ফিদেল কাস্ত্রো
ফিদেল কাস্ত্রো

পুঁজিবাদের নাকের ডগায় যেভাবে বিপ্লব সফল করেছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো

প্রবল পরাশক্তির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কীভাবে নিজের মতাদর্শে অটল থাকতে হয়, তা বিশ্বকে দেখিয়ে গেছেন কিউবার মহান নেতা ফিদেল কাস্ত্রো। তাঁকে ৬৩৮ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল! কিন্তু সব ষড়যন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তিনি ৪৯ বছর কিউবা শাসন করেছেন। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সাম্যের গান গেয়ে যাওয়া এ বিপ্লবীর আজ জন্মদিন। তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে থাকছে এই বিশেষ আয়োজন।

গালভর্তি দাঁড়ি, ঠোঁটে ধরা জ্বলন্ত চুরুট, পরনে জলপাই সবুজ সামরিক পোশাক, মাথায় একই রঙের ক্যাপ। মুখে ‘হয় সাম্যবাদ, না হয় মৃত্যু’ স্লোগান। কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর কথা উঠলে আপামর মানুষের মনে এই ছবিই ভেসে ওঠে।

তিনি অনুসারীদের কাছে ‘এক মহান নেতা’ আর বিরোধীদের কাছে ‘ফ্যাসিবাদী’।

ফিদেল কাস্ত্রোর জীবনের গল্পের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে বিপ্লবী আন্দোলন, স্নায়ুযুদ্ধ, পূর্ব-পশ্চিম দ্বন্দ্ব, পুঁজিবাদ আর কমিউনিজমের সংঘাত।

গেরিলাযুদ্ধের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কিউবার শাসক বাতিস্তাকে উৎখাত করে ১৯৫৯ সালে দেশটির ক্ষমতায় আসেন কাস্ত্রো। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৩৩ বছর। দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশক তিনি কিউবা শাসন করেছেন। কোনো পরাশক্তি, কোনো ষড়যন্ত্র বা মৃত্যুভয়ের কাছে মাথানত না করে নিজের বিশ্বাসে অটল থেকেছেন তিনি।

দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলার (বাঁয়ে) সঙ্গে কোলাকুলি করছেন তৎকালীন কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো। ২০০১ সালের ২ সেপ্টেম্বর জোহানেসবার্গে ম্যান্ডেলার বাসভবনে সফরে যান কাস্ত্রো

‘দ্য মুভমেন্ট’

সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কিউবার ক্ষমতা দখল করা ফুলগেনসিও বাতিস্তার দুঃশাসন ও নিপীড়নে কিউবার সাধারণ মানুষ তখন অতিষ্ঠ। ওই সময় কিউবা যৌন ব্যবসা, জুয়া আর মাদকের আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছিল। উচ্ছৃঙ্খল ধনীদের সময় কাটানোর জন্য কিউবা তখন স্বর্গরাজ্য। সে সময়ে বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে ‘দ্য মুভমেন্ট’ নামে একটি আন্দোলন গড়ে তোলেন কাস্ত্রো।

সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ১৯৫৩ সালের জুলাইয়ে কাস্ত্রোর গেরিলা বাহিনী সান্তিয়াগোর কাছে মোনকাডা সেনা ছাউনিতে আক্রমণের পরিকল্পনা করেন; কিন্তু সেই আক্রমণটি ব্যর্থ হয়। বহু বিপ্লবী নিহত হন। অনেকে ধরা পড়েন। ধরা পড়া ব্যক্তিদের দলে কাস্ত্রো নিজেও ছিলেন।

ওই বছরই কাস্ত্রোর বিচার শুরু হয়। বিচার চলাকালে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে দারুণ এক কাজ করেন তিনি। যেহেতু শুনানিতে বিদেশি সাংবাদিকদের প্রবেশের অনুমতি ছিল, আদালতে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি সেই সুযোগ ব্যবহার করে বিশ্ববাসীকে কিউবার তৎকালীন সেনাশাসকদের দমন–পীড়ন সম্পর্কে জানিয়ে দেন। কিউবার বাইরেও কাস্ত্রোর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। বিচারে তাঁকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

গেরিলা যুদ্ধ

সাধারণ ক্ষমায় ১৯৫৫ সালের মে মাসে কারামুক্ত হন কাস্ত্রো। পুনরায় গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে যান মেক্সিকোয়। সেখানে তাঁর দেখা হয় আরেক তরুণ বিপ্লবী চে গুয়েভারার সঙ্গে। কাস্ত্রো ও চে মিলে তরুণ বিপ্লবীদের সংগঠিত করতে থাকেন।

পরের বছর নভেম্বরে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে ৮১ জন সশস্ত্র বিপ্লবীকে নিয়ে গোপনে দেশে ফেরেন কাস্ত্রো। তাঁরা সিয়েরা মায়েস্ত্রা পাহাড়ে অবস্থান নেন এবং দুই বছর ধরে বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে যান।

১৯৫৮ সালের মে মাসে গেরিলারা হাভানা দখলের জন্য সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করেন। গেরিলারা একের পর এক শহর দখল করে নেয়। পরাজয় নিশ্চিত জেনে ওই বছর ৩১ ডিসেম্বর বাতিস্তা কিউবা ছেড়ে পালিয়ে যান। পরদিন ১ জানুয়ারি গেরিলা বাহিনী নিয়ে বিজয়ীর বেশে হাভানায় প্রবেশ করেন ফিদেল কাস্ত্রো। পরের মাসে তিনি কিউবার প্রধানমন্ত্রী হন।

কিংবদন্তি ফুটবলার ডিয়েগো ম্যারাডোনার সঙ্গে খেলাচ্ছলে বল হাতে তৎকালীন কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো। ছবিটি ২০০৫ সালের ২৬ অক্টোবর লা হাভানা থেকে তোলা

সাম্যবাদ কি গিয়ে মেশে ‘একনায়কতন্ত্রে’

বাতিস্তা সরকারকে উৎখাত করে কিউবার ক্ষমতা দখলের পর খুব দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের কথা বলেছিলেন কাস্ত্রো; কিন্তু তিনি তাঁর সেই প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেননি। যদিও তাঁর আমলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে প্রথম বিশ্বের সমতুল্য দেশে পরিণত হয়েছিল কিউবা। তিনি সবার জন্য শিক্ষা ও চিকিৎসা বিনা মূল্যে করে দেন।

কিন্তু কাস্ত্রোর আমলে মাথাপিছু আয়ে পিছিয়ে যায় কিউবা। বাতিস্তা স্বৈরশাসক হলেও তাঁর সময়ে কিউবায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচক ভালো ছিল। বাতিস্তা মার্কিন মদদপুষ্ট শাসক ছিলেন। প্রভাবশালী প্রতিবেশীর সুনজর তাঁর ওপর ছিল। তাঁকে উৎখাত করায় শুরু থেকেই কাস্ত্রোর ওপর নাখোশ ছিল মার্কিন সরকার।

ক্ষমতায় এসে ধীরে ধীরে বিরোধীদের দমন করা শুরু করেন কাস্ত্রো। দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন তিনি। রাজবন্দী করে বহু মানুষকে কারাগার ও শ্রমশিবিরে পাঠানো হয়। হাজার হাজার মধ্যবিত্ত কিউবান দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এভাবে বিরোধীদের চোখে ‘একনায়কে’ পরিণত হন কাস্ত্রো।

যদিও বিশ্লেষকেরা মনে করেন, কাস্ত্রো অন্যান্য স্বৈরশাসকের মতো ছিলেন না। বিরোধীদের কঠোর হাতে দমন করলেও এ জন্য তিনি কিউবায় রক্তগঙ্গা বইয়ে দেননি। তিনি তাঁর সব স্বপ্ন পূরণ করতে পারেননি, তাঁর নীতির সঙ্গে সবাই একমতও হবেন না; কিন্তু তিনি তাঁর অঙ্গীকারে অনড় থেকেছেন সব সময়। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে এটা দুর্লভ এক গুণ।

১৯৬০ সালে কাস্ত্রো সরকার কিউবায় থাকা সব মার্কিন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে নিয়ে নেন। ক্ষুব্ধ মার্কিন শাসকেরা দেশটির ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। যা বহু বছর অব্যাহত ছিল।

চিলির কবি পাবলো নেরুদা বলেছিলেন, লাতিন আমেরিকার নেতারা অনেক প্রতিশ্রুতি দেন; কিন্তু পূরণ করেন সামান্যই। ফিদেল কাস্ত্রো এর ব্যতিক্রম। তিনি অদম্য এবং এটাই তাঁর বৈশিষ্ট্য।

কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস

যুক্তরাষ্ট্রের চক্ষুশূল হয়ে ওঠা এবং নিজের মতাদর্শের কারণে একসময় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকে পড়েন ফিদেল কাস্ত্রো। যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো শক্তিশালী হয়ে ওঠায় প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে ভারসাম্য আনতে কিউবায় পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করতে চায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। এতে মত দেন কাস্ত্রো। কিউবা পরিণত হয় ঠান্ডা যুদ্ধের যুদ্ধক্ষেত্রে। এ নিয়ে তৈরি সংকট ইতিহাসে  ‘কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস’ নামে পরিচিত।

‘বে অব পিগস ইনভেনশন’

১৯৬১ সালে কাস্ত্রো হাভানায় মার্কিন দূতাবাসের ৩০০ সদস্যের কর্মীর সংখ্যা কমানোর নির্দেশ দেন। তাঁর সন্দেহ ছিল, দূতাবাসের এই কর্মীদের বেশির ভাগই আসলে গুপ্তচর। কিউবার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এর জবাব দেয় ওয়াশিংটন।

এর পরই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ কাস্ত্রোকে উৎখাতের নীলনকশা তৈরি করে। তারা কিউবা থেকে নির্বাসিত সশস্ত্র বিরোধীদের অর্থায়ন শুরু করে। সশস্ত্র ওই গোষ্ঠী কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য করা জাহাজে আক্রমণ এবং কিউবায় কারখানা, দোকান ও চিনিকলে বোমা হামলা করতে থাকে।

১৯৬১ সালের এপ্রিলে সিআইএর পরিকল্পনায় সশস্ত্র বিদ্রোহীরা পিগস উপসাগরে আক্রমণ করে। কাস্ত্রোর সামরিক বাহিনী তাদের পরাস্ত করে। পররাষ্ট্র বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব পরিকল্পনা দারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে, তার অন্যতম এই ‘বে অব পিগস ইনভেনশন’।

আর্জেন্টিনার বিপ্লবী নেতা আর্নেস্তো চে গুয়েভারার সঙ্গে আলাপকালে কিউবার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ফিদেল কাস্ত্রো (ডানে)। ছবিটি ষাটের দশকে তোলা

৬৩৮ বার হত্যার চেষ্টা!

কাস্ত্রো একসময় যেন যুক্তরাষ্ট্রের ১ নম্বর শত্রুতে পরিণত হন। তাঁকে একবার-দুবার নয়, ৬৩৮ বার হত্যার চেষ্টা করে মার্কিন গুপ্তঘাতকেরা। কাস্ত্রোকে হত্যাচেষ্টার বেশির ভাগই হয় ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৩ সালের মধ্যে। এ সময়ে পাঁচ ভাগে সিআইএ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষাবাহিনী ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র বিভাগ তাঁকে হত্যার বিভিন্ন চেষ্টা চালায়।

ফেবিয়ান এসকালান্তে কাস্ত্রোর দেহরক্ষী ছিলেন। ৪৯ বছরের শাসনামলের পুরো সময় তিনি কাস্ত্রোর নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর ভাষ্যমতে, ৬৩৮ বার কাস্ত্রোকে হত্যার চেষ্টা করে মার্কিন গুপ্তচরেরা। প্রতিটি ষড়যন্ত্র ছিল অভিনব। এমনকি কাস্ত্রোর চুরুটের মধ্যে পর্যন্ত বিস্ফোরক রেখে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের একের পর ষড়যন্ত্রের মুখে ১৯৮৮ সালে কাস্ত্রো ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রই আমাকে কিংবদন্তি করে তুলেছে।’

ব্যক্তিগত জীবন

১৯২৬ সালের ১৩ আগস্ট জন্ম হয় ফিদেল আলেহান্দ্রো কাস্ত্রো রুৎজের। স্পেন থেকে কিউবায় চলে আসা ধনী কৃষক আনহেল মারিয়া বাউতিস্তা কাস্ত্রোর সন্তান তিনি। তাঁর মা ছিলেন সামান্য খামার কর্মী, নাম লীনা রুৎজ গঞ্জালেজ। একসময় বাউতিস্তা কাস্ত্রো তাঁর খামারকর্মী লিনা রুৎজকে স্ত্রী করে নেন।

ক্ষমতা হস্তান্তর ও মৃত্যু

২০০৮ সালে ভাই রাউল কাস্ত্রোর হাতে দেশের শাসনভার তুলে দিয়ে অবসরে যান ফিদেল কাস্ত্রো। তিনি ৪৯ বছর কিউবা শাসন করেছেন। রাজতন্ত্রের বাইরে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কোনো দেশ শাসন করা নেতাদের একজন তিনি।

রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর পরও কিউবাতে ফিদেল কাস্ত্রোর প্রভাব থেকে গেছে, এমন কি বিশ্বেও।

২০১৬ সালের ২৫ নভেম্বর কাস্ত্রো মারা যান। সমাপ্তি ঘটে সফল এক বিপ্লবীর বর্ণিল জীবনের।