দ্রুত উত্থান ঘটছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই)। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এই প্রযুক্তির কারণে সাংবাদিকেরাও এখন নৈতিক ও সম্পাদকীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে বাধ্য হচ্ছেন।
সংবাদপত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভূমিকা নিয়ে ইতালির পেরুগা শহরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক সাংবাদিকতা উৎসব। পাঁচ দিনের এই উৎসব রোববার শেষ হচ্ছে। এ আয়োজনে যেসব প্রশ্ন উঠে এসেছে তার মধ্যে রয়েছে নিউজরুমগুলোকে সহায়তা বা সম্পূর্ণরূপে রূপান্তরিত করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কতটুকু ভূমিকা রাখতে সক্ষম?
নিউজরুমে সাংবাদিকেরা যে ধরনের কাজ করেন, যেমন অডিও ফাইলের প্রতিলিপি তৈরি, অনুবাদ বা টেক্সট সংক্ষেপ করার মতো কাজগুলো এখন সহজেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন টুলগুলো করতে সক্ষম। ২০২৩ সালের শুরুতেই জার্মানির এক্সেল স্প্রিঙ্গার গ্রুপ ঘোষণা দেয়, তারা বিল্ড ও দায়ে ওয়েল্ট পত্রিকায় কর্মী ছাঁটাই করবে। এর কারণ হিসেবে তাঁরা জানায়, সাংবাদিকের বেশ কিছু কাজ এখন এআই টুল করতে সক্ষম। প্রতিদিন ছোটখাটো অনুরোধ বা নির্দেশ দিয়েই জেনারেটিভ এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে টেক্সট বা ছবি তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। এটি নিউজরুমের জন্য একদিকে যেমন সম্ভাবনা তৈরি করছে, তেমনি অন্যদিকে গত এক বা দেড় বছর ধরে চাকরি কেড়ে নেওয়ার উদ্বেগ সৃষ্টি করছে।
এখন এআই ব্যবহার করে কারও চেহারা ও কণ্ঠস্বর নকল করা সম্ভব এবং তা দিয়ে পডকাস্ট তৈরি বা টেলিভিশনে খবর পড়ানোও যেতে পারে। গত বছর ফিলিপিনো ওয়েবসাইট র্যাপলার তাদের দীর্ঘ নিবন্ধগুলোকে কমিকস, গ্রাফিকস ও ভিডিওতে রূপান্তর করে তরুণ শ্রোতাদের জন্য একটি ব্র্যান্ড তৈরি করেছে। গণমাধ্যম পেশাজীবীরা এখন সম্মত হয়েছেন যে সাংবাদিকতাকে এখন বাড়তি কিছু যুক্ত করার (ভ্যালু অ্যাড) বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। গুগল নিউজের ব্যবস্থাপক শৈলেশ প্রকাশ পেরুগায় ওই আয়োজনে অংশ নিয়ে বলেন, ‘সাংবাদিক হিসেবে আপনিই আসল কাজটি করছেন। আমরা যে টুল বা প্রোগ্রামগুলো তৈরি করছি, তা আপনাকে সহায়তা করবে।’
২০২২ সালে চ্যাটজিপিটি উন্মুক্ত হওয়ার পর থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গুরুত্ব বেড়ে গেছে। মার্কিন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ের তৈরি চ্যাটজিপিটি এখন ছোটখাটো নিউজরুমেও ব্যবহৃত হচ্ছে। কলম্বিয়ার গণমাধ্যম কুয়েস্টিওন পাবলিকা প্রকৌশলীদের কাজে লাগিয়ে এমন প্রোগ্রাম তৈরি করছে, যা তাদের আর্কাইভ থেকে ব্যাকগ্রাউন্ড তথ্য যোগ করতে পারে এবং তা ব্রেকিং নিউজে যুক্ত করে দিতে পারে। কিন্তু অনেক সংস্থা আছে, যারা নিজস্ব ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল তৈরি করে না। আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাতালি হেলবার্গার বলেন, এআই ইন্টারফেসের মূলে রয়েছে ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল। নিরাপদ ও আস্থাভাজন প্রযুক্তি তৈরিতে এগুলো প্রয়োজন।
গত বছর এভরিপিক্সেল জার্নাল জানায়, এক বছরে এআই ব্যবহার করে যত ছবি তৈরি করা হয়েছে, তা ১৫০ বছরের আলোকচিত্রের ইতিহাসে সম্ভব হয়নি। কিন্তু এ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন সামনে এসেছে। আর তা হচ্ছে ডিপফেকের মতো বিশাল এই কনটেন্টের ঢেউয়ের মাঝে প্রকৃত সংবাদ কীভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে? ছবি বা ভিডিওকে বিকৃত ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে নিখুঁতভাবে তৈরি করে হুবহু আসলের মতো বলে প্রচার করা হচ্ছে। বিষয়টি প্রযুক্তি জগতে ডিপফেক নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। এখনই বিষয়টি ভয়ানক বিপদের কারণ হয়ে উঠছে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। গণমাধ্যম ও প্রযুক্তি সংস্থাগুলো এখন যৌথভাবে এ হুমকি মোকাবিলায় কাজ শুরু করেছে। তারা কোয়ালিশন ফর কনটেন্ট প্রভেন্যান্স অ্যান্ড অথেনটিসিটি নামে একটি কার্যক্রম শুরু করেছে, যা সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য একটি মান তৈরি করবে।
বার্তা সংস্থা এএফপির সম্পাদকীয় উদ্ভাবন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক বৈশ্বিক সংবাদ পরিচালক সোফি হুয়েট বলেন, ‘আমাদের মূল কাজ সংবাদ সংগ্রহ করা, প্রান্তিক স্তরে প্রতিবেদন তৈরি করা। আমরা এ জন্য কিছুদিন প্রতিবেদকদের ওপর নির্ভর করব। তবে এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।’
গণমাধ্যম অধিকার বিষয়ক পর্যবেক্ষক রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস গত বছর এআই ও সাংবাদিকতা বিষয়ে প্যারিস চার্টার চালু করে। এর উদ্দেশ্য বিশ্বাসযোগ্য সংবাদ পরিবেশন। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক গণমাধ্যম, উদ্ভাবন ও মানবাধিকার বিষয়ক প্রভাষক আনিয়া স্কিফরিন বলেন, প্যারিস চার্টারের যে বিষয়টি ভালো লাগে, তা হচ্ছে এটি স্বচ্ছতার ওপর গুরুত্ব দেয়।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এআই দিয়ে আধেয় তৈরি করা হলে তা কতটুকু পাঠকদের সামনে প্রকাশ করবেন প্রকাশকেরা? সুইডিশ রেডিওর এআই ও নিউজ স্ট্র্যাটেজি বিভাগের প্রধান ওলে জ্যাকরিসন বলেন, ব্র্যান্ডকে বিশ্বাসযোগ্য করতে কোনো আধেয়কে এআই দিয়ে তৈরি ঘোষণা করে দেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক চলছে।
এআইয়ের ক্রমাগত পরিবর্তনের এ সময়ে এর নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি এখনো প্রাথমিক অবস্থায় রয়েছে। এর আগে গত মার্চ মাসে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট এআই মডেল নিয়ন্ত্রণে রাখতে একটি আইনি অবকাঠামো গ্রহণ করেছে।
ভারতের কুইন্টিলিয়ন মিডিয়া প্রধান রিতু কাপুর বলেন, প্রতি তিন মাস অন্তর তাঁদের এআই–বিষয়ক সম্পাদকীয় নীতিমালা হালনাগাদ করা হয়। তাঁদের গণমাধ্যমে কোনো আধেয় এআই দিয়ে লেখা হয় না। এ ছাড়া এআই দিয়ে তৈরি ছবি কোনো বাস্তব ছবির প্রতিনিধিত্ব করে না।
এআই মডেলগুলো চালাতে সাধারণত ব্যাপক তথ্যের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু এই তথ্য জোগাড় করতে গিয়েই সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে এর উন্নয়নকারীদের। গত ডিসেম্বরে নিউইয়র্ক টাইমস ওপেনএআই ও এর প্রধান বিনিয়োগকারী মাইক্রোসফটের বিরুদ্ধে মেধাস্বত্ব লঙ্ঘনের অভিযোগে মামলা করে। অন্যদিকে অনেক গণমাধ্যম ওপেনএআইয়ের সঙ্গে চুক্তি করেছে। এর মধ্যে রয়েছে এক্সেল স্প্রিঙ্গার, মার্কিন সংবাদ সংস্থা এপি, ফ্রান্সের দৈনিক লাঁ মদ, স্পেনের প্রিসা মিডিয়া গ্রুপ।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম স্কুলের অধ্যাপক মিলি বেল বলেন, গণমাধ্যমশিল্পে সীমিত সম্পদের সঙ্গে নতুন প্রযুক্তি যুক্ত করার বিষয়টি প্রলুব্ধকর। তাঁর ধারণা, গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে বাইরের একটি চাপ কাজ করছে আর তা হচ্ছে দ্রুত উঠে পড়ো, ট্রেন মিস করো না।