রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে স্বাগত জানিয়েছে বেইজিং। চীনে রাষ্ট্রীয় এই সফর শুরুর আগে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের মাত্রাকে ‘নজিরবিহীন’ বলে প্রশংসা করেছেন তিনি।
ইউক্রেনে রাশিয়ার চলা যুদ্ধ দুই বছরের বেশি সময় পার হয়েছে। এ সময়ে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হয়ে উঠেছে চীন। ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান চালানোর নিন্দা জানাতে বেইজিং শুধু অস্বীকৃতিই জানায়নি; বরং পশ্চিমাদের ব্যাপক নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন মস্কোর সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কও বজায় রেখেছে। রাশিয়ার প্রতি চীনের এমন আগ্রহ যুক্তরাষ্ট্র ও এর ইউরোপীয় মিত্রদের জন্য যথেষ্ট ক্ষোভের কারণ।
যাহোক, পুতিন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাষ্ট্র চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের কাছে দৃশ্যত আরও কিছু চান। প্রশ্ন উঠেছে, চীন কি এ মূল্য চোকাতে প্রস্তুত?
চীনের এমন অবস্থান যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের কাছে একটি রেডলাইন (চূড়ান্ত সীমা) হয়ে উঠেছে। তবে চীন বলেছে, ইউক্রেন বিষয়ে তার অবস্থান নিরপেক্ষ এবং যুদ্ধের বাইরে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করার জন্য প্রযুক্তি ও উপকরণের ওই রপ্তানি নিয়মকানুন ভাঙছে না।
পঞ্চম দফায় গত সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন রাশিয়ার নেতা পুতিন। নতুন দফায় শপথ নিয়ে প্রথম সফরেই চীনকে তাঁর বেছে নেওয়ার মধ্যে সম্ভবত বিস্ময়ের কিছু নেই। তাঁর দুই দিনের এই রাষ্ট্রীয় সফর এমন এক সময় হচ্ছে, যখন উভয় দেশের সম্পর্ক ‘এযাবৎকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে’ পৌঁছেছে। যেমনটা চীনের সরকারি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন তিনি। চীনের মার্শাল আর্ট ও দর্শনের প্রতি পুতিন তাঁর আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। বলেছেন, তাঁর পরিবারের কেউ কেউ চীনের ভাষা মান্দারিন শিখছেন।
পুতিন বলেছেন, ‘এক জটিল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমাদের সম্পর্ক এখনো দৃঢ় হচ্ছে।’
চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব নিয়ে পুতিন যত আস্ফালনই করুন না কেন, প্রেসিডেন্ট সির চিন্তিত হওয়ার কারণ রয়েছে।
চীন পশ্চিমা প্রভাব ক্ষুণ্ন করার লক্ষ্য সমর্থন করে। কিন্তু রাশিয়ার কিছু কৌশলের সঙ্গে একমত নয়; যার একটি, মস্কোর পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করার হুমকি। রাশিয়াকে নিঃশর্ত সমর্থন দেওয়ার পরিণাম সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত আছে চীন। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে তুলতে দেশটি তার কৌশলগুলো প্রতিনিয়ত সংশোধন করছে।ঝাও টং, গবেষণা প্রতিষ্ঠান কার্নেগি এনডাউমেন্টের জ্যেষ্ঠ ফেলো
রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞা ভাঙতে সহায়তা করার অভিযোগে মস্কোর সঙ্গে কাজ করা বেইজিং ও হংকংভিত্তিক ব্যাংক এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সবে নতুন দফা নিষেধাজ্ঞার কথা ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
কেননা রাশিয়ার কাছে চীন অস্ত্র বিক্রি না করলেও ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলসের ধারণা, ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য অপরিহার্য প্রযুক্তি ও উপকরণ মস্কোয় রপ্তানি করছে দেশটি। বেইজিংয়ে সাম্প্রতিক সফরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বিবিসিকে বলেন, স্নায়ুযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপের নিরাপত্তায় দেখা দেওয়া সবচেয়ে বড় হুমকিতে উসকানিমূলক সহায়তা দিচ্ছে চীন।
চীনের এমন অবস্থান যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের কাছে একটি রেডলাইন (চূড়ান্ত সীমা) হয়ে উঠেছে। তবে চীন বলেছে, ইউক্রেন বিষয়ে তার অবস্থান নিরপেক্ষ এবং যুদ্ধের বাইরে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করার জন্য প্রযুক্তি ও উপকরণের ওই রপ্তানি নিয়মকানুন ভাঙছে না।
বেইজিংয়ের এ বক্তব্য সত্ত্বেও গত সপ্তাহে ফ্রান্স সফরে প্রেসিডেন্ট সিকে নানা অভিযোগের সম্মুখীন হতে হয়।
চীন নিয়ে সংশয়বাদী ও দেশটির ব্যাপারে কঠোর মনোভাব পোষণকারীরাও প্রেসিডেন্ট সির প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছেন, তিনি যেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের ওপর আরও চাপ তৈরি করেন। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন চীনের ব্যাপারে নিজস্ব শুল্ক আরোপের বিষয়টি চিন্তাভাবনা করছে।
বাস্তবতা হলো, চীনের মন্থরগতির অর্থনীতি বাণিজ্যিক অংশীদারদের কাছ থেকে আসা এ চাপ মোকাবিলা করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। এদিকে মন্থর অর্থনীতিতে নিজ দেশে চাহিদা কম থাকার অর্থ হলো, চীনকে বাইরের বাজার ধরতে হবে। আর এসব অবস্থা প্রেসিডেন্ট সিকে এক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর কয় দিন আগে পুতিন ও সি নিজেদের মধ্যকার সহযোগিতা আরও গভীর করতে ‘সীমাহীন’ অংশীদারের কথা ঘোষণা করেছিলেন। পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে তাঁদের আদর্শিক লড়াইয়ের একধরনের বার্তাই তুলে ধরেছিল এটি।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার মোড় ঘোরাতে বেইজিং এখনো মস্কোকে গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ হিসেবে বিবেচনা করে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ছে। আবার রাশিয়ার সস্তা জ্বালানি চীনের জন্য সুবিধা এনে দিচ্ছে।
অবশ্য ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ চলতে থাকার প্রেক্ষাপটে মস্কো-বেইজিং সম্পর্ক আর ‘সীমাহীন’ পর্যায়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে না। বিবিসির এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে এ শব্দের ব্যবহার এখন এক রকম আর নেই।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কার্নেগি এনডাউমেন্টের জ্যেষ্ঠ ফেলো ঝাও টং বলেন, মস্কোর সঙ্গে নিজের কৌশলগত অংশীদারের ‘সীমাহীন প্রকৃতি’কে খাটো করে দেখাচ্ছে বেইজিং।
ঝাও বলেন, ‘চীন পশ্চিমা প্রভাব ক্ষুণ্ন করার লক্ষ্য সমর্থন করে। কিন্তু রাশিয়ার কিছু কৌশলের সঙ্গে একমত নয়; যার একটি, মস্কোর পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করার হুমকি। রাশিয়াকে নিঃশর্ত সমর্থন দেওয়ার পরিণাম সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত আছে চীন। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে তুলতে দেশটি তার কৌশলগুলো প্রতিনিয়ত সংশোধন করছে।’
সম্প্রতি ইউরোপ সফরে সি চিন পিং বলেছেন, তাঁর দেশ ‘এ সংকটের (ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট পরিস্থিতি) না কোনো স্রষ্টা, না কোনো অংশীদার বা এর কোনো অংশগ্রহণকারী।’ চীন তার নাগরিকদেরও দিচ্ছে একই বার্তা।
রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের ‘সীমাহীন’ মাত্রা নিয়ে বেইজিংয়ের ভেতর থেকেও ভিন্নমত আসছে। এতে এই ইঙ্গিত পাওয়া যায়, সীমাহীন সম্পর্ক সমর্থন করার ক্ষেত্রে চীনা জনগণের একাংশের মধ্যে ফাটল দেখা দিতে পারে।
ফুডান ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর রাশিয়ান অ্যান্ড সেন্ট্রাল এশিয়ান স্টাডিজের পরিচালক ফেং ইউজুন সম্প্রতি দ্য ইকোনমিস্টে লিখেছেন, রাশিয়া ইউক্রেনে হারবে, সেটি নিশ্চিত।
চীনেও এমন বক্তব্যের পক্ষে মতামত বেশ জোরাল। এমনকি প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ইঙ্গিত দিয়েছেন, তিনি এ সংকটে একজন শান্তির রক্ষক হতে পারেন।
গত মার্চে মস্কোয় রাষ্ট্রীয় সফরের মাত্র কয়েক দিন পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে ফোন করে সি জোরাল কণ্ঠে বলেন, চীন ‘সব সময় শান্তির পক্ষে’ দাঁড়াবে। সেই সঙ্গে ১২ দফার একটি শান্তি পরিকল্পনা প্রকাশ করে চীন। সেখানে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয়।
পুতিনের চলতি সফরে সি যখন তাঁর সঙ্গে বৈঠকে বসবেন, তখনো তাঁদের কেউ নিজ নীতি থেকে বিশেষভাবে সরে আসার ইঙ্গিত দেবেন বলে মনে করেন না বিশ্লেষকেরা।