপে জোটের যেসব অস্ত্র মোতায়েন রয়েছে, তা সরিয়ে নিতে হবে। কিন্তু রাশিয়ার দাবি ন্যাটো বা যুক্তরাষ্ট্র কেউই মানেনি। উল্টো মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ‘কোনো কিছু বদলায়নি। কখনো বদলাবেও না।’ যুক্তরাষ্ট্রের এমন একগুঁয়ে অবস্থানের ঘোষণার এক সপ্তাহ পরই ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযানের নির্দেশ দেন পুতিন।
ইউক্রেন সংকট নিয়ে পশ্চিমে যে মন্ত্র জপ করা হচ্ছে, তার সঙ্গে এসব ঘটনার এমন ব্যাখ্যার অনেক ফারাক। পশ্চিমারা এমন একটা ব্যাখ্যা তৈরি করে ফেলেছে, ইউক্রেন সংকটের সঙ্গে ন্যাটোর কোনো সম্পর্ক নেই। এর বদলে পুতিনের আগ্রাসী মনোভাবকে দোষ দিচ্ছে পশ্চিমারা। রাশিয়ার নেতাদের কাছে সম্প্রতি পাঠানো একটি নথিতে বলা হয়েছে, ‘ন্যাটো হলো প্রতিরক্ষামূলক একটি জোট এবং রাশিয়ার জন্য ন্যাটো জোট হুমকি হয়ে দাঁড়ায়নি।’ কিন্তু প্রকাশিত তথ্য-প্রমাণের সঙ্গে এ দাবির কোনো মিল নেই। সর্বশেষ ইউক্রেন যুদ্ধের মূলে ন্যাটোর উদ্দেশ্য বা মতলব নয়, বরং এর মূল কারণ ন্যাটোর কার্যকলাপকে হুমকি হিসেবে দেখেছে মস্কো।
ইউক্রেন সংকট নিয়ে যেসব কারণ তুলে ধরলাম, সেসব নিয়ে বিতর্ক তৈরি করা উচিত নয়। কেননা, গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের শেষ দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক বিশেষজ্ঞরাও এভাবে সতর্ক করেন। তৎকালীন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট গেটস বুখারেস্ট সম্মেলনে জর্জিয়ায় ও ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করার প্রচেষ্টা সুদূর পরাহত বলে মন্তব্য করেন। ওই সম্মেলনে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেল ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করার বিরোধিতা করেন। তাঁদের শঙ্কা ছিল, এটা রাশিয়াকে খ্যাপাবে।
রাশিয়ার নেতাদের কাছে ইউক্রেনে যা ঘটছে তার সঙ্গে তাঁদের ‘ঔপনিবেশিক আকঙ্ক্ষার’ সম্পর্ক সামান্যই। তাদের কাছে এখন প্রধান বিষয় ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার ভবিষ্যৎকে সরাসরি হুমকির মুখে ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো। পুতিন হয়তো রাশিয়ার সামরিক সক্ষমতা, ইউক্রেনের কার্যকর প্রতিরোধ এবং পশ্চিমা দেশগুলোর পাল্টা পদক্ষেপ নিয়ে ভুল বুঝেছেন, কিন্তু এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, পরাশক্তিরা কখনো ছাড় দেবে না। বিশেষ করে যখন তারা ‘অকূলপাথারে’ পড়বে।
তবে এ মুহূর্তে এটা বলা খুবই কঠিন, কোন কোন শর্তে ইউক্রেন যুদ্ধ থামবে। কিন্তু আমরা যদি এই সংঘাতের গভীর কারণটির খোঁজ করতে না পারি, তাহলে এই যুদ্ধের সমাপ্তিও টানতে পারব না। এর আগেই ইউক্রেন ধ্বংসস্তূপ এবং ন্যাটোর সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধও বেধে যেতে পারে।