বৈশ্বিক কর্তৃত্ব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জেরে বিগত বছরগুলোর মতো এ বছরও আলোচনায় ছিল চীন। ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর মস্কোর ঘনিষ্ঠ মিত্র কমিউনিস্ট শাসিত চীন কী ভূমিকা নেয়, তার ওপর নজর ছিল সবার। তবে অনেকটা নিরপেক্ষ ভূমিকাই নিয়েছে ‘হিসেবি’ বেইজিং। এ যুদ্ধের ডামাডোলে কিছুটা আড়ালে চলে যায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যযুদ্ধ। তবে এরপরও যুক্তরাষ্ট্রের চিরাচরিত চাপ থেকে মুক্তি পায়নি ক্রমশ আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক দিক দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে থাকা চীন। এর মধ্যে বছরের শেষ ভাগে এসে তাইওয়ানে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির সফর দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার পারদ নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়।
এ বছর ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসের ওপরও নজর ছিল বিশ্বের। তৃতীয় মেয়াদে সাধারণ সম্পাদক হয়ে চীনা পিপলস রিপাবলিকের প্রতিষ্ঠাতা মাও সে-তুংয়ের পরই নিজের অবস্থান পোক্ত করেছেন সি চিন পিং। অবশ্য করোনাভাইরাস মহামারি ঠেকাতে নেওয়া কঠোর ‘শূন্য কোভিড’ নীতির বিরুদ্ধে বছর শেষে ছড়িয়ে পড়া বিরল বিক্ষোভ তাঁর মহাপরাক্রম ভাবমূর্তিকে কিছুটা ম্লান করে দেয়।
আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের কারণে চীন বেশ নাখোশ হয়। চীন শুধু প্রতিবাদ করে বা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েই থেমে থাকেনি, বরং তাঁর সফরের সময়েই তাইওয়ানের পণ্য আমদানি ও প্রতিবেশী দেশটিতে সিলিকন রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বেইজিং। আর পেলোসির সফর শেষ হওয়ার পরদিনই তাইওয়ানের চারপাশে বিশাল সামরিক মহড়া শুরু করে চীন।
এতে মোতায়েন করা হয় যুদ্ধজাহাজ, যুদ্ধবিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র। ১৯৯৬ সালের পর এটাই ছিল চীনের সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়া। পেলোসি ও তাঁর পরিবারের ওপর নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে চীন।
তাইওয়ানে চীনের সিলিকন রপ্তানি বন্ধের ঘোষণার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। সেমিকন্ডাক্টর তৈরির জন্য অপরিহার্য উপাদান সিলিকন রপ্তানির ওপর চীনের নিষেধাজ্ঞা যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় ও উন্নত দেশগুলোকে বিপাকে ফেলতে পারে বলে মনে করা হয়। বিশেষ করে চীনের সিলিকন রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বেশ ক্ষতিকর হতে পারে। ইউএন কমট্রেড ডেটা অনুযায়ী, ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ১০ হাজার ৫৭০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে তাইওয়ান। এ রপ্তানির বেশির ভাগই ছিল তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) ও ইলেকট্রনিকস খাতের পণ্য।
মুঠোফোন থেকে শুরু করে ল্যাপটপ, বৈদ্যুতিক গাড়িসহ সব ধরনের ইলেকট্রনিকস পণ্য তৈরিতে প্রয়োজন হয় চিপের। অ্যাপল, কোয়ালকম ও এনভিডিয়ার মতো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈশ্বিক প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো তাইওয়ানের সেমিকন্ডাক্টর প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর তৈরি করা চিপের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।
এমনিতেই করোনা মহামারির প্রভাবের পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চিপের ঘাটতিতে ভুগছিল মার্কিন প্রযুক্তি ও ইলেকট্রনিকস কোম্পানিগুলো। এ অবস্থায় তাইওয়ানে চীনের সিলিকন রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ চলমান চিপঘাটতিকে আরও প্রকট করে তোলার আশঙ্কা দেখা দেয়।
পরিস্থিতি সামাল দিতে বিকল্প চিপ উৎপাদনকারীদের নিয়ে জোট গঠনের উদ্যোগ নেয় যুক্তরাষ্ট্র। প্রস্তাবিত চিপ উৎপাদনকারী জোট চিপ-৪ গ্রুপে সক্রিয় হতে রাজি হয় তাইওয়ান। নিজ দেশের কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা ও চিপের সরবরাহ নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করার ঘোষণা দেয় দেশটি। যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক বৈঠকের পর তাইওয়ানের উপ-অর্থমন্ত্রী চেন চের-চি এ সিদ্ধান্তের কথা জানান। যুক্তরাষ্ট্র, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান—এই চারটি দেশ বিশ্বের বেশির ভাগ সেমিকন্ডাক্টর চিপ তৈরি করে থাকে।
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের উত্তেজনার পারদ কমাতে ভূমিকা রাখে জি-২০ সম্মেলন। ইন্দোনেশিয়ার বালিতে এ জোটের শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে বৈঠক করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। বৈঠকে দুই নেতা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে চলমান বিরোধ কমিয়ে আনতে ঐকমত্যে পৌঁছান। ওই বৈঠকের মধ্য দিয়ে বাইডেন ও সি আপাতত দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের উত্তপ্ত অবস্থাকে শীতল করেছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
গত ১৬ অক্টোবর চীনের ক্ষমতাসীন দল চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) সপ্তাহব্যাপী জাতীয় কংগ্রেস শুরু হয়। এ কংগ্রেস ঘিরে কৌতূহলের অন্যতম জায়গা ছিল, দলের সাধারণ সম্পাদক পদে সি চিন পিং থাকছেন কি না। সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে সিকে দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আরও পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত করে কেন্দ্রীয় কমিটি। ফলে আগামী মেয়াদেও চীনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পেতে যাচ্ছেন তিনি। তৃতীয় মেয়াদ নিশ্চিতের মধ্য দিয়ে চীনের সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক মাও সে-তুংয়ের পরই সির অবস্থান পোক্ত হলো। কংগ্রেসে সির ক্ষমতা বাড়িয়ে সংশোধিত দলীয় গঠনতন্ত্র অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ সংশোধনীর উদ্দেশ্য ছিল সির মূল অবস্থান (স্ট্যাটাস) এবং দলের মধ্যে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারার দিকনির্দেশক ভূমিকাকে পোক্ত করা।
বেইজিংয়ের গ্রেট হলে কংগ্রেসের সমাপনী পর্বে উপস্থিত ছিলেন দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট হু জিনতাও। হঠাৎ সেখান থেকে তাঁকে সরিয়ে নেওয়া হয়। ওই ঘটনার ভিডিও দেখে মনে হয়েছে, হু জিনতাওয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁকে গ্রেট হল থেকে বের করে নেওয়া হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নামে সি চিন পিং তাঁর বিরোধী মতের সবাইকে রাজনীতির ময়দান থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী লি কেছিয়াংসহ সির সঙ্গে দূরত্ব আছে, এমন কয়েক প্রভাবশালী নেতারও ঠাঁই হয়নি এবারের কমিটিতে।
চীনের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ২০১২ সালে সি ক্ষমতা গ্রহণ করেন। বিশ্লেষকদের অনেকেই তখন ধারণা করেছিলেন, চীনের ইতিহাসে কমিউনিস্ট পার্টির সবচেয়ে উদার নেতা হতে যাচ্ছেন তিনি। এক দশক পরে দেখা যাচ্ছে, বিশ্লেষকদের ওই মনোভাবের অনেক কিছুই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সি নিজ দেশের একজন আইকনিক নেতায় পরিণত হয়েছেন। বিশ্লেষকেরা এখন বলছেন, সি চিন পিং তাঁর লক্ষ্য অর্জনে অবিচল, ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণু এবং এমনকি আধুনিক চীনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অভিলাষ রয়েছে তাঁর।
করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে ‘শূন্য কোভিড নীতিকে’ বড় অর্জন হিসেবে দেখিয়ে আসছিল চীনের কমিউনিস্ট নেতৃত্ব। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ যখন মহামারিতে ধরাশায়ী, তখনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল করোনাভাইরাসের আঁতুড়ঘর চীন। তবে এ বছরের শেষে এসে বিরল বিক্ষোভে বড় ধাক্কা খায় চীনের কোভিড নীতি। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াং প্রদেশের রাজধানী উরুমকির এক অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১০ জন নিহত হন। তাঁদের ভবনে আটকে পড়া ও উদ্ধার তৎপরতা ব্যাহত হওয়ার জন্য করোনার বিধিনিষেধকে দায়ী করা হয়।
এরপর সাংহাইসহ দেশটির বড় শহরগুলোতে বিরল বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সাংহাইয়ের রাস্তায় এক বিক্ষোভকারী স্লোগান তুলছিলেন, ‘সি চিন পিং!’ পরক্ষণে শত শত মানুষ গলা মিলিয়ে বলেন, ‘স্টেপ ডাউন (পদত্যাগ করো)!’ বিক্ষোভকারীরা স্লোগানে আরও বলেন, ‘কমিউনিস্ট পার্টি/ক্ষমতা ছাড়ো!’ চীনের নাগরিকদের এবারের প্রতিবাদ, ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের তাৎপর্য ভিন্ন। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের পদত্যাগের দাবিতে স্লোগান শোনা ক্ষমতাসীনদের জন্য কতটা পীড়াদায়ক, তা ব্যাখ্যা করা কঠিন।
শেষ পর্যন্ত করোনা বিধিনিষেধ শিথিল করতে বাধ্য হয় চীন সরকার। অবশ্য এ সিদ্ধান্ত দেশটির জনগণের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনেনি। দেশটিতে ব্যাপক হারে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বেড়েছে। ওষুধের সংকট দেখা দিয়েছে। মরদেহ সৎকারে দেশটির শ্মশানগুলো হিমশিম খাচ্ছে বলে দাবি করেছে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো। অবশ্য সংক্রমণের ব্যাপকতা যে ভয়াবহ, সেটা চীনের কর্মকর্তাদের কথাতেই উঠে এসেছে। ফলে প্রায় দুই বছরের কঠোর ‘শূন্য কোভিড নীতির’ ফলাফল শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াল, সে প্রশ্ন উঠেছে।
বছর শেষে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সৌদি আরব সফর ছিল আলোচনায়। সাত বছর পর ডিসেম্বরে তিনি মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশটি সফরে যান। তাঁর এ সফরকালে বিশ্বের শীর্ষ তেল রপ্তানিকারক দেশটির সঙ্গে কৌশলগত চুক্তি সই করেছে চীন। আরব বিশ্বের নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করেন চীনের প্রেসিডেন্ট। তেল নিয়ে সৌদি-যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েনের মধ্যে চীনের প্রেসিডেন্টের রিয়াদে এ সফর চীন ও উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর করার ইঙ্গিত দেয়।
সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার চীন। আরব দেশটির ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগের উৎসও বেইজিং। বিশ্বে জ্বালানির সবচেয়ে বড় ক্রেতা চীন। তবে জ্বালানিনিরাপত্তার বাইরেও মধ্যপ্রাচ্যে ভূরাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধিতে চীনকে সহায়তা করতে পারে সৌদি। চীনা মুদ্রায় লেনদেনেও বাড়তি সুবিধা দিতে পারে রিয়াদ। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন ডলারের পরিবর্তে চীনা মুদ্রা ইউয়ানে তেলের মূল্য পরিশোধে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। এ ধরনের চুক্তি চীনা মুদ্রার বৈশ্বিক প্রভাব বাড়ানোর ক্ষেত্রে বেইজিংয়ের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে উৎসাহিত করতে পারে। এতে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী চুক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে বাইডেন প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি সৌদি সরকারকে উদ্বেগে রেখেছে। এ জন্য হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে এগিয়ে থাকার ও দর-কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে চীনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সম্পর্ককে কাজে লাগাতে চায় রিয়াদ। অন্যদিকে আফ্রিকা মহাদেশে ইতিমধ্যে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করেছে বেইজিং। ঘরে-বাইরে চাপ সত্ত্বেও পরাশক্তি হওয়ার পথে এবার মধ্যপ্রাচ্য নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রকে বার্তা দিয়ে রাখল সি চিন পিংয়ের চীন।