রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ও রকেটের আঘাতে কেঁপে উঠছে ইউক্রেনের বিভিন্ন শহর। প্রাণ বাঁচাতে সেসব শহর থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন বাসিন্দারা। হামলার মুখে অনেকেই আবার আটকা পড়ছেন। তাঁদের কাছে সহায়তা পৌঁছে দিতে হিমশিম খাচ্ছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। এমনই পরিস্থিতিতে শহরগুলোতে দেখা দিয়েছে মানবিক বিপর্যয়।
সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতি দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় বন্দর নগর মারিউপোলের। সেখানে দফায় দফায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া। সর্বশেষ গতকাল শনিবার মারিউপোলের কেন্দ্রে পৌঁছে যায় রুশ সামরিক বাহিনী। সেখানে তীব্র লড়াই চলছে। এতে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছে।
শনিবার মারিউপোলের একটি স্কুলে বোমা হামলা চালানো হয়েছে। স্কুলটিতে প্রায় ৪০০ জন আশ্রয় নিয়েছিলেন। হামলায় বিধ্বস্ত স্কুলের ধ্বংসস্তূপের নিচে বহু মানুষ আটকা পড়েছেন বলে জানিয়েছে মারিউপোল সিটি কাউন্সিল। তাঁদের মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে। আটকে পড়াদের উদ্ধারে তত্পরতা চলছে।
এর আগে গত বুধবার মারিউপোলের একটি থিয়েটারে বোমাবর্ষণ করে রুশ বাহিনী। সেখানেও আশ্রয় নিয়েছিলেন সহস্রাধিক মানুষ। বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত থিয়েটারের নিচে আটকা পড়েছেন অনেকে।
মারিউপোলের বর্তমান চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে তামারা কাভুনেনকো নামের এক বাসিন্দা বলেন, ‘শহরটাকে এখন আর মারিউপোল বলে চেনা যায় না। এটা নরকে পরিণত হয়েছে। শহরের রাস্তাগুলো লোকজনের মরদেহে ভরে গেছে।’
মারিউপোলে রুশ বাহিনীর হামলা ইতিহাসের পাতায় যুদ্ধাপরাধ হিসেবে লেখা থাকবে বলে উল্লেখ করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি।
আজ রোববার এক ভিডিও বার্তায় জেলেনস্কি বলেন, রাশিয়ার বোমা হামলার জেরে নানা শহরে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে। এ অবস্থার মধ্যেই শনিবার রুশ সেনাবাহিনীর অবরোধ করে রাখা শহরগুলো থেকে ৬ হাজার ৬২৩ জনকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৪ হাজারই মারিউপোলের।
এদিকে উত্তরের চেরনিহিভ শহরের একটি হাসপাতালে গতকাল ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন শহরটির মেয়র ভ্লাদিস্লাভ আত্রোশেঙ্কো। টেলিভিশনে দেওয়া এক বক্তব্যে তিনি বলেন, চেরনিহিভের আবাসিক এলাকাগুলোতে হামলা চলছে। এতে নারী ও শিশুসহ বেশ কিছু বেসামরিক লোক নিহত হয়েছেন। শহরটি চরম মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে।
শনিবার বিমান হামলা হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের মিকোলাইভ শহরেও। স্থানীয় সেনাঘাঁটিতে ভয়াবহ হামলা চালানোর এক দিন পরই নতুন এ হামলা হলো বলে জানিয়েছেন আঞ্চলিক প্রশাসনিক প্রধান ভিতালি কিম।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) শনিবার জানায়, রাশিয়ার হামলার মুখে নারী ও শিশুসহ লাখ লাখ বেসামরিক লোক বিভিন্ন শহরে আটকা পড়েছেন। সহায়তা সংস্থাগুলো তাঁদের কাছে পৌঁছাতে হিমশিম খাচ্ছে।
এ পরিস্থিতিকে ‘ভয়াবহ’ আখ্যা দিয়ে ডব্লিউএফপির জরুরি কাজের সমন্বয়ক জ্যাকব কের্ন বলেন, যেসব শহর অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে, আর যেগুলো অবরুদ্ধ হতে চলেছে, সেসব জায়গায় প্রবেশ করাটাই চ্যালেঞ্জ।
ডব্লিউএফপির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘রাশিয়ার হামলা শুরুর পর ৩৩ লাখের বেশি মানুষ ইউক্রেন ছেড়ে পাশের দেশগুলোতে পালিয়েছেন। অনেকেই এখনো দেশের মধ্যে আটকা পড়ে আছেন। তাঁরা বের হতে পারছেন না। আর আমরাও তাঁদের কাছে পৌঁছাতে পারছি না।’
এরই মধ্যে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় শনিবার জানিয়েছে, ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলে ইভানো-ফ্রানকিভস্ক অঞ্চলে একটি অস্ত্র সংরক্ষণাগারে তারা হাইপারসনিক (শব্দের চেয়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন) ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা চালিয়েছে। আগে কোনো যুদ্ধে কিনঝাল নামের ক্ষেপণাস্ত্রটি ব্যবহার করা হয়নি।
তবে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার যুদ্ধের ময়দানে তেমন পরিবর্তন আনবে না বলে মনে করেন মস্কোর সামরিক বিশ্লেষক পাভেল ফেলজেনহাওর। তিনি বলেন, মৌলিকভাবে এটা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন আনে না। তবে সবাইকে আতঙ্কিত করতে মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ছড়ায়।
এদিকে সংকট সমাধানে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে দফায় দফায় আলোচনা চলছে। তবে তেমন কোনো অগ্রগতির দেখা এখনো পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে রুশ হামলার নিন্দা প্রকাশে বেইজিংকে আহ্বান জানিয়েছে কিয়েভ। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ রাশিয়ার অভিযানের মুখে কিয়েভের পক্ষে অবস্থান নিলেও ব্যতিক্রম চীনসহ আরও কিছু দেশ।
শনিবার জেলেনস্কির উপদেষ্টা মিখাইলো পোদোলিয়াক এক টুইট বার্তায় বলেন, চীন যদি সভ্য দেশগুলোর জোটকে সমর্থন ও রাশিয়ার বর্বরতার নিন্দা জানানোর সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়, তবে বৈশ্বিক নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে দেশটি।
আগের দিন শুক্রবার চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সেখানে বাইডেন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, চীন যদি রাশিয়াকে সামরিক বা অর্থনৈতিক সহায়তা করে, তবে পরিণতি ভালো হবে না। তবে ভিডিও কলে রাশিয়ার হামলার নিন্দা জানিয়ে কোনো কথা বলেননি চীনা প্রেসিডেন্ট।
এদিকে শনিবার ভারতকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা। জবাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পক্ষ থেকে তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।