বিবিসি ২০২৪ সালের জন্য বিশ্বের ১০০ অনুপ্রেরণাদায়ী এবং প্রভাবশালী নারীর তালিকা প্রকাশ করেছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মহাকাশে আটকা পড়া সুনিতা উইলিয়ামস, ভয়াবহ যৌন নির্যাতনের শিকার গিসেল পেলিকট, হলিউড অভিনেত্রী শ্যারন স্টোন, অলিম্পিক ক্রীড়াবিদ রেবেকা আন্দ্রে এবং অ্যালিসন ফেলিক্স, গায়ক রায়ে, নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী নাদিয়া মুরাদ, ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট ট্রেসি এমিন, জলবায়ু প্রচারক আডেনিকে ওলাডোসু এবং লেখিকা ক্রিস্টিনা রিভেরা গারজা। গাজা, লেবানন, ইউক্রেন ও সুদানে ভয়াবহ সংঘাত এবং মানবিক সংকটের মুখোমুখি হওয়া থেকে শুরু করে বিশ্বজুড়ে রেকর্ডসংখ্যক নির্বাচনের পর সমাজে নানা মেরুকরণের মধ্যে সব ক্ষেত্রে যেসব নারী সর্বোচ্চ শক্তিমত্তা ও সহনশীলতার নজির রেখেছেন এবং নিজেদের চারপাশকে বদলে দেওয়ার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন, তাঁরা বিবিসি ১০০ নারীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন।
সুনিতা উইলিয়ামস, মহাকাশচারী
সুনিতা উইলিয়ামস যুক্তরাষ্ট্রের নাসার মহাকাশচারী। তিনি যখন গত ৫ জুন বোয়িং স্টারলাইনার মহাকাশযানে চড়ে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের (আইএসএস) উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন, তখন তাঁর প্রত্যাশা ছিল আট দিনের মিশন শেষে আবার পৃথিবীর বুকে ফিরে আসবেন। কিন্তু প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে উইলিয়ামস এবং তাঁর সহকর্মী ব্যারি উইলমোরকে জানানো হয়েছে, তাঁরা ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারবেন না। পৃথিবী থেকে ২৫০ মাইল (৪০০ কিলোমিটার) দূরে বন্ধুবান্ধব এবং পরিবার থেকে দূরে থাকা সত্ত্বেও তিনি শক্তিমত্তা ও উত্সাহী মনোভাব ধরে রেখেছেন।
জোহানা বাহামন, সমাজকর্মী
একবার একটি কারাগার পরিদর্শনে গিয়ে কলম্বিয়ার অভিনেত্রী জোহানা বাহামনের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। জীবন বদলাতে যাঁদের ‘আরেকটি সুযোগ’ প্রয়োজন, তাঁদের জন্য কাজ করার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন সেখান থেকেই। ২০১২ সালে তিনি অভিনয় জীবনের ইতি টেনে কারাগার সংস্কারের কাজ শুরু করেন। প্রতিষ্ঠা করেন ফাউন্ডেসন অ্যাসিওন ইন্টের্না। এটি একটি অলাভজনক সংস্থা, যা কলম্বিয়ার কারাগারের কয়েদি এবং যাঁরা মুক্তি পেয়েছেন, তাঁদের জন্য কাজ করে।
ফাউন্ডেশনটি সারা দেশে দেড় লাখের বেশি মানুষ এবং ১৩২টি কারাগারে তাদের সেবা পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে। এই সমাজকর্মী ২০২২ সালের ‘দ্বিতীয় সুযোগ’ আইনেরও প্রবর্তক ছিলেন, যা জোহানা বাহামন বিল নামে পরিচিত। কারাগারের জীবন শেষে মানুষের কর্মসংস্থান এবং প্রশিক্ষণ পাওয়ার সুযোগকে শক্তিশালী করতে কাজ করেছে ফাউন্ডেশন।
ভিনেশ ফোগাট, কুস্তিগির
ভিনেশ ফোগাট হলেন ভারতের অন্যতম পুরস্কারজয়ী কুস্তিগির। খেলাধুলায় নারীদের প্রতি লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে একজন সোচ্চার সমালোচক৷ তিনি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ, কমনওয়েলথ এবং এশিয়ান গেমসে পদক জিতেছেন। ভিনেশ ফোগাট তিনবারের অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং প্রথম ভারতীয় হিসেবে অলিম্পিক ফাইনালে পৌঁছেছিলেন।
খেলাধুলা থেকে অবসর নেওয়ার পর ভিনেশ রাজনীতিতে যোগ দেন। ভারতীয় কুস্তিগিরদের ফেডারেশন প্রধান ব্রিজ ভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে মাসব্যাপী বিক্ষোভে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। বিক্ষোভের সময় পুলিশ ভিনেশ এবং অন্য বিক্ষোভকারীদের আটক করলে ঘটনাটি আলোচনায় আসে।
নাওমি ওয়াতানাবে, কৌতুক অভিনেতা
জাপানের বিখ্যাত প্রভাবশালীদের একজন হিসেবে নাওমি ওয়াতানাবে তাঁর দেশের নতুন প্রজন্মের নারী কৌতুক অভিনেতাদের পথ দেখিয়েছেন। তিনি জাপানের কৌতুক অভিনয় অঙ্গনে পুরুষদের আধিপত্যের ধারা ভেঙে দেন। জাপানের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী দর্শকদের কাছেও জনপ্রিয় এই কৌতুক অভিনেতা। জাপানে শারীরিক গঠন নিয়ে প্রচলিত ধ্যান-ধারণা পরিবর্তনেও কাজ করছেন ওয়াতানাবে।
হালা আলকারিব,
যুদ্ধে যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়াকু সৈনিক
হর্ন অব উইমেন ইন স্ট্র্যাটেজিক ইনিশিয়েটিভ ফর উইমেনের (এসআইএইচএ) আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে বিশিষ্ট সমাজকর্মী এবং লেখক হালা আলকারিব বিস্তৃত অঞ্চলে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতাবিষয়ক বিভিন্ন প্রোগ্রাম পরিচালনা করেন। ২০২৩ সালের এপ্রিলে সুদানে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে যুদ্ধে যৌন সহিংসতার ঘটনা অনুসন্ধান করছেন এবং সহিংসতার শিকার নারী ও মেয়েদের সহায়তা দিচ্ছেন।
লিন্ডা ড্রফন গুনারসডোটির, আইসল্যান্ড
নারী আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক
লিন্ডা ড্রফন গুনারসডোত্তির আইসল্যান্ডের নারী আশ্রয়কেন্দ্রে সেসব নারীদের সহায়তা দেন, যাঁরা নিজের পরিবারের সদস্যদের হাতে সহিংসতার শিকার হয়ে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। আইসল্যান্ড প্রায়ই নারীদের জন্য সেরা জায়গাগুলোর তালিকায় শীর্ষে থাকে। কিন্তু সেখানে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার হার ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী।
লিন্ডা ড্রফন বলেছেন, ২০ বছর আগে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা ৬৪ শতাংশ নারী শেষমেশ তাঁদের নির্যাতনকারীদের কাছে ফিরে গিয়েছিলেন। কিন্তু উন্নত পরিষেবার কারণে এই হার এখন ১১ শতাংশে নেমে এসেছে।
ফাওজিয়া আল-ওতাইবি, নারী অধিকার আন্দোলনকারী
ফওজিয়া আল-ওতাইবি সৌদি আরবে পুরুষ অভিভাবকত্ব ব্যবস্থার অবসানের লক্ষ্যে দীর্ঘদিন ধরে প্রচারণা চালিয়ে আসছেন। আর এ জন্য তিনি বেছে নিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করার পর তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর বোন মানাহেল আল-ওতাইবিও একজন নারী অধিকারকর্মী।
চলতি বছরের শুরুর দিকে ফাওজিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকে ১১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। অনলাইনে তাঁর নিজস্ব মতামত প্রকাশ ও পোশাকের কারণে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। তাঁদের বড় বোন মরিয়মের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। মানাহেলের মুক্তির জন্য নিরলসভাবে প্রচারণা চালিয়েছেন আল-ওতাইবি।
গ্যাবি মোরেনো, লাতিন সংগীতশিল্পী
লাতিন আমেরিকার একজন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ও গীতিকার গুয়াতেমালার গ্যাবি মোরেনো। গুয়াতেমালার এই নারী চলতি বছর সেরা লাতিন পপ অ্যালবামের জন্য গ্র্যামি জিতেন। তিনি গুয়াতেমালার ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত। তিনি জাতিসংঘের এই সংস্থার সঙ্গে শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করছেন। সম্প্রতি তিনি তাঁর দেশে শিশুদের গুণগত শিক্ষা উপকরণের জন্য একটি প্রচারণা শুরু করেছেন।
হিন্দা আবদি মোহামুদ, সাংবাদিক
হিন্দা আবদি মোহামুদ অল্প বয়সী একজন মেধাবী লেখক। নিজের শহর সোমালিয়ার হারগেইসায় সহিংসতা থেকে পালিয়ে আসা লোকজনের গল্পসহ একটি ডায়েরি রেখেছিলেন তিনি। এখন তিনি দেশের প্রথম গণমাধ্যম যেখানে কর্মীদের সবাই নারী—সেই ‘বিলান’–এর প্রধান সম্পাদক।
সোমালি নারীরা কর্মক্ষেত্রে উচ্চ যৌন নিপীড়ন ও হয়রানির বিরুদ্ধে লড়াই করতে এই দলটি গঠন করেছিলেন। সোমালিয়ার সামাজিক সমস্যাগুলোর ওপর আলোকপাত করা, এইচআইভি আক্রান্ত হওয়ার তথ্য লুকিয়ে যাঁরা সবার সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করছেন, তাঁদের তথ্য বের করা, নির্যাতিত অনাথসহ বিভিন্ন পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের গল্পগুলো জনসমক্ষে তুলে আনা বিলানের মূল লক্ষ্য।
অলিভিয়া ম্যাকভি, মেকআপ আর্টিস্ট
মাথায় টাক পড়ার পর (অ্যালোপেসিয়া) বিশ্বজুড়ে পরচুলা অন্বেষণ শুরু করেছিলেন যুক্তরাজ্যের অলিভিয়া ম্যাকভি। নতুন স্টাইল ব্যবহার করে এবং বিকল্প চুল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তিনি চুল পড়ার সমস্যায় থাকা নারীদের উত্সাহিত করছেন। সে জন্য তিনি একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছেন৷ সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে তাঁর অনুসারীর সংখ্যা ৫ লাখের বেশি।
ড্যানিয়েল ক্যান্টর, সাংস্কৃতিক কর্মী
কালচার অব সলিডারিটির সহপ্রতিষ্ঠাতা হিসেবে কাজ করছেন ড্যানিয়েল ক্যান্টর। এটি একটি তৃণমূল প্রকল্প, যা করোনা মহামারির সময় শুরু হয়েছিল। এর মাধ্যমে ড্যানিয়েল ক্যান্টর ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন অঞ্চলের দুর্বল সম্প্রদায়গুলোকে সহায়তা করছেন। সহপ্রতিষ্ঠাতা আলমা বেকের সঙ্গে তিনি হাউস অব সলিডারিটি পরিচালনা করছেন। এটি ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি অঞ্চলে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে বিতর্ক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক কার্যকলাপের একটি বিকল্প কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
নাদিয়া মুরাদ, নোবেলজয়ী
নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী ইরাকের নাদিয়া মুরাদ বর্তমানে যৌন সহিংসতার শিকার নারীদের জন্য একজন নেতৃস্থানীয় উকিল হিসেবে কাজ করছেন। তিনি ইসলামিক স্টেটের (আইএস) জঙ্গিদের হাতে একবার বন্দী হয়েছিলেন। এ সময় তিনি দাসত্ব ও যৌন নিপীড়নের শিকার হন। তিন মাস পর মুরাদ পালিয়ে যান এবং যুদ্ধ–সংক্রান্ত যৌন সহিংসতা নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে বিশ্বের মানুষের কাছে তাঁর নিজের গল্প তুলে ধরেন।
নাদিয়া আইএসকে বিচারের আওতায় আনতে মানবাধিকার আইনজীবী আমাল ক্লুনির সঙ্গে কাজ করেন। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে পুনর্গঠন এবং সহিংসতার শিকার নারীদের ক্ষতিপূরণ আদায়ে একটি উদ্যোগও হাতে নেন। নাদিয়া মুরাদ নারী সহনশীলতার বৈশ্বিক প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
ক্রিস্টিনা রিভেরা গারজা, লেখক
ক্রিস্টিনা রিভেরা গারজা একজন বিখ্যাত লেখক। ২০২৪ সালে তাঁর বই লিলিয়ানার ‘ইনভিন্সিবল সামার’–এর জন্য পুলিৎজার পুরস্কার জেতেন। নারী সহিংসতার বাস্তব চিত্র এই বইয়ের গল্পে ফুটে ওঠে। মেক্সিকান বংশোদ্ভূত ক্রিস্টিনা যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব হিউস্টনে স্প্যানিশ ভাষায় সৃজনশীল লেখালেখির পিএইচডি প্রোগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা।
তালিকায় অন্য যাঁরা আছেন
বিবিসির শীর্ষ ১০০ প্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীদের তালিকা আরও রয়েছেন—ব্রিটিশ চলচ্চিত্র পরিচালক ক্লো ঝাও, লেবাননের ফটোসাংবাদিক ক্রিস্টিনা অ্যাসি, সুইজারল্যান্ডের শিক্ষক এবং জলবায়ু আন্দোলনকর্মী রোজমারি উইডলার-ওয়াল্টি, যুক্তরাজ্যের প্রতিবন্ধীদের অধিকার আন্দোলনের কর্মী আইনজীবী রক্সি মারে, ফিলিস্তিনি সাংবাদিক ও কবি প্লেসটিয়া আলাকাদ, ইউক্রেনের সুপারহিউম্যানস সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা ওলগা রুদনিভা, ঘানা ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্থপতি লেসলি লোককো, ভারতের পূজা শর্মা, পর্তুগালের কবি মারিয়া তেরেসা হোর্তা, কলম্বিয়ার পরিবেশবিদ ব্রিজিত ব্যাপটিস্ট, ঘানার সংগীতশিল্পী নোয়েলা উইয়ালা, যুক্তরাজ্যের কনজারভেটিভ পার্টির নেতা রসায়ন ব্যাডেনোচ, ইসরায়েলের জিম্মি মুক্তির আন্দোলনের কর্মী এইনাভ জাঙ্গাউকার, তিউনিসিয়ার চলচ্চিত্র অভিনেত্রী হেন্ড সাবরি, মেক্সিকোর প্রোগ্রামার এবং ডেটা সায়েন্টিস্ট গ্যাব্রিয়েলা রুম ক্যাব্রেরা, রাশিয়ার রাজনৈতিক কর্মী লিলিয়া চানিসেভা, ইথিওপিয়ার ফটোগ্রাফার মাহেদার হাইলেসেলাসি, ইয়েমেনের প্রকৌশলী হারবিয়া আল হিমিয়ারি, কানাডিয়ান মডেল ম্যাডিসন টেভলিন, ক্রিস্টোসালের প্রধান আইন কর্মকর্তা রুথ লোপেজ, রাশিয়ার মানবাধিকার কর্মী স্বেতলানা আনোখিনা, ফিলিস্তিনি ডিজাইনার ইয়াসমিন মজাল্লি প্রমুখ।