ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বাধলে বিশ্ববাজারে যে প্রভাব পড়তে পারে

রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন রুখতে মহড়ায় ইউক্রেনের সেনারা
ছবি: এএফপি

রাশিয়া ইউক্রেনে অভিযান চালালে যেমন জানমালের ক্ষতি হবে, তেমনি প্রভাব পড়বে বিশ্ব অর্থনীতিতে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বর্তমান সংকট যদি সংঘাতের দিকে মোড় নেয়, তাহলে গম থেকে শুরু করে জ্বালানির দামে এর প্রভাব পড়বে। অস্থিরতা দেখা দেবে অর্থনীতির অন্যান্য খাতেও।

ইউক্রেন ও পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে রাশিয়ার লড়াই শুরু হলে বিশ্ববাজারে যে প্রভাব পড়তে পারে, তার একটি তালিকা প্রকাশ করেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে

খাদ্যশস্য ও গম

ইউক্রেনে হামলা হলে বাধার মুখে পড়তে পারে কৃষ্ণ সাগর দিয়ে বাণিজ্যিক জাহাজের চলাচল। এর প্রভাব হবে মারাত্মক। এতে এ পথ দিয়ে আমদানি-রপ্তানি করা খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। করোনা মহামারির কারণে এর মধ্যেই বিশ্বের অনেক অঞ্চলের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। ফলে নতুন করে খাদ্যের দাম বাড়লে তা সংকট বাড়াবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

খাদ্যশস্যের অন্যতম চার রপ্তানিকারক দেশ ইউক্রেন, রাশিয়া, কাজাখস্তান ও রোমানিয়া। এই দেশগুলোর পণ্য রপ্তানি হয় কৃষ্ণ সাগরের বিভিন্ন বন্দর দিয়ে। গম রপ্তানির দিকে দিয়ে বিশ্বে শীর্ষে রয়েছে রাশিয়া। ইন্টারন্যাশনাল গ্রেইনস কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ভুট্টা রপ্তানিকারক দেশ হতে যাচ্ছে ইউক্রেন। আর গম রপ্তানিতে দেশটির অবস্থান চতুর্থ।

প্রাকৃতিক গ্যাস ও জ্বালানি তেল

রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করবে, এ আশঙ্কা সত্যি হলে সংকটে পড়বে জ্বালানির বাজার। ইউরোপের ৩৫ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা মেটে রাশিয়া থেকে। দেশটি থেকে বেলারুশ ও পোল্যান্ডের মধ্য দিয়ে পাইপলাইনের মাধ্যমে জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। নর্ড স্ট্রিম ১-এর মাধ্যমে সরাসরি রাশিয়া থেকে জার্মানিতে গ্যাস যায়। অন্যদিকে ইউক্রেনের ভেতর দিয়েও ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ করে মস্কো।

এদিকে নর্ড স্ট্রিম ১-এর পর এবার নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইন নির্মাণের পথে হাঁটছে রাশিয়া ও জার্মানি। নতুন এই প্রকল্প চালু হলে ইউরোপে যেমন রাশিয়ার গ্যাসের আমদানি বাড়বে, তেমনি জ্বালানির ক্ষেত্রে মস্কোর ওপর আরও নির্ভরশীল হয়ে পড়বে এ অঞ্চল। তবে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালালে এই প্রকল্প আর সামনের দিকে এগোবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে বার্লিন।

২০২০ সালে করোনার ধাক্কায় ইউরোপে গ্যাসের চাহিদা পড়ে যায়। এতে গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়ে রাশিয়া। গত বছর চাহিদা বাড়লেও, ক্ষতি পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি দেশটি। ক্ষতি কাটাতে গ্যাসের দাম রেকর্ড পরিমাণ বাড়ানো হয়।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা এলে গ্যাসের দাম আরও বাড়তে পারে। কারণ, এমনটি হলে ইউক্রেন ও বেলারুশের মধ্য দিয়ে পশ্চিম ইউরোপে গ্যাসের সরবরাহ কমে আসবে।

ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত হলে সংকটে পড়তে পারে জ্বালানি তেলের বাজারও। রাশিয়া থেকে উত্তোলন করা জ্বালানি তেল ইউক্রেন হয়ে স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি ও চেক প্রজাতন্ত্রে যায়। ২০২১ সালে ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে দেশগুলোতে ১ কোটি ১৯ লাখ টন অপরিশোধিত তেল রপ্তানি করে মস্কো। যেখানে আগের বছর এর পরিমাণ ছিল ১ কোটি ২৩ লাখ টন।

আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান জে পি মরগান বলছে, সংঘাত শুরু হলে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ১৫০ মার্কিন ডলারে দাঁড়াতে পারে। ফলে বছরের প্রথমার্ধে বৈশ্বিক জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়াতে পারে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশে। একই সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতি দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ৭ দশমিক ২ শতাংশ হতে পারে।

ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রভাব

যুদ্ধের ফলে সংকটে পড়তে পারে পশ্চিমা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো। কারণ, রাশিয়ার সঙ্গে নানাভাবে জড়িয়ে রয়েছে তারা। দেশটির সবচেয়ে বড় জ্বালানি তেল উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান রসনেফটে ১৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ মালিকানা রয়েছে যুক্তরাজ্যের বহুজাতিক জ্বালানি প্রতিষ্ঠান বিপির। প্রতিষ্ঠানটির মোট উত্পাদনের তিন ভাগের এক ভাগ আসে রসনেফট থেকে। এ ছাড়া যৌথভাবে দুই প্রতিষ্ঠানের একাধিক ব্যবসা রয়েছে।

রাশিয়ার প্রথম তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) প্ল্যান্ট ‘সাখালিন-২’-এর ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ মালিকানা রয়েছে যুক্তরাজ্যের আরেক বহুজাতিক জ্বালানি প্রতিষ্ঠান শেলের হাতে। রাশিয়ার যে এলএনজি রপ্তানি করে, তার তিন ভাগের এক ভাগ আসে সাখালিন-২ থেকে। রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রমের সঙ্গেও ব্যবসা রয়েছে শেলের।

যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি প্রতিষ্ঠান এক্সনেরও ব্যবসায়িক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে রাশিয়ায়। সাখালিন-১ তেল ও গ্যাস প্রকল্পের মাধ্যমে সেখানে ব্যবসা করছে মার্কিন এই কোম্পানি। রাশিয়ার এই প্রকল্পে ভারতের রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করপোরেশনেরও অংশীদারত্ব রয়েছে। নরওয়ের প্রতিষ্ঠান ইকুইনর এই মুহূর্তে দেশটিতে সক্রিয়ভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

ইউক্রেনে হামলা হলে এর প্রভাব পড়বে আর্থিক খাতেও। বেশি সমস্যায় পড়তে পারে ইউরোপের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। জে পি মরগানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, অস্ট্রিয়ার রাইফেইসেন ব্যাংক ইন্টারন্যাশনাল, হাঙ্গেরির ওটিপি ও ইউনিক্রেডিট ব্যাংক, ফ্রান্সের সোসায়েটে জেনারেল ব্যাংক, নেদারল্যান্ডসের আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইএনজির ব্যবসা রয়েছে রাশিয়ায়। এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মুনাফার একটি অংশ আসে রাশিয়া থেকে।

পশ্চিমা দেশগুলো থেকে রাশিয়ার ঋণ নেওয়ার পরিমাণও কম নয়। ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ার ব্যাংকগুলো থেকে দেশটিতে যথাক্রমে ২৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার ও ১৭ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়া হয়েছে। এরপরই যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৬ বিলিয়ন, জাপান থেকে ৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন ও জার্মানির ব্যাংগুলো থেকে ৮ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেয়েছে রাশিয়া।

আর্থিক ও জ্বালানি খাতের বাইরেও নানা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে রাশিয়ার সঙ্গে। এর মধ্যে রয়েছে ফ্রান্সের রেনল্ট, জার্মানির মেট্রো এজি ও ডেনমার্কের কার্লসবার্গের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো। যুদ্ধ শুরু হলে এসব ব্যবসা ক্ষতির মুখে পড়বে।