তুরস্ক থেকে নেপাল, ভয়াবহ যত ভূমিকম্প

ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। কাহরামানমারাস, তুরস্ক। ৬ ফেব্রুয়ারি
ছবি: রয়টার্স

ঘড়িতে তখন ভোররাত ৪টা ১৭ মিনিট। সীমান্তের দুই দিকে তুরস্ক ও সিরিয়ার বাসিন্দারা ঘুমাচ্ছিলেন। এ সময় শক্তিশালী এক ভূমিকম্প আঘাত হানে ওই জনপদে।

ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৮। ভূমিকম্পের পরে আরও অর্ধশতবার পরাঘাত অনুভূত হয়। ভূমিকম্পে দুই দেশের সাড়ে তিন হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। বহু মানুষ নিখোঁজ। অসংখ্য ভবন ও অবকাঠামো ধসে পড়েছে। আহত ব্যক্তিদের আহাজারি চলছে হাসপাতালে।  

ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল সিরিয়ার সীমান্তবর্তী তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় শহর গাজিয়ানতেপ। তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুলেমন সোইলু বলেন, ভূমিকম্প এত শক্তিশালী ছিল যে ১০টি শহরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি হয়েছে। এগুলো হলো গাজিয়ানতেপ, কাহরামানমারা, হাতায়, ওসমানিয়ে, আদিয়ামান, মালাতিয়া, সানিলুফরা, আদানা, দিয়ারবাকির ও কিলিস। ভোররাতের ওই ভূমিকম্পের ১২ ঘণ্টা পর ৭ দশমিক ৭ মাত্রার আরও একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। এর কেন্দ্র ছিল দিয়ারবাকির।  

গত বছরে জুনে আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলে শক্তিশালী ভূমিকম্পে ১ হাজার মানুষ প্রাণ হারান

ভূমিকম্পটি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে তুরস্ক ও সিরিয়া ছাড়াও লেবানন ও সাইপ্রাস এমনকি তুরস্ক থেকে বহু দূরে থাকা ডেনমার্কের গ্রিনল্যান্ডে ভূকম্পন অনুভূত হয়। তুরস্ক–সিরিয়ায় সোমবার আঘাত হানা এ ভূমিকম্প এর আগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ‘প্রলয়ংকরী’ যেসব ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল, তার স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে।

আফগানিস্তান, জুন ২০২২
গত বছরের জুনে আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলে শক্তিশালী একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৬ দশমিক ১। এ ভূমিকম্পে অন্তত ১ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। আহত হন দেড় হাজার। ভূমিকম্পে পাকতিকা প্রদেশে অনেক জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুরো বা আংশিক ধসে পড়ে সাড়ে চার হাজার বাড়ি।

২০১১ সালের মার্চে জাপানে ভূমিকম্প ও এরপরে সুনামিতে প্রায় ১৯ হাজার মানুষ নিহত হন

হাইতি, আগস্ট ২০২১

২০২১ সালের ১৪ আগস্ট সকালে ৭ দশমিক ২ মাত্রার শক্তিশালী এক ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে হাইতি। ভূমিকম্পে ধসে পড়ে অসংখ্য বাড়ি, স্কুল ও হাসপাতাল। এই ভূমিকম্পে কয়েক শ মানুষ প্রাণ হারান। দারিদ্র্যপীড়িত দেশটি পড়ে সংকটে। ২০১০ সালের ভূমিকম্পের পর এটাকে হাইতির ‘সবচেয়ে বড় বিপর্যয়’ বলা হয়েছিল।  

নেপাল, এপ্রিল ২০১৫
তুরস্ক–সিরিয়ায় আঘাত হানা ভূমিকম্প ২০১৫ সালে নেপালে হওয়া ভূমিকম্পের স্মৃতি ফিরিয়ে আনছে। আজকের ভূমিকম্পের মতো নেপালের সেই ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৮। ১৯৩৪ সালের পর নেপালে সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প ছিল এটি। এ ছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে এটি একটি। ভূমিকম্পে নেপালে ধ্বংসযজ্ঞ বয়ে যায়। এতে প্রায় ৯ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। আহত আরও ২১ হাজার। ধ্বংস হয় ৮০ শতাংশ ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক স্থাপনা।

হাইতিতে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে শক্তিশালী এক ভূমিকম্পে ৩ লাখ ১৬ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।

পাকিস্তান, সেপ্টেম্বর ২০১৩

এ বছর পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে পরপর দুটি শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। একটির মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৭, অপরটির ৬ দশমিক ৮। মূলত ভূমিকম্প হয় প্রদেশটির আওরান জেলায়। তবে রাজধানী ইসলামাবাদ ছাড়াও রাওয়ালপিন্ডি, করাচি, লাহোর, লারকানার মতো বড় বড় শহরগুলোয়ও ভূকম্পন অনুভূত হয়। এ ছাড়া পাকিস্তানের বাইরে ভারতের নয়াদিল্লি এবং ভূমিকম্পের কেন্দ্র থেকে ৮০০ কিলোমিটার দূরে ওমানের রাজধানী মাসকাটেও ভূকম্পন অনুভূত হয়েছিল। এ ভূমিকম্পে বেলুচিস্তানের অসংখ্যা গ্রাম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এতে কমপক্ষে ৮২৫ জন প্রাণ হারান। আহত হন এক হাজারের বেশি। ভূমিকম্পে বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়।

জাপান, মার্চ ২০১১
জাপান ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে দেশটিতে ভূমিকম্পের ঝুঁকি অন্য অনেক দেশের চেয়ে বেশি। ২০১১ সালের মার্চে জাপানে ৯ মাত্রার শক্তিশালী এক ভূমিকম্প আঘাত হানে। ভূমিকম্পের পর আঘাত হানে সুনামি। ভূমিকম্প ও সুনামিতে প্রায় ১৯ হাজার মানুষ নিহত হন। আহত হন আরও ৬ হাজার। এই ভূমিকম্পের ফলে ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিপর্যয় ঘটে। ১৯৮৬ সালে চেরনোবিলের পর এটি ছিল সবচেয়ে মারাত্মক পারমাণবিক বিপর্যয়ের ঘটনা।

চীনের সিচুয়ান প্রদেশে ২০০৮ সালে ভূমিকম্পে ৮০ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারান।

হাইতি, জানুয়ারি ২০১০
ক্যারিবীয় দ্বীপরাষ্ট্র হাইতির রাজধানী পোর্ট–অ–প্রিন্সে ৭ মাত্রার শক্তিশালী একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। এতে রীতিমতো বিধ্বস্ত হয় পোর্ট-অ-প্রিন্স। নিহত হয় ৩ লাখ ১৬ হাজারের মতো মানুষ। ভূমিকম্পটি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে হাইতির প্রতিবেশী দেশ কিউবা ও ভেনেজুয়েলাতেও ভূকম্পন অনুভূত হয়। এই ভূমিকম্পের পর ধ্বংসযজ্ঞে বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের আনুমানিক হিসাবে, এ ভূমিকম্পে পোর্ট-অ-প্রিন্স ও এর আশপাশের এলাকার ৮০ হাজার ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছিল। বিশ্বে এখন পর্যন্ত যত প্রাকৃতিক দুর্যোগের ইতিহাস জানা যায়, হাইতিতে ব্যাপক প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো এই ভূমিকম্পকে ‘সবচেয়ে ভয়াবহ একটি’ বলা হয়।

চীন, মে ২০০৮
সিচুয়ান প্রদেশে আঘাত হানে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী একটি ভূমিকম্প। এতে প্রায় ৮৮ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। গৃহহীন হয়ে পড়ে আরও প্রায় এক কোটি মানুষ। ভূমিকম্পের আঘাতে কয়েক লাখ ভবন ধসে পড়ে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখনকার হিসাবে, সেই ভূমিকম্পে ৮ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের সম্পদ নষ্ট হয়েছিল। ভূমিকম্পের সময় স্কুলে ছিল এমন ১০ হাজার শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। ভূমিকম্পের ফলে ভবন ধসে পড়ে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে এসব শিশু প্রাণ হারিয়েছিল।  

কাশ্মীর, মে ২০০৫
ভারত ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর উপত্যকা শক্তিশালী এক ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৬। এই ভূমিকম্পে উপত্যকার ৭৫ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়। গৃহহীন হয়েছিল ১০ লাখের বেশি মানুষ। দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় উদ্ধার অভিযান চালানো খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল।

আফগানিস্তান, মে ১৯৯৮
এ বছর কয়েক মাসের ব্যবধানে আফগানিস্তানে হিন্দুকুশ পর্বতমালায় দুটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। প্রথম ভূমিকম্পটি আঘাত হানে ফেব্রুয়ারি মাসে, তাখার প্রদেশে। এই ভূমিকম্পে ২ হাজার ৩০০ মানুষ প্রাণ হারায় (তবে কারও কারও মতে সংখ্যাটা ৪ হাজার)। এর তিন মাস পর মে মাসে আরও একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। রিখটার স্কেলে এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৬। এ ভূমিকম্পে প্রায় ৪ হাজার ৭০০ মানুষের মৃত্যু হয়। আহত হন আরও কয়েক হাজার মানুষ।    

চিলি, মে ১৯৬০
বিশ্বের যেসব ভূমিকম্পের ইতিহাস পাওয়া যায়, এর মধ্যে সবচেয়ে বড় মাত্রার ভূমিকম্পটি হয়েছিল এ বছর, চিলিতে। রিখটার স্কেলে সেই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৯ দশমিক ৫, যা এখনো সবচেয়ে বড় মাত্রার ভূমিকম্প। ভূমিকম্পের পর ৩০ ফুট উচ্চতার একটি সুনামি হয়। ভূমিকম্প ও সুনামিতে প্রাণ হারান ২ হাজার মানুষ।  

জাপান, সেপ্টেম্বর ১৯২৩
সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিন বিকেলে জাপানে আঘাত হানে ৭ দশমিক ৯ মাত্রার শক্তিশালী এক ভূমিকম্প। এই ভূমিকম্পে টোকিও ও ইয়োকোহামার মতো নগরে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল। এ ভূমিকম্পের পর একটি সুনামি হয়েছিল, যেটির উচ্চতা ছিল ৪০ ফুট পর্যন্ত। ভূমিকম্প ও এতে সৃষ্ট সুনামির পরে টর্নোডোও হয়েছিল। সরকারি হিসাবে তাতে ১ লাখ ৪৩ হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়। এতে ইয়োকাহামার ৯০ শতাংশ ভবন এবং টোকিও পাঁচ ভাগের দুই ভাগ এলাকা ধ্বংস হয়েছিল।