ইউক্রেন যুদ্ধ আর বিশ্বজুড়ে অর্থনীতির মন্দাবস্থার মধ্যে এক সপ্তাহ ধরে আলোচনায় তাইওয়ান। মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির বিতর্কিত তাইওয়ান সফর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা চলছে। পেলোসির তাইওয়ান সফরের আগে থেকে ওয়াশিংটনকে নানা হুমকি দিচ্ছিল বেইজিং। বুধবার পেলোসির তাইওয়ান সফর শেষ হওয়ার পর বৃহস্পতিবার তাইওয়ানের চারপাশ ঘিরে এযাবৎকালে সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়া শুরু করেছে চীন। এর মধ্য দিয়ে কূটনৈতিক উত্তেজনা সামরিক সংঘাতে রূপ নেওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ শিগগির এ সংঘাত শুরুর ব্যাপারে সতর্ক করছেন।
কিন্তু সামরিক শক্তিতে কার সক্ষমতা কত? ২০২২ সালে গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের (জিএফপি) র্যাঙ্কিংয়ে ১৪২টি দেশের মধ্যে সামরিক বাহিনীর সক্ষমতার তালিকায় চীনের অবস্থান ৩ নম্বরে। আর তাইওয়ানের অবস্থান ২১ নম্বরে।
এদিকে যুক্তরাজ্যের দ্য এক্সপ্রেসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, তাইওয়ানের সঙ্গে তুলনায় চীনের সামরিক ক্ষমতা অনেক বেশি। দ্য মিলিটারি ব্যালেন্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ২০২২ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, চীনের সামরিক সক্ষমতা এত বেশি যে ভবিষ্যতে যেকোনো সংঘাত শুরু হলে এর বহুবিধ সুবিধা পাবে বেইজিং। তাইওয়ানের পক্ষে কুলিয়ে ওঠা হবে মুশকিল।
পিপলস লিবারেশন আর্মি বা পিএলএ নামে পরিচিত চীনের সামরিক বাহিনীতে এখন সক্রিয় সেনার সংখ্যা ২০ লাখ। অপর দিকে তাইওয়ানের সেনা বড়জোর ১ লাখ ৬৯ হাজারের মতো। অপর দিকে বেইজিংয়ের পদাতিক বাহিনীর সেনাসংখ্যা ৯ লাখ ৬৫ হাজার। তাইওয়ানের পদাতিক বাহিনীতে সদস্য আছেন ৯৪ হাজার। তাইওয়ানের জন্য বড় হুমকি চীনের নৌবাহিনী। চীনের নৌবাহিনীর সদস্য ২ লাখ ৬০ হাজার। এদিকে তাইওয়ানের নৌবাহিনীর সদস্যসংখ্যা মোটে ৪০ হাজার।
সমুদ্রে তাইওয়ানের নৌবাহিনীর মোট ২৬টি জাহাজ রয়েছে। বিপরীতে চীনের নৌবাহিনীর জাহাজের সংখ্যা ৮৬টি। এ ছাড়া তাইওয়ান হলো স্বশাসিত একটি দ্বীপ। কোনো ধরনের সামরিক সংঘাত শুরু হলে সবচেয়ে বেশি লড়াই হবে নৌপথে। সেই তুলনায় তাইওয়ানের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে আছে চীনা নৌবাহিনী।
এ ছাড়া সামরিক সরঞ্জামের ক্ষেত্রে চীনের চেয়ে অনেক পিছিয়ে তাইওয়ান। চীনের রয়েছে পাঁচ হাজার ট্যাংক। অপর দিকে তাইওয়ানের কাছে ট্যাংক আছে ৬৫০টি। এদিকে ৩ হাজার ২০০টি যুদ্ধ ও সামরিক বিমান নিয়ে আকাশপথে তাইওয়ানকে টেক্কা দেবে বেইজিং। অপর দিকে তাইওয়ানের কাছে যুদ্ধ ও সামরিক বিমান আছে মাত্র পাঁচ শতাধিক। সামরিক শক্তিতে চীনের চেয়ে অনেক পিছিয়ে থাকা তাইওয়ান সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য নিজেদের প্রস্তুত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
তাই সামরিক খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে চলেছে তাইওয়ান। গত জানুয়ারিতে দেশটির পার্লামেন্ট সামরিক খাতে বরাদ্দ এক ধাক্কায় দ্বিগুণ করেছে। ২০২১ সালে তাইওয়ানের সামরিক খাতে বরাদ্দ যেখানে ছিল ৭ বিলিয়ন বা ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার, সেখানে ২০২২ সালের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার।
তাইওয়ানের সরকার বলেছে, আরও আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র ও নৌবাহিনীর জন্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজের কথা ভেবেই সামরিক খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে।
তাইওয়ানের জন্য আরেকটি আশাবাদী হওয়ার মতো বিষয় হচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধ। গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে রাশিয়া তাদের প্রতিবেশী ইউক্রেনে হামলা চালানোর মধ্য দিয়ে যুদ্ধের সূচনা করে। রাশিয়ার চেয়ে ইউক্রেন সামরিক শক্তিতে অনেক পিছিয়ে। কিন্তু এখনো রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। সামরিক শক্তিতে এত পিছিয়ে থেকেও ইউক্রেন কীভাবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ছে, সেই ধারণা ও অভিজ্ঞতা তাইওয়ানের জন্য বেশ কাজে লাগতে পারে।
চীন যে তাইওয়ানে হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাও সেই শঙ্কা ব্যক্ত করেছে। সিআইএর পরিচালক বিল বার্নস গত মাসে বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের আবহে তাইওয়ানে হামলা চালানোর পরিকল্পনা নিয়ে আরও অগ্রসর হতে পারে চীন। তিনি বলেছেন, ‘এটা হওয়ার ঝুঁকি এখন অনেক বেশি বলেই আমাদের কাছে মনে হচ্ছে। তাইওয়ানকে বেইজিংয়ের কবজায় নেওয়ার জন্য চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের অবিচল অবস্থানকে আমি ছোট করতে চাচ্ছি না।’
এদিকে পেলোসির তাইওয়ান সফর নিয়ে ক্ষুব্ধ চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বর্তমান পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণ বিপজ্জনক বলে অভিহিত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চীনের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের মদদ পেয়ে পেয়ে তাইওয়ানের এই সাহস তৈরি হয়েছে। আর চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে এক ভিডিও সংলাপে যুক্তরাষ্ট্রকে তাইওয়ান প্রশ্নে হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘যারা আগুন নিয়ে খেলবে, সেই আগুনেই তাদের পুড়তে হবে এবং চীনকে যারা ক্ষুব্ধ করবে, তাদের শাস্তি দেওয়া হবে।’