চীনের পক্ষ থেকে বিশ্বকে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তার সামরিক শক্তি বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে। এর সরাসরি উত্তাপ টের পাচ্ছে তাইওয়ান। গত জানুয়ারি মাসে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর থেকে সেখানে একাধারে সাইবার আক্রমণ ও ভুয়া তথ্য প্রচার বেড়ে গেছে।
তাইওয়ান নিজেকে স্বাধীন সার্বভৌম মনে করে। অন্যদিকে তাইওয়ানকে নিজেদের অংশ বলে দাবি করে চীন। দেশটি আট বছর ধরে স্বশাসিত তাইওয়ানের প্রতি হুমকি বাড়িয়ে চলছে। তাইওয়ানকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগের কথাও বলে আসছে বেইজিং। গত মাসে তাইওয়ানের সরকার গঠনের পর থেকে চীনের সামরিক বাহিনী তাদের সামরিক সক্ষমতা প্রদর্শন শুরু করেছে। সম্প্রতি তাইওয়ান ঘিরে দুই দিনের সামরিক মহড়াও চালিয়েছে চীন।
ওই মহড়ার পর চীনের একজন সামরিক মুখপাত্র বলেন, তাইওয়ানের নিয়ন্ত্রণ নিতে তাঁদের সামরিক বাহিনী পুরোপুরি প্রস্তুত ও সতর্ক রয়েছে। গত মে মাসে চীনের নতুন ও অত্যন্ত উন্নত রণতরী সাংহাই থেকে সমুদ্রে পরীক্ষামূলক যাত্রা শুরু করেছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের পর নৌবাহিনীতে সবচেয়ে বেশি যুদ্ধবিমানবাহী রণতরী যুক্ত করা দেশ হলো চীন।
সামরিক খাতে ব্যাপক ক্ষমতা বাড়ানোর পরও কয়েকজন বিশ্লেষক দেশটির প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের এই সেনাবাহিনী নিয়ে আত্মবিশ্বাস কতখানি, এ প্রশ্ন তুলেছেন। তবে গত সপ্তাহে চীনের প্রেসিডেন্ট এ উদ্বেগ দূর করেছেন। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর ভেতরে অনেক সমস্যা গেড়ে বসেছিল। তাই সেখানে পরিবর্তন প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। গত এপ্রিল মাসে চীনের সেনাবাহিনীতে বড় ধরনের রদবদল করেন তিনি। এক দশকের মধ্যে চীনের সেনাবাহিনীতে এত বড় পরিবর্তন করা হয়নি।
সিঙ্গাপুরের নানিয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির ইয়াং জি নামের এক গবেষক বলেন, এটি একটি ধাক্কা হিসেবে এসেছিল। এ থেকে দেখা যায়, বিদ্যমান কাঠামো এবং চীনা সামরিক বাহিনীর বর্তমান সক্ষমতা নিয়ে সি সন্তুষ্ট ছিলেন না।
* তাইওয়ানকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগের কথাও বলে আসছে বেইজিং।* গত মে মাসে চীনের নতুন ও অত্যন্ত উন্নত রণতরী সাংহাই থেকে সমুদ্রে পরীক্ষামূলক যাত্রা শুরু করেছে।
অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, সেনাবাহিনী পুনর্গঠনের সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত উপাদান ছিল স্ট্র্যাটেজিক সাপোর্ট ফোর্স (এসএসএফ) নির্মূল করা। তাইওয়ানের নিরাপত্তা গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি রিসার্চের (আইএনডিএসআর) রিসার্চ ফেলো ক্রিস্টিনা চেন বলেন, ‘সামরিক বাহিনীর অন্যান্য বিভাগে সমস্যা ছিল। তাই সেখানে শুদ্ধি অভিযান ও দুর্নীতির তদন্ত হয়েছে। তবে আমরা এসএসএফ নিয়ে এ ধরনের কথা শুনিনি। তাই এসএসএফের পুনর্গঠনের কোনো ইঙ্গিত ছিল না।’
এই এসএসএফ গঠনের সঙ্গে সি নিজেই যুক্ত ছিলেন। ২০১৫ সালে চীনের সেনাবাহিনী পুনর্গঠনের সময় তিনি এ বাহিনী গঠন করেন। এসএসএফ ছিল বিশেষ এক বাহিনী, যাদের কাজ ছিল সশস্ত্র বাহিনীর মহাকাশ ও সাইবার যুদ্ধের ক্ষমতার বিকাশকে ত্বরান্বিত করা এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে সেবা ও তথ্য সরবরাহের বিষয়ে উন্নতি করা।
চেনের মতে, এসএসএফের বিলুপ্তি প্রমাণ করে এর সক্ষমতার ওপর আস্থা হারিয়েছিলেন সি। এর পরিবর্তে এখন মহাকাশ, তথ্য ও সাইবার যুদ্ধের ক্ষেত্রগুলো সরাসরি কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের তত্ত্বাবধানে তাদের নিজস্ব বিভাগের মধ্যে স্থাপন করা হচ্ছে। এর প্রধান থাকছেন সি।
চীনের প্রেসিডেন্ট পুনর্গঠনের ঘোষণার সময় বলেন, চীনা সামরিক বাহিনীকে আধুনিক যুগের যুদ্ধে জয়ী হতে সাহায্য করার জন্য নতুন কাঠামো গুরুত্বপূর্ণ হবে।
চেন মনে করেন, আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে। বেইজিং এখন এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ হতে চায়। তাই তারা সেনাবাহিনী পুনর্গঠন করছে।
ইতিমধ্যে দক্ষিণ চীন সাগর, পূর্ব চীন সাগর ও তাইওয়ান প্রণালি ঘিরে ওয়াশিংটন ও বেইজিং মুখোমুখি। সম্প্রতি বেইজিংয়ের সঙ্গে ম্যানিলার উত্তেজনা নিয়ে ওয়াশিংটন নিন্দা জানিয়েছে। বেইজিংয়ের প্রতি অভিযোগ করে ওয়াশিংটন বলেছে, আগ্রাসী আচরণ করে আঞ্চলিক শান্তি নষ্ট করছে তারা। অন্যদিকে বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে ওয়াশিংটনকে এশিয়া অঞ্চলে নাক গলানোর অভিযোগ করা হয়েছে।
চীনের সেনাবাহিনীর পুনর্গঠনের বিষয়টিকে তাদের সামরিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শুদ্ধি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। সেনাবাহিনীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বকে সরিয়ে দেওয়া বা বরখাস্ত করা হয়েছে। বেশির ভাগ পরিবর্তন এসেছে সশস্ত্র বাহিনীর রকেট ফোর্সের মধ্যে। এ বাহিনী বেইজিংয়ের কৌশলগত ও পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের দায়িত্বে রয়েছে।
ইয়াং বলেন, ‘আমরা আগে যা ধারণা করেছি, এ তুলনায় রকেট ফোর্স প্রয়োজনীয় সময়ে ততটা প্রস্তুত নয়। এ বাহিনীর পরিবর্তন তারই ইঙ্গিত দেয়। এর বাইরে গত বছর গুরুত্বপূর্ণ অনেককেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও এসএসএফের ডেপুটি কমান্ডার লি সাংফুকে গত বছর সরিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে।’
ইয়াংয়ের দৃষ্টিতে, শুদ্ধিকরণ ও সাম্প্রতিক সামরিক পুনর্গঠন ইঙ্গিত করে যে সাম্প্রতিক সময়ে পদোন্নতি বা পূর্ববর্তী সংস্কারে যে কমান্ডাররা পদোন্নতি ও কাঠামোগত পরিবর্তনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের প্রতি সির খুব কমই আস্থা রয়েছে।
সাম্প্রতিক একটি সামরিক সম্মেলনে সি বলেছেন, সামরিক কর্মকর্তাদের, বিশেষ করে জ্যেষ্ঠ স্তরের কর্মীদের মর্যাদা এক পাশে সরিয়ে রেখে তাঁদের ত্রুটিগুলো স্বীকার করার সাহস থাকতে হবে। তাঁদের অবশ্যই গভীরভাবে আত্মপ্রতিফলন করতে হবে। আন্তরিক সংশোধন করতে হবে। তাঁদের চিন্তার মূলে থাকা সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে।
তাইওয়ানের জনগণকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার নেই চীনের: লাই চিং
চীনের পক্ষ থেকে তাইওয়ানের স্বাধীনতাকামীদের বার্তা দেওয়ার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে তাইপে। তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লাই চিং তে বলেছেন, তাইওয়ানের জনগণকে শাস্তি দেওয়ার বা তাঁদের অধিকার খর্ব করার কোনো এখতিয়ার নেই চীনের। তাইওয়ানের স্বাধীনতার কট্টরপন্থী সমর্থকদের মৃত্যুদণ্ড দিতে চীনের হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে গত সোমবার তিনি এ কথা বলেন। খবর রয়টার্সের
তাইপেতে প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ে লাই চিং সাংবাদিকদের বলেন, চীনের উচিত তাইওয়ানের বৈধভাবে নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে কথা বলা এবং দেশটির অস্তিত্ব স্বীকার করে নেওয়া। তা না হলে দুই পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক আরও খারাপ হবে।
২১ জুন তাইওয়ানের স্বাধীনতার পক্ষের কট্টর সমর্থকদের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিষয়টি বিচারিক নির্দেশিকায় যুক্ত করে চীন। ফৌজদারি অপরাধের বিশেষ গুরুতর মামলার ক্ষেত্রে এ শাস্তি প্রযোজ্য হবে বলে উল্লেখ করা হয় এতে।
নির্দেশনায় বলা হয়, তাইওয়ানের স্বাধীনতার পক্ষে যাঁরা ওকালতি করবেন, তাঁদের ১০ বছর থেকে শুরু করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। স্বাধীনতার প্রচেষ্টায় যাঁরা মূল ভূমিকা নেওয়ার চেষ্টা করবেন এবং রাষ্ট্র ও জনগণের মারাত্মক ক্ষতি করবেন, তাঁদের এ শাস্তি দেওয়া হবে।