আল-জাজিরার বিশ্লেষণ

সৌদি-ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক গড়তেই কি বাইডেনের সফর

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সৌদি সফর ঘিরে রয়েছে নানা বিতর্ক। আজ শুক্রবার জেদ্দায় যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের (এমবিএস) সঙ্গে বৈঠক শুরুর আগে নানা রকমের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাঁকে। কীভাবে এবং কখন বাইডেনের সঙ্গে সরাসরি এমবিএসের মুখোমুখি আলোচনায় বসা উচিত, সে বিতর্কটি স্পর্শকাতর। তবে হোয়াইট হাউস অভ্যন্তরীণভাবে বাইডেনের এই সফরকে ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য উপকারী হিসেবে তুলে ধরছে, যা ওয়াশিংটনের সব দলের আইনপ্রণেতাদের চোখে কম বিতর্কিত সফর হিসেবে চিত্রায়ণ করা যেতে পারে।

‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’ চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েল ও আরব বিশ্বের কয়েকটি দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে করা ওই চুক্তিতে নিজস্ব সংযোজন চায় বর্তমান মার্কিন প্রশাসন। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরায়েলের একটি চুক্তি হলে তা বাইডেনের জন্য বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হবে।

বাহরাইনের বৈদেশিক নীতির ওপর সৌদি প্রভাব রয়েছে। ফলে ইসরায়েলের প্রতি বাহরাইনের পদক্ষেপকে সৌদির ইতিবাচক সংকেত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
অধ্যাপক আলি বাকের, সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, কাতার বিশ্ববিদ্যালয়

সৌদি আরব সফরের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগে বাইডেনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি রিয়াদের কাছ থেকে কোনো ‘প্রতিশ্রুতির’ অপেক্ষা করছেন কি না। জবাবে বাইডেন বলেছেন, ‘সৌদি নাগরিকদের প্রতিশ্রুতি জ্বালানি সম্পদের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো কিছুর সঙ্গে যুক্ত নয়। সৌদি আরবে দীর্ঘ বৈঠকের মাধ্যমেই সেটা ঘটতে পারে। সে কারণেই আমি যাচ্ছি। এটি সৌদি আরব ও ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।’

অনেক ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকের ধারণা, ইসরায়েলের সঙ্গে বাহরাইনের চুক্তি শুধু সৌদি আরবের সম্মতির মাধ্যমেই হতে পারে। কারণ, বাহরাইন ও সৌদি আরবের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের একসময়কার ঘনিষ্ঠ মিত্রদেশ সৌদি আরব। এখনো যে দুই দেশের সম্পর্ক খুব খারাপ, তা বলা চলে না। তবে এর ওপর খানিকটা ধুলাবালু জমেছে। মূলত সৌদির সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে দুই দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়। হত্যাকাণ্ডটি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে হলেও বাইডেন তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় ওই হত্যাকাণ্ডের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এ নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর সৌদি যুবরাজের সঙ্গে নয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সম্পর্কটা খানিকটা শীতল হয়ে ওঠে। খাসোগি হত্যাকাণ্ডের পেছনে সৌদি যুবরাজের হাত আছে বলে অভিযোগ মার্কিন গোয়েন্দাদের। তবে সেই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন সৌদির যুবরাজ। এত কিছুর মধ্যেই সৌদি আরব সফরে যুবরাজ বিন-সালমানের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন বাইডেন।

কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক আলি বাকের বলেন, ‘বাহরাইনের বৈদেশিক নীতির ওপর সৌদি প্রভাব রয়েছে। ফলে ইসরায়েলের প্রতি বাহরাইনের পদক্ষেপকে সৌদির ইতিবাচক সংকেত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমার ধারণা, বাইডেনের সৌদি আরব সফরের পর বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে। এগুলো ব্যবসা, পর্যটন বা উভয় পক্ষের মধ্যে পরোক্ষ যোগাযোগের ক্ষেত্রেও হতে পারে।’

একের পর এক আরব ও মুসলিম দেশ স্বাভাবিককরণের ট্রেনে ওঠায় ফিলিস্তিনিদের জন্য হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করতে পারে।
অধ্যাপক আহলাম মুহতাসেব, মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি

ভবিষ্যতে সৌদি আরব যদি অন্য আরব বা মুসলিম মিত্র এবং অংশীদারদের ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক হতে আগাম সংকেত দেয়, তাহলে আব্রাহাম চুক্তি আরও বড় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিককরণ এমনকি পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার হলেও আরবের অন্য দেশগুলোর ওপর এর প্রভাব পড়বে। যদিও অনেক আরব দেশের সঙ্গে এখন ইসরায়েলের স্বাভাবিক সম্পর্ক রয়েছে।

এদিকে বৃহস্পতিবার সৌদি আরব নিজেদের আকাশসীমা ব্যবহারের জন্য সব এয়ারলাইনসের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অনেকে মনে করছেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের জন্য এটি ছোট্ট একটি পদক্ষেপ। এর ফলে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের সঙ্গে ইসরায়েলের অংশীদারত্ব আরও দ্রুত বাড়বে।

আরেকটি বড় অগ্রগতি যা সৌদি-ইসরায়েল ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের দিকে ইঙ্গিত দেয়। তা হলো লোহিত সাগরের তিরান ও সানাফির দ্বীপ মিসর থেকে সৌদি আরবে স্থানান্তরের জন্য তেল আবিবের অনুমোদন। সৌদি আরব ও ইসরায়েল কাছাকাছি চলে আসা সত্ত্বেও বাইডেন প্রশাসন মনে করছে, বাইডেন সফরে থাকাকালে দুই দেশের মধ্যে কোনো স্বাভাবিককরণ চুক্তি ঘোষণা হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। এ ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয় যে বহু দশক ধরে ফিলিস্তিনের সমর্থক হিসেবে পরিচিত বাদশাহ সালমান এখনো সিংহাসনে রয়েছেন।

সৌদি আরব-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের বিষয়টি সামনে আসছে মূলত যুবরাজ বিন-সালমানের কারণে। তিনি রিয়াদের সঙ্গে তেল আবিবের পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক দেখতে চান। কিন্তু বিন-সালমান সিংহাসনে বসলেও রিয়াদ সম্ভবত স্বাভাবিককরণের বিষয়ে সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হবে। বৃহত্তর মুসলিম বিশ্বে সৌদি আরবের ভূমিকা ও সেই সঙ্গে সৌদি আরবের ভেতরে প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকির কথা মাথায় রাখা হবে।

ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির মিডিয়া স্টাডিজের অধ্যাপক আহলাম মুহতাসেব বলেন, একের পর এক আরব ও মুসলিম দেশ স্বাভাবিককরণের ট্রেনে ওঠায় ফিলিস্তিনিদের জন্য হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করতে পারে।