ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে রুশ বাহিনীর হামলার দিনই নগরী ছেড়েছিলেন মো. আবদুল আউয়াল। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী, দুই সন্তান। ৮ থেকে ১০ ঘণ্টার দূরত্বের পোল্যান্ড সীমান্ত। কিন্তু সীমান্তে পৌঁছে টানা তিন দিন অপেক্ষার পর পোল্যান্ডে ঢুকতে পেরেছিলেন গত ২৬ ফেব্রুয়ারি।
আবদুল আউয়াল বলছিলেন, ‘তিন দিন হিমাঙ্কের নিচের তাপমাত্রায় প্রচণ্ড কষ্টে সময় কেটেছে আমাদের সবার। বাচ্চা দুটোর জন্য সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছিল। প্রাণের ভয়, ক্ষুধা, শীত—সব মিলিয়ে যুদ্ধের কষ্ট কী, বুঝেছি।’
তবে অনেক কষ্টের পর পোল্যান্ডে এসে মন ভালো করা সময় কাটাচ্ছেন ঢাকার ধামরাইয়ের এই অধিবাসী। এক পোলিশ দম্পতির মহানুভবতায় সব কষ্ট ধুয়েমুছে গেছে। পোল্যান্ডে এসে মানবিকতার এক সৌন্দর্য দেখেছেন তিনি। সেই গল্পই শোনালেন প্রথম আলোকে।
সেই ১৯৯৬ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেই ইউক্রেনের কিয়েভে গিয়েছিলেন আউয়াল। পরে সেখানে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় জলতাইকুলাস আগ্রানম ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক হন। পরে সে দেশেই ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর স্ত্রী বাংলাদেশি রত্না খাতুন। দুই মেয়ে আজমিন আউয়াল ও আমরিন আউয়াল। কিয়েভে এ পরিবারের বাস ছিল উলিৎসা-কিবালছিসায়।
গত বৃহস্পতিবার ভোরে রুশ বাহিনীর হামলা শুরু হলে আউয়াল মনস্থ করেন, নগর ছাড়বেন। এক বন্ধুর গাড়িতে দুই পরিবার পোল্যান্ড সীমান্তের কুবেলের দিকে। সেখানে যাওয়ার পথে যত বিপত্তি।
আউয়াল বলছিলেন, ‘রাস্তায় হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষ। সবাই প্রাণভয়ে সীমান্তের দিকে ছুটছে। গাড়ির দীর্ঘ সারি। সেই সারি আর শেষ হয় না। তিন দিন ধরে রাস্তা আর সীমান্তের কাছে গিয়ে কাটল সময়।’
পোল্যান্ড আউয়ালের কাছে অচেনা দেশ নয় একেবারে। কর্মসূত্রে মাসে বার দুয়েক সেখানে যেতে হতো। কিন্তু কোনো আত্মীয়স্বজন তো নেই। সীমান্ত পার হওয়ার পর তাই দিশাহারা লাগল আউয়ালের। কোথায় যাবেন, কী করবেন পুরো পরিবার নিয়ে! ঠিক সীমান্তেই পোল্যান্ডের কিছু স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন পেলেন। তারা জানতে চাইল কী চাই এ পরিবারের। প্রায় নিঃস্ব পরিবারটির চাহিদা অনুযায়ী সবকিছু কিনে দেয় তারা।
আউয়ালের কথায়, ‘টুথব্রাশ থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সবকিছুই আমাদের কিনে দিল ওরা। সব মিলিয় দুই হাজার ডলারের বেশি হবে। এত জিনিসপত্র কিনে দিয়েছে যে এসব দিয়ে আমাদের অনেক দিন চলবে।’
এসব জিনিস না হয় পাওয়া গেল কিন্তু কোথায় থাকবেন। মুশকিল আসান করলেন আবার এ স্বেচ্ছাসেবকেরাই। জানালেন, তাঁদের জন্য কাছের হেলম শহরে আছে থাকার বন্দোবস্ত। গাড়িতে করে পোলিশ দম্পতি অ্যালেক্স এলেন ও মনিকা জাব্রাশিনা দম্পতির বাড়ির অতিথি হলো যুদ্ধে প্রাণভয়ে পালানো পরিবারটি। সে পরিবার তাদের বাড়ির একটি অংশ ছেড়ে দিয়েছে আউয়াল পরিবারের কাছে। এই কদিনে এমন পরিস্থিতি হয়ে গেছে, যেন কত দিনের চেনা।
আউয়াল জানান, অ্যালেক্স-মনিকা দম্পতির দুই সন্তান দূরে থাকেন। দুজনই প্রতিষ্ঠিত। অ্যালেক্স হাইস্কুলের শিক্ষক। আর মনিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী। এ দম্পতি আউয়ালদের বলে দিয়েছেন, যত দিন ইচ্ছা তত দিন তাঁরা থাকবেন, খাবেন। কোনো তাড়া নেই। আউয়ালের দুই মেয়েকে কাছে টেনে নিয়েছেন অ্যালেক্স-মনিকা। ওরা যেন নতুন বন্ধু পেয়েছে।
আউয়াল বলছেন, ‘মানুষের ভালোবাসা যে কী জিনিস, তা এ পরিবারের কাছে না এলে বুঝতাম না। এত হৃদয়বান হয় মানুষ, তা এই সংকটের সময় টের পেলাম।’
অ্যালেক্স ও মনিকাদের বাড়িতে আসা এই নতুন অতিথিদের স্বাগত জানাতে তাঁদের প্রতিবেশীরাও আসছেন বার কয়েক। আর এসব প্রতিবেশী যত খাদ্যসামগ্রী দিয়েছেন, তা তিন মাসে ফুরাবে না।
আউয়ালদের পরিবার অবশ্য এখানে আর থাকছে না। তারা আজ বুধবারই পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ চলে যাচ্ছে। এরপর চলে যাবে যুক্তরাজ্যে। সেখানে আউয়ালের ভাই থাকেন। সেখানে গিয়েই কিছুদিন থাকবে।
আউয়ালের কথা, ‘এক অনিশ্চিত যাত্রার পথে আমরা। ভবিষ্যৎ এখনো অজানা। কিন্তু যে ভালোবাসা এই পোলিশ দম্পতির কাছে আমরা পেয়েছি, তা আনন্দের উৎস হয়ে রইবে সারা জীবন।’