ইউক্রেনে এখন যেমন আছেন বাংলাদেশিরা

কিয়েভের রাস্তায় চলছে গাড়ি। আজ শুক্রবার তোলা
ছবি: কিয়েভপ্রবাসী হাসিনুল হকের সৌজন্যে

হাসিনুল হক থাকেন ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের নিভকি এলাকায়। এটি রাজধানীর প্রায় কেন্দ্রস্থলের একটি জায়গা। যুদ্ধের ডামাডোলে এ নগরীর জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি যখন চলে গেছেন, হাসিনুল সেই সময়েও কিয়েভ ছাড়েননি। তিনি মনে করেন, আর এ নগর ছাড়ার মতো অবস্থা হবে না; বরং পরিস্থিতি দিন দিন ভালো হচ্ছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত ১২টার পর মুঠোফোনে কথা হয় হাসিনুলের সঙ্গে। বলছিলেন, ‘সপ্তাহ খানেক আগেও বাড়ির পাশের পার্কে গেলে মানুষজনের তেমন দেখা মিলত না। এখন পার্কে গিয়ে মানুষজনের দেখা মেলে। বাড়ির গ্যারেজে আগে মাত্র দু-চারটি গাড়ি থাকতে দেখতাম। কয়েক দিন ধরে দেখছি, অন্তত ২০টি গাড়ি। মনে হচ্ছে, লোকজন এখন ফিরে আসছে।’

হাসিনুল হকের গ্রামের বাড়ি চুয়াডাঙ্গায়। আজ ৩২ বছর ধরে আছেন কিয়েভে। চাকরি করতেন, এখন ব্যবসা করেন। বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে একটি শপিং মলে তিনটি দোকান তাঁর। সেগুলো ভাড়া দিয়েছেন। তবে মার্চ মাসে দোকানগুলো প্রায় বন্ধই ছিল। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ইউক্রেনে রুশ আক্রমণ তীব্র হয়। সে সময় জীবনযাত্রা প্রায় অচল হয়ে পড়ে কিয়েভে।

কিয়েভে আছেন বাংলাদেশি হাবিবুর রহমান

তবে হাসিনুল যেখানে থাকেন, সেখানে কোনো হামলা হয়নি। তাঁর দোকানগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। যাঁদের দোকান ভাড়া দিয়েছিলেন, তাঁরাও শহরে ফিরে এসেছেন। তবে মার্চে দোকানের ভাড়া তাঁরা দেননি। কিয়েভ সিটির পক্ষ থেকেই দোকানমালিকদের এ অনুরোধ করা হয়। আর সবাই তা রক্ষারও চেষ্টা করছেন। অবশ্য এতে তাঁদেরও কিছুটা লাভ আছে। কারণ, প্রতি মাসে ভাড়ার কর বাবদ যে অর্থ সিটি কর্তৃপক্ষকে দিতে হয় তা রেয়াত দেওয়া হয়েছে। এই এপ্রিল মাসেও তাঁদের কোনো কর দিতে হবে না।

হাসিনুল বলছিলেন, ‘সিটি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাদের ধারণা, এপ্রিলের মধ্যেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে। তারা নোটিশে বলেছে, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরের মাস অর্থাৎ মে মাসেও তাঁদের কর দিতে হবে না।’

স্ত্রী ও এক মেয়েকে নিয়ে হাসানুলের সংসার। তিন দশকের বেশি সময় ধরে আছেন যে শহরে তার মায়া কাটাতে পারেননি। তাই শহর ছাড়া হয়নি বলে জানান। তাঁর বাড়ির কাছের গাস্তোমেল এয়ারপোর্টে রুশ বাহিনী হামলা করেছে। এতে ভড়কে যাননি। সপ্তাহ দু-এক ধরে পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত ছিল। মাঝেমধ্যে গোলাবর্ষণের আওয়াজ পাওয়া যেত। এখন তা অনেকটা কমে গেছে বলে জানান তিনি।

যুদ্ধবিধ্বস্ত কিয়েভ এখন অনেকটাই জেগে উঠেছে

বাড়ির নিচে বাংকার আছে। সেখানে জরুরি পরিস্থিতিতে চলে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে হাসিনুল বা তাঁর পরিবারের কেউ সেখানে একবারের জন্যও যাননি। এখন ভয় একেবারে কেটে গেছে। আর যুদ্ধদিনে আশপাশের প্রতিবেশী ও সরকারের ভূমিকায় মুগ্ধ হাসানুল। বললেন, ‘একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা আরও বেশি করে দেখলাম যুদ্ধের সময়। সরকারও সাধ্যমতো করেছে নাগরিকদের জন্য।’

এখন একটি বিষয়ে শুধু বেশি কড়াকড়ি বলে জানান হাসিনুল। তা হলো জনপরিসরের ছবি তোলা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা সৈনিক ও স্বেচ্ছাসেবকেরা তো বটেই, গণমাধ্যমের ঘোষণায় বারবার ছবি না তুলতে এবং তা প্রচার না করতে অনুরোধ করা হচ্ছে। তাঁর ধারণা, নাগরিকদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই এমন নির্দেশ।

ছবি তোলার ক্ষেত্রে এ কড়াকড়ির কথা জানালেন কিয়েভের আরেক বাসিন্দা মোহাম্মদ হাবিবুর রহমানও। তিনিও এ শহরে আছেন তিন দশকের বেশি সময় ধরে। বিয়ে করেছেন ইউক্রেনের নাগরিককে। তাঁদের দুটি সন্তান। থাকেন কিয়েভের নিপ্রোস্কি এলাকায়। তাঁর বড় ছেলে মোহাম্মদ তাইয়েব ইউক্রেনের হয়ে যুদ্ধে লড়ছেন। ছেলেটি এখনো বাড়ি ফেরেনি। তবে সে সুস্থ আছে বলে জানান হাবিবুর। তাঁর বাড়ি বাংলাদেশের গাজীপুরে।

কিয়েভের একটি পার্ক

হাবিবুর যেখানে থাকেন এর কিছুদূরেই ইউক্রেনের পার্লামেন্ট ভবন। তাই এ এলাকায় নিরাপত্তাব্যবস্থা একটু বেশি। এ এলাকাতেও কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি বলে জানান তিনি। তবে বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে লুর্কানেস্কো মেট্রোতে রুশ বাহিনী হামলা চালিয়েছিল বলে তিনি জানান।

কিয়েভের যেখানে হাবিবুর থাকেন সেখানে হামলার ঘটনা না ঘটলেও যেখানে ঘটেছে সেখানে এখন পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার কাজ চলছে বলে জানান তিনি। এ কাজ করতে স্বেচ্ছাসেবীদের আহ্বান জানানো হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে।

হাবিব বলছিলেন, ‘অনেকেই এ কাজে গেছে। আমাকে বললেও যেতে পারি। আসলে তীব্র লড়াই এখন আর নেই। অনেকটা শান্ত। যুদ্ধের পর পুনর্গঠনের যেমন কাজ হয়, তেমন কিছু কাজ দেখছি।’

নগরীর ত্রাইসিনা এলাকায় কাপড়ের ব্যবসা আছে হাবিবুরের। তাঁর দোকানসহ শপিং মলটি এখনো অক্ষত। হাতে জমা যে টাকা আছে তা দিয়েই এখন চলছেন। পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক না এলে কী করবেন, এ প্রশ্নের জবাবে হাবিব বললেন, ‘দুই ভাই ইতালি আছে। তারা সহযোগিতা করবে। এ ছাড়া বন্ধুবান্ধব আছে। সমস্যা হবে না।’

কিয়েভ নগরে সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ শ বাংলাদেশি আছে বলে অনুমান করেন মাহবুব আলম। তবে এখন ৩০ জনের মতো আছেন বলে জানান তিনি। মাহবুব উচ্চশিক্ষার জন্য ১৯৮২ সালে ইউক্রেনে যান।এরপর শিক্ষা শেষ করে সেখানেই থেকে যান। এখন ইউক্রেনে বাংলাদেশের অনারারি কনস্যুলেটের উপদেষ্টা হিসেবে আছেন। পোল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে কাজ করেন তিনি।

মাহবুব জানালেন, যুদ্ধের পর কিয়েভ ছেড়ে লিভি্ব শহরে এসেছেন তিনি। কিয়েভে তাঁর বাড়ি ও কর্মস্থল হামলামুক্ত আছে এখনো। লিভিভের একটু দূরে অবস্থিত বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ ও মহড়া কেন্দ্র, বিমানবন্দরের পার্শবর্তী উড়োজাহাজ রক্ষনাবেক্ষণ কারখানা ও লিভিব শহরের একটি তেলের ডিপোতে রুশ বাহিনী রকেট হামলা চালিয়েছে যার ফলে ঐ এলাকায় প্রচুর ধ্বংস হওয়া ছাড়া পঞ্চাশের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে ও আহতের সংখ্যা দেড় থেকে দুইশর মতো।

এখন যুদ্ধ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলেও জানান মাহবুব আলম। তিনি মনে করেন, ইস্তাম্বুলে রাশিয়া ও ইউক্রেনের দ্বিপক্ষীয় শেষ আলোচনার পর ক্ষীণ আশার আলো দেখা গেছে। যদিও রুশ প্রেসিডেন্টের প্রেস সেক্রেটারি পেসকভের সাম্প্রতিক বিবৃতি ও তাঁদের সামরিক বাহিনীর ক্রমাগত আগ্রাসী ভূমিকা সে আশার আলোর ওপরে ছাই ঢেলে দিল বলেই মনে হচ্ছে।

মাহবুব আলম বলেন, ‘যেকোনো যুদ্ধ একসময় শেষ হয়; হতেই হয়। সেই দিনটি দ্রুত আসুক। ইউক্রেনের মানুষ তার নিজ বাসভূমে ফিরে এসে শান্তিতে আগের মতোই জীবন যাপন করুক। মনে হয় সুস্থ মস্তিষ্কের শান্তিপ্রিয় সবার চাওয়া এটাই।’