ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ

ইউক্রেনে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, ধ্বংসস্তূপ মারিউপোল

রুশ বিমানবাহিনীর মিগ-৩১ যুদ্ধবিমানে বসানো হয়েছে কিনঝাল হাইপারসনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র
ছবি: এএফপি

ইউক্রেনে হামলায় বিশেষ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করল রাশিয়া। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় গতকাল শনিবার জানিয়েছে, ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলে ইভানো-ফ্রানকিভস্ক অঞ্চলে একটি অস্ত্র সংরক্ষণাগারে তারা হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে।

এদিকে ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মারিউপোল শহরের কেন্দ্রে পৌঁছেছেন রুশ সেনারা। এ শহরের সড়কে দুই পক্ষের মধ্যে লড়াই চলছে। এতে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে আবারও আলোচনার ডাক দিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তিনি বলেছেন, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় বসতে চান তিনি।

রাশিয়ার আধুনিক অস্ত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র। এর নাম কিনঝাল। এ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েই ইউক্রেনে হামলা চালানো হয়েছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর এই প্রথম কিনঝাল ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করল রাশিয়া। এ ছাড়া এর আগে কোনো যুদ্ধে এ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের কথা স্বীকার করেনি দেশটি। বলা হচ্ছে, কোনো যুদ্ধে বিশ্বে এই প্রথম হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হলো।

কিনঝাল ক্ষেপণাস্ত্রটি ২০১৮ সালে জনসমক্ষে আনে রাশিয়া। বিবিসির তথ্য অনুসারে, কিনঝালের গতি শব্দের গতির চেয়ে ৫ গুণ বেশি। তবে এএফপি জানিয়েছে, এর গতি শব্দের গতির চেয়ে ১০ গুণ বেশি। বাতাসে শব্দের বেগ প্রতি সেকেন্ডে ৩৪৩ মিটার। এ তথ্য বিবেচনায় নিলে ক্ষেপণাস্ত্রটি সেকেন্ডে ৩ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার যেতে পারে।

কিনঝাল পারমাণবিক বোমা বহন করতে পারে। দুই হাজার কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম এ অস্ত্র দিক পরিবর্তন করতে পারে। ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ঠেকাতে যে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়, তা-ও ফাঁকি দিতে পারে।

ইউক্রেনে এ হামলা প্রসঙ্গে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইগর কোনাশেনকভ বলেন, ইউক্রেনের ভূগর্ভস্থ ওই অস্ত্র সংরক্ষণাগারে ক্ষেপণাস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিল।

এদিকে ইভানো-ফ্রানকিভস্ক অঞ্চলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কথা নিশ্চিত করেছেন ইউক্রেনের বিমানবাহিনীর এক কমান্ডার। তিনি বলেন, ওই অঞ্চলের দেলিয়াতিন এলাকায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়েছে। তবে এ নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলেননি তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও এ হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।

আধুনিক অস্ত্র নিয়ে বরাবরই গর্ব করে রাশিয়া। এ অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়ে পুতিন বলেছিলেন, বিশ্বজুড়ে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণে নেতৃত্ব দিচ্ছে তাঁর দেশ।

কিনঝাল ছাড়াও শুক্রবার বন্দরনগরী ওডেসায় ব্যাসশন ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে রাশিয়া। রুশ মুখপাত্র বলেন, এ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর রেডিও যোগাযোগব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।

মারিউপোলের ধ্বংসস্তূপে রুশ সেনারা

ইউক্রেনের বন্দরনগরী মারিউপোলে হামলা অব্যাহত রেখেছে রাশিয়া। এ শহরের মেয়র ভাদিম বোইচেঙ্কো বলেন, শহরের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছেছেন রুশ সেনারা। এ শহরের সিংহভাগ ভবন ধসে গেছে। এসব ধসে যাওয়া ভবনের বেসমেন্টে আটকা পড়েছেন শত শত মানুষ। মেয়র বলেন, এ শহরে রুশ সেনাদের ট্যাংক ঢুকেছে; তাঁদের সঙ্গে গোলাবারুদ রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের চেয়ে তাঁদের সেনাবহর অনেক বড়।’

মারিউপোল শহরের অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ ও পানির সরবরাহ বন্ধ রয়েছে, অনেকেই খাবার পাচ্ছেন না। এমন নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে প্রায় তিন লাখ মানুষ। সেখানকার এ পরিস্থিতিকে ‘মধ্যযুগীয়’ বলে উল্লেখ করেছেন ইউক্রেনের আইনপ্রণেতা দিমিত্র গুরিন। বিবিসিকে তিনি বলেন, এ শহরে তাঁর মা-বাবাও আটকা পড়েছেন।

মারিউপোলের পরিস্থিতি নিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে গতকাল কথা বলেছেন লুক্সেমবার্গের প্রধানমন্ত্রী জাভিয়ার বেটেল। তিনি বলেন, মারিউপোলের পরিস্থিতি বেশি খারাপ। এ পরিস্থিতি মেনে নেওয়ার মতো নয়।

গতকাল ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, হামলার প্রথম তিন সপ্তাহে ১৪ হাজার রুশ সেনা প্রাণ হারিয়েছেন। এ ছাড়া রুশ সেনা বহনকারী ১ হাজার ৪৭০টি যান, ৬০টি ট্যাংক, ১০০টি যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার ধ্বংস হয়েছে। তবে পশ্চিমা দেশগুলোর গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া তথ্য অনুসারে, প্রায় ৭ হাজার রুশ সেনা নিহত হয়েছেন। আর ১৪ থেকে ২১ হাজার সেনা আহত হয়েছেন। জাতিসংঘের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ইউক্রেনে এ পর্যন্ত ৬৪টি শিশুসহ ৮৭৪ জন বেসামরিক মানুষ মারা গেছেন। হামলার কারণে ১৫ লাখ শিশু ইউক্রেন ছেড়েছে।

পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চান জেলেনস্কি

ইউক্রেনে ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে দুই পক্ষের মধ্যে। তবে আলোচনায় সাফল্য আসেনি। আলোচনার ব্যাপারে পুতিনেরও যে খুব বেশি আগ্রহ নেই, সেটা স্পষ্ট করেছেন সাবেক রুশ প্রধানমন্ত্রী মিখাইল কাসিয়ানভ। তিনি বলেন, শান্তি আলোচনার বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছেন না পুতিন।

এ পরিস্থিতিতে পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চাইছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। গতকাল তিনি বলেন, ভুল করে হামলা চালিয়ে রাশিয়া যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, তা লাঘবের জন্য আলোচনাই একমাত্র সুযোগ।

জেলেনস্কি বলেন, এখন সাক্ষাতের সময়, এখন আলোচনার সময়। এখন সময় ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা অক্ষুণ্ন রাখার এবং ইউক্রেনের ন্যায়বিচার পাওয়ার। অন্যথায় রাশিয়ার এমন ক্ষয়ক্ষতি হবে, যা পুনরুদ্ধারে কয়েক প্রজন্ম লেগে যাবে।

তবে ইউক্রেনে অভিযানের ব্যাপারে এখনো অনড় অবস্থানে পুতিন। তিনি বলেন, ‘আমরা জানি, আমাদের কী করতে হবে এবং এ জন্য কতটা মূল্য দিতে হবে। আমরা আমাদের সব পরিকল্পনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করব।’