ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিতে চায়, নিজেদের নিরাপত্তার হুমকির কারণে বিরোধিতা করে আসছে রাশিয়া। এ নিয়ে নানা চাপান–উতোরের মধ্যে গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্য যুদ্ধ শুরু হয়। বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। এরপর রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় অর্থনীতি সচল রাখতে নানা উদ্যোগ নেয় ভ্লাদিমির পুতিনের দেশটি।
মিত্রদেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ায়। চীন ও ভারত এ ক্ষেত্রে এগিয়ে। বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে নিজের মুদ্রাকে ব্যবহার করে চীন ও রাশিয়া। এর পুরস্কারও পেয়েছে তারা। এক বছরের মধ্যে রাশিয়ার বাজারে লেনদেনের হিসাবে ডলারকে হটিয়ে শীর্ষে উঠে আসতে শুরু করে চীনের মুদ্রা ইউয়ান। দ্য স্ট্রেট টাইমসের প্রতিবেদনে রাশিয়ায় আমেরিকার মুদ্রা ডলারকে সরিয়ে চীনের মুদ্রার আধিপত্যের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
গত বছরের আগষ্টের হিসেবে, চীনের বাইরে চীনা মুদ্রা ইউয়ানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক লেনদেন সম্পন্নের ক্ষেত্রে বিশ্বে তৃতীয় স্থানে ছিল রাশিয়া। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ফলেই এমনটা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন যুদ্ধের আগে সুইফটের মাসিক তালিকায়ও ছিলো না রাশিয়া। তবে আগস্টে প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ইউয়ান ব্যবহারে রাশিয়ার আগে রয়েছে কেবল হংকং এবং ব্রিটেন।
মস্কোর হিসাবের ভিত্তি ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুদ্ধ শুরুর পরে প্রথমবারের মতো ফেব্রুয়ারি মাসে মাসওয়ারি লেনদেনে ডলারের তুলনায় এগিয়ে ছিল ইউয়ান। মার্চ মাসে ইউয়ানের সঙ্গে ডলারের এ ব্যবধান আরও স্পষ্ট হয়েছে। ইউক্রেনে আক্রমণের আগে, রাশিয়ার বাজারে ইউয়ান লেনদেনের পরিমাণ ছিল খুবই সামান্য। তবে আগের হিসাব ছাড়িয়ে নতুন রেকর্ড গড়েছে চীনের মুদ্রাটি।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। এ ঘটনার পর নানা নিষেধাজ্ঞার কারণে পশ্চিমাদের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। অস্ত্রের যুদ্ধ বাইরেও শুরু হয় অর্থনীতি নিয়ে আরেক যুদ্ধ। জ্বালানি শক্তির কারণে পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক যুদ্ধ রাশিয়ার ওপর খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারেনি। উল্টো জ্বালানি সরবরাহকে হাতিয়ার করে পশ্চিমা দেশগুলোকে একহাত নিয়েছে রাশিয়া। ভারত ও চীনে জ্বালানি বেচে নিজের পকেট তাজা রেখেছে পুতিন।
পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার কারণে চীনের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে। আবার নির্বাচিত হওয়ার পর গত মার্চ মাসে মস্কোতে প্রথম বিদেশ সফরে যান চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। এ সফরে ক্রেমলিনের সঙ্গে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সরবরাহ, বড় বড় প্রকল্প এবং জ্বালানিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা আরও সম্প্রসারণের প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।
রাশিয়ার আর্থিক ব্যবস্থাকে লক্ষ্য করে ব্যাপক নিষেধাজ্ঞায় নড়েচড়ে বসে ক্রেমলিন। রাশিয়া তার আর্থিক সংস্থাগুলোকে বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেনে ডলার এবং ইউরো থেকে বেরিয়ে দেশগুলোর সঙ্গে নিজেদের মুদ্রায় ব্যবসা করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাধ্যও করেছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, আর্থিক ব্যবস্থায় পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলায় ক্রেমলিন ও রুশ কোম্পানিগুলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলার ও ইউরোর পরিবর্তে ভিন্ন মুদ্রা বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। এ ক্ষেত্রে এমন দেশগুলোর মুদ্রা ব্যবহার করছে, যারা পশ্চিমাদের বিধিনিষেধে সমর্থন দেয়নি।
রাশিয়ার অর্থ মন্ত্রণালয় এ বছরের শুরুতে ডলারের পরিবর্তে চীনের সঙ্গে ইউয়ানে লেনদেন করে। পাশাপাশি জাতীয় সম্পদ তহবিলের জন্য একটি নতুন কাঠামো তৈরি করে। এ তহবিলের ৬০ শতাংশ ইউয়ানে রূপান্তর করে। রাশিয়ার ব্যাংক নিয়মিতভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকদের সম্পদ রুবল বা মিত্রদেশগুলোর মুদ্রায় রূপান্তরের আহ্বান জানায়। এতে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ফলে সৃষ্ট সম্ভাব্য ঝুঁকি এড়ায় রাশিয়া।
এদিকে ব্লুমবার্গ এক্সচেঞ্জ ডেটা অনুসারে, এত কিছু সত্ত্বেও, মার্কিন ডলার এখন পর্যন্ত রাশিয়ায় মুদ্রাবাজারে সর্বাধিক জনপ্রিয় মুদ্রা। হয়তো কোনো কোনো দিনে ব্যবসায় লেনদেনে (ট্রেডিং) চীনের মুদ্রার কাছে হেরেছে ডলার। তবে ইউয়ানও রাশিয়ার বাজারে দিনে দিনে জনপ্রিয় হচ্ছে। লেনদেন হিসেবে আয়তনের দিক থেকে ইউয়ানের তুলনায় খুব বেশি পিছিয়ে থাকে না আন্তর্জাতিক বিনিময় মুদ্রা ডলার।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, মূলধন হিসাব ব্যবস্থাপনা ও বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ভূরাজনৈতিক উদ্বেগগুলোর অন্যতম প্রতিবন্ধকতা চীনের মুদ্রা ইউয়ান। বেইজিং আন্তর্জাতিক পরিসরে নিজেদের মুদ্রার লেনদেন বিস্তৃত করতে চায়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্যানুযায়ী, গত বছরের শেষের দিকে বৈশ্বিক মুদ্রা রিজার্ভের প্রায় ২ দশমিক ৭ শতাংশ ছিল ইউয়ানে, যা প্রথম প্রান্তিকে (প্রথম তিন মাস) ২ দশমিক ৯ শতাংশের তুলনায় কম।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক করপোরেট পরিষেবা সংস্থা আইটিআই লন্ডনের স্ট্র্যাটেজিস্ট ইস্কান্দার লুৎস্কো বলেন, এখন রাশিয়ার বাজারে ডলারের সংখ্যা কম। কেননা জ্বালানি তেলের দাম এবং রপ্তানি কমে যাওয়ায় রাশিয়ার আয় কমেছে। একই সময়ে রাশিয়া থেকে চীনে পণ্য আমদানি বেড়েছে ২৯ শতাংশ, যদিও চীন থেকে রপ্তানি স্থিতিশীল রয়েছে।