বিবিসির প্রতিবেদন

ইউক্রেনে যুদ্ধে যেতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন রাশিয়ার সেনারা

ভিক্টোরি ডের কুঁচকাওয়াজের মহড়ায় রাশিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকজন সদস্য। মস্কো, ৭ মে ২০২২
ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান এরই মধ্যে ১০০ দিন পার করেছে। এত দিনের লড়াইয়ে ইউক্রেন যেমন ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছে, প্রতিপক্ষের ক্ষতিও তার চেয়ে কিঞ্চিত কম নয়। যুদ্ধে এখন পর্যন্ত রাশিয়ার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে ঢের।

এই প্রশ্ন ওঠার মধ্যেই রাশিয়ার বেশকিছু সেনা লড়াই করতে ইউক্রেনে ফেরত যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। রাশিয়ার মানবাধিকারবিষয়ক আইনজীবী ও কর্মীদের মতে, অস্বীকৃতি জানানোর  কারণ, ইউক্রেনে রুশ অভিযান শুরুর পর সম্মুখ সমরে এই সেনাদের অর্জন করা অভিজ্ঞতা।

ইউক্রেনের বুচা শহরে রাশিয়ার বিধ্বস্ত সাঁজোয়া যান ও ট্যাংকের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন ইউক্রেনের সেনারা

ইউক্রেনে লড়াইয়ের জন্য ফেরত যেতে অস্বীকৃতি জানানো রুশ সেনাদের একজন সের্গেই (প্রকৃত নাম নয়)। তিনি বলছিলেন, ‘আমি অন্যকে মারতে ও নিজেও মরতে (ইউক্রেনে ফেরত যেতে) চাই না।’ চলতি বছরের শুরুর দিকে ইউক্রেনে পাঁচ সপ্তাহ যুদ্ধে কাটিয়েছেন তিনি।

সের্গেই এখন রাশিয়ায়। ইউক্রেনে সম্মুখ সমরে ফেরত যাওয়া এড়াতে তিনি আইনজীবীর পরামর্শ নিচ্ছেন। এ রকম আইনি পরামর্শ নিতে আইনজীবীদের দ্বারস্থ হওয়া শত শত রুশ সেনার একজন তিনি।

সের্গেই বলেন, ইউক্রেনে লড়াই করতে গিয়ে তাঁর যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে এখন তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।

সের্গেইয়ের চোখে-মুখে বিরক্তির স্পষ্ট ছাপ। তিনি বলছিলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম, আমরা হলাম রাশিয়ার সেনা। আমরাই বিশ্বের সেরা।’ আরও বলছিলেন, রুশ সেনাদের আত্মবিশ্বাস এতটাই ছিল যে অন্ধকারে দেখার (নাইট ভিশন) যন্ত্রের মতো অপরিহার্য যুদ্ধসরঞ্জাম ছাড়াই তাঁরা ইউক্রেনে অভিযানে যাওয়ার আশা করছিলেন।

সের্গেইয়ের ভাষায়, ‘আমরা ইউক্রেনে ছিলাম চোখবাঁধা বিড়ালছানার মতো। সেনাবাহিনীর কাজকর্ম আমাকে অবাক করে দিয়েছিল। আমাদের যুদ্ধসরঞ্জাম দিয়ে তারা বেশি খরচ করতে রাজি না। কেন যে সেগুলো (প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম) দেওয়া হলো না?’

ইউক্রেনের সুমি অঞ্চলে রুশ বাহিনীর বিধ্বস্ত ট্যাংক

রাশিয়ায় ১৮ থেকে ২৭ বছর বয়সী তরুণদের এক বছরের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়। সে অনুযায়ী সের্গেইকেও সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়েছিল। কয়েক মাস পর দুই বছরের জন্য সেনাবাহিনীতে কাজ করতে চুক্তি করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এই চুক্তির অধীন সেনা সদস্যদের দেওয়া হয় বেতন।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে সের্গেইকে ইউক্রেন সীমান্তের কাছে পাঠানো হয়। বলা হয়েছিল, সামরিক মহড়ার জন্য পাঠানো হচ্ছে। এক মাস পরই গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। সের্গেইসহ বাকি সেনাদের সীমান্ত পেরিয়ে ইউক্রেনে প্রবেশ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এর পরপরই সের্গেইয়ের ইউনিটের সেনা সদস্যরা হামলার মুখে পড়েন।

সের্গেই এখন নিজের দেশ রাশিয়ায়। ইউক্রেনে সম্মুখ সমরে ফেরত যাওয়া এড়াতে তিনি আইনজীবীর পরামর্শ নিচ্ছেন। এ রকম আইনি পরামর্শ নিতে আইনজীবীদের দ্বারস্থ হওয়া শত শত রুশ সেনারই একজন তিনি।

সেই সময়ের ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন সের্গেই। বলেন, ইউক্রেনে প্রবেশের পর সন্ধ্যায় তাঁরা একটি পরিত্যক্ত খামারে বিরতি নেন। তখন তাঁদের কমান্ডার বলেন, ‘তোমরা হয়তো এতক্ষণে বুঝতে পেরেছ, এটা কোনো মশকরা না।’ আর এভাবে (অপ্রস্তুত অবস্থায়) যুদ্ধের ময়দানে নামার ইঙ্গিত দেন কমান্ডার।

কমান্ডারের এমন বক্তব্যে বাক্‌রুদ্ধ হয়ে পড়েন সের্গেই। তাঁর ভাষায়, ‘আমার মাথায় প্রথমেই এল, আসলেই কি এমনটা ঘটতে চলেছে (যুদ্ধে নামতে হচ্ছে)।’ বলেন, ইউক্রেনে তাঁদের ওপর একটানা গোলা হামলা চালানো হচ্ছিল। রাতে বিরতি নেওয়ার সময়ও নিস্তার পাচ্ছিলেন না তাঁরা। তাঁদের ইউনিটে ৫০ জন ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ১০ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন আরও ১০ জন। ইউনিটের সবার বয়স ছিল ২৫ বছরের নিচে।

ইউক্রেনের উত্তরাঞ্চলে অভিযান শুরুর চার দিনের মাথায় ভেঙে পড়ে সের্গেইয়ের সঙ্গে থাকা সেনাবহর। সেদিন তাঁরা একটি সেতু পার হচ্ছিলেন। হঠাৎ সেখানে বিস্ফোরণ হয়। এতে বহরের সামনের দিকে থাকা সেনা সদস্যরা নিহত হন।

আরেক দিনও একই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় সের্গেইকে। সেদিন তাঁর সামনে সেনা সদস্যদের বহনকারী একটি গাড়িতে হামলা চালানো হয়। সের্গেইয়ের ভাষায়, ‘গ্রেনেড লঞ্চার বা অন্যকিছু দিয়ে হামলাটা চালানো হয়েছিল। এতে গাড়িতে বিস্ফোরণ হয়ে আগুন ধরে যায়। সেটির ভেতরে সেনা সদস্যরা ছিলেন। (প্রাণে বাঁচতে) আমরা আমাদের গাড়ি নিয়ে গুলি চালাতে চালাতে পাশ কাটিয়ে গেলাম। পেছনে ফিরেও তাকাইনি।’

সের্গেইয়ের সেনাবহরকে ইউক্রেনের গ্রামাঞ্চলের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। অভিযোগ করে তিনি বলেন, রুশ সেনাবাহিনীতে আছে কৌশলের অভাব। তাঁদের সহায়তা করতে বাড়তি সেনারা আসতে পারেননি। বড় শহর দখলের জন্য যে পরিমাণ যুদ্ধসরঞ্জাম প্রয়োজন তা-ও তাঁদের দেওয়া হয়নি। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা হেলিকপ্টারের সহায়তা ছাড়াই সারি বেঁধে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল, আমরা কুঁচকাওয়াজ করতে করতে যাচ্ছি।’

সের্গেই মনে করেন, তাঁর কমান্ডাররা খুব দ্রুত ইউক্রেনের প্রধান শহর ও সেনাঘাঁটিগুলো দখলের পরিকল্পনা করেছিলেন। ভেবেছিলেন, সহজেই ইউক্রেনীয়রা আত্মসমর্পণ করবেন। তিনি বলেন, ‘আমরা রাতে কম সময় বিরতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের পেছনে সুরক্ষার জন্য কাউকে রেখে আসিনি। ফলে চাইলেই পেছন থেকে এসে আমাদের ওপর হামলা চালানো যেত।’

ঠিকই এই ভুলের কারণে তাঁর ইউনিটের অনেক সেনা প্রাণ হারিয়েছেন বলে মনে করেন সের্গেই। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি ধীরে ধীরে এগোতাম, যদি রাস্তায় স্থলমাইন আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখতাম, তাহলে অনেকের মৃত্যু এড়ানো যেত।’

ইউক্রেনে রুশ সেনাদের প্রয়োজনের তুলনায় কম যুদ্ধসরঞ্জাম দেওয়ার যে অভিযোগ সের্গেই করেছেন, তার সত্যতা উঠে এসেছে ফাঁস হওয়া বিভিন্ন ফোনকলে। রুশ সেনারা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের কাছে কলগুলো করেছিলেন বলে দাবি করা হয়েছে। ফোনকল ফাঁস হওয়ার পেছনে হাত ছিল ইউক্রেনের নিরাপত্তা বাহিনীর। সেগুলো আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রচার করা হয়।

গত এপ্রিলে রাশিয়ার সীমান্তের ভেতর একটি ক্যাম্পে ফেরত আনা হয় সের্গেইকে। ইউক্রেনের উত্তরাঞ্চল থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় রুশ সেনাদের। এদিকে মস্কোর নতুন লক্ষ্য অনুযায়ী পূর্ব ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ নিতে সেখানে রাশিয়ার সেনাশক্তি বাড়ানো হয়। এর পরের মাসেই আবার ইউক্রেনে ফিরে যেতে নির্দেশ দেওয়া হয় সের্গেইকে। তবে রাজি হননি তিনি।

বিবিসিকে সের্গেই বলেন, ইউক্রেনে যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে যেতে তাঁর ওপর কোনো চাপ দেওয়া হয়নি। তবে যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার পর ঊধ্বর্তন কর্মকর্তাদের প্রতিক্রিয়া ভাবিয়ে তুলেছিল তাঁকে। এর জেরে তিনি আইনি পরামর্শ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

এরপর সমমনা দুই সেনা সদস্যকে নিয়ে এক আইনজীবীর দ্বারস্থ হন সের্গেই। ওই আইনজীবী তাঁদের অস্ত্র জমা দিয়ে ইউনিট হেডকোয়ার্টারে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, সের্গেইসহ বাকি দুই সেনার চিঠি লিখে জানানো উচিত তাঁরা ‘নৈতিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত’ এবং ইউক্রেনে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবেন না।

চিঠি দেওয়ার পর সের্গেইকে জানানো হয়, নিজ ইউনিটে ফিরে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এভাবে চলে গেলে পদত্যাগ হিসেবে ধরে নেওয়া হবে। ফলে তাঁকে সাজার মুখে পড়তে হবে।

ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার একটি সাঁজোয়া যানে বসে আছেন সেনারা

রাশিয়ার মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবী অ্যালেক্সি তাবালভের ভাষ্যমতে, রাশিয়ায় সেনা সদস্যদের চুক্তির মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিজ ইউনিটে থাকতে ভয়ভীতি দেখান কর্মকর্তারা। তবে তিনি এ–ও বলেন, রাশিয়ার সামরিক আইন অনুযায়ী, কোনো সেনা যদি না চান, তবে যুদ্ধে যাওয়ার নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করতে পারেন।

সের্গেইয়ের মতো রুশ সেনাদের যুদ্ধক্ষেত্রে ফেরত যেতে অস্বীকৃতি জানানো কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয় বলে মনে করেন কনফ্লিক্ট ইন্টেলিজেন্স টিমের সম্পাদক রুসলান লেভিয়েভ। ইউক্রেনে রুশ সেনা সদস্যদের অভিজ্ঞতা নিয়ে কাজ করছে তাঁর টিম।

রুসলান লেভিয়েভ বলেন, রাশিয়ার চুক্তিবদ্ধ সেনা সদস্য যাদের যুদ্ধ শুরুর প্রাথমিক পর্যায়ে ইউক্রেনে পাঠানো হয়েছিল, তাঁদের একটা অংশ সেদেশে আবারও লড়াই করার জন্য যেতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন।

রাশিয়ার কিছু নিরপেক্ষ গণমাধ্যমও এপ্রিলের শুরু থেকে ইউক্রেনে পুনরায় যুদ্ধে যেতে শত শত সেনার অস্বীকৃতি জানানোর ওপর খবর প্রকাশ করেছে।

সের্গেই যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরতে না চাইলেও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি এড়াতে সেনাবাহিনীর মর্যাদাপূর্ণ কাজ শেষ করতে চান। এর অর্থ দাঁড়াবে, লড়াইয়ের জন্য ইউক্রেনে যেতে তাঁর অস্বীকৃতির চিঠিটি গৃহীত হলে তিনি এ নিশ্চয়তা পাবেন না যে দায়িত্ব পালনকালে তাঁকে ইউক্রেনে ফেরত যেতে হবে না।

সের্গেই বিবিসিকে বলেন, ‘আমি দেখছি, যুদ্ধ চলবে। এটা এখনই শেষ হবার নয়। যে কয়টি মাস আমি সেখানে কাটিয়ে এসেছি, সেই সময়ে সবচেয়ে খারাপ ঘটনাসহ যেকোনো কিছুই আমার সঙ্গে ঘটতে পারত।’

ভাষান্তর: শেখ নিয়ামত উল্লাহ