প্রেসিডেন্ট সি থেকে ‘সম্রাট’ সি

সির আসন্ন মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে অতিক্রমের পুরোনো যুদ্ধেও চীন জিততে চলেছে বলে জোর আত্মবিশ্বাস সিসিপির। বাকি থাকছে কেবল তাইওয়ান!

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির এবারের কংগ্রেসে তৃতীয়বারের মতো দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন দেশটির প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। গত রোববার তোলা

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) কেন্দ্রীয় স্তরে কারও বয়স ৬৮ হলে অবসরে যেতে হয়। প্রাদেশিক পর্যায়ে এ সীমা ৬৫ বছর পর্যন্ত। দলের সাধারণ সম্পাদক এবং দেশের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ৬৯ চলছে এখন। কিন্তু দল থেকে বাদ পড়েননি তিনি। বরং তৃতীয়বারের মতো দলীয় নেতা ‘নির্বাচিত’ হলেন।

বলা বাহুল্য, ক্ষমতার কাছে ‘নিয়ম’ ও ‘ব্যতিক্রমের’ ফারাকটি সামান্যই। লিখিত নিয়মের পাশাপাশি অলিখিত কিছু নিয়মও থাকে ক্ষমতার চৌহদ্দিতে। এটা পুঁজিতন্ত্রে যেমন সত্য, ৯ কোটি ৬০ লাখ সদস্যের ‘সমাজতান্ত্রিক দলে’ও কম সত্য নয়। চীনের রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রগুলো ২২ ও ২৩ অক্টোবর যখন তাদের নেতার নতুন খবর জানাচ্ছিল, তখন ‘মন্তব্য’ ঘরগুলো বন্ধ রাখা হয়।

এ রকম হয়তো ২০২৩ সালের মার্চেও একবার হবে, যখন তিনি তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট পদও নিশ্চিত করবেন। কিন্তু সির উত্থানে চীন সীমান্তের বাইরে কারও মন্তব্যহীন থাকা দুরূহ।

সমকক্ষদের সরিয়ে দেওয়া হলো

সি চিন পিং যে সিসিপির ২০তম কংগ্রেসে আবারও সাধারণ সম্পাদক হতে চলেছেন, সেটা অপ্রত্যাশিত ছিল না। তিনি যে শিগগির নতুন করে দেশটির প্রেসিডেন্ট হবেন, সেটাও এখনই বলা যায়। তবে অনুমানের চেয়েও অনেক কঠোর এবং দৃঢ় মনোভাব দেখা গেল এবারের কংগ্রেসের হাবভাবে।

সি কেবল নিজের পুনর্নির্বাচনই নিশ্চিত করেননি, আশপাশে সমকক্ষ কোনো নেতাকেও রাখেননি। সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যাঁর কথা ভাবা হচ্ছে, সেই লিং কিয়াংকে সাংহাই থেকে উঠিয়ে আনা হয়েছে মহামারির সময় দুই মাস একটানা কঠোর লকডাউন কায়েমের পুরস্কার হিসেবে। মাত্র ২০১৭ সালে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্ণ সদস্য হয়েছেন।

হু জিনতাওয়ের বিব্রতকর বিদায়পর্ব

সবাই ধরে নিয়েছিল চীনের কমিউনিস্ট পার্টির এবারের কংগ্রেসে মূল এবং একমাত্র আকর্ষণ হবেন সি চিন পিং। কিন্তু কংগ্রেস বিশ্বজুড়ে শুরুতে মনোযোগ পেল দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক প্রেসিডেন্ট হু জিনতাওকে ধরে বাইরে নিয়ে যাওয়ার ভিডিও ক্লিপে।

২০১২ সাল পর্যন্ত ১০ বছর দলটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন হু জিনতাও। প্রেসিডেন্টও ছিলেন ১০ বছর। তাঁর আমলেই সি চিন পিং পাঁচ বছর ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। কিন্তু সম্মেলনে দেখা গেল, তাঁর অমতেই দুই ব্যক্তি তাঁকে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন প্রথম সারির চেয়ার থেকে। সি চিন পিংয়ের পাশের চেয়ারেই বসে ছিলেন এই সাবেক সর্বোচ্চ নেতা। কিন্তু হুকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় সিকে নির্বিকার বসে থাকতে দেখা গেল। বাকি ২ হাজার ৩৪০ প্রতিনিধিও ভাবলেশহীন চোখে সি এবং হু—দুজনকেই দেখছিলেন এ সময়। যাঁদের মাঝে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী লি কেছিয়াংও; ৬৮ বছরের নিচে বয়স থাকার পরও ক্ষমতার পরিসর ছাড়তে হলো তাঁকে।

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং

সম্মেলনকক্ষ থেকে হু জিনতাওকে তুলে নিয়ে যাওয়ার বিব্রতকর দৃশ্য কেন প্রকাশ্যে ঘটল, তার রহস্য খুঁজে ফিরছে এ মুহূর্তে আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যম। সেই সূত্রে ঘটনার দুটো ব্যাখ্যা মিলছে: একদল বলছে, হুকে প্রকাশ্যে অপমানিত করার একটা পুরোনো ইচ্ছা ছিল সির, সেটা এভাবে পূর্ণ হলো! আরেক দলের ভাষ্য, হু শারীরিকভাবে খারাপ অবস্থায় ছিলেন, তাই তাঁকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে যত্নের সঙ্গে ভিডিও ক্লিপ দেখে মনে হচ্ছে, তিনি সম্মেলনস্থল ছেড়ে যেতে অনিচ্ছুক ছিলেন।

৪৯ বছর পর তিনি বিশ্বনেতা

 চীনে কংগ্রেসকালে সাধারণভাবে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছাড়াও কারা পলিটব্যুরোর স্ট্যান্ডিং কমিটিতে আসছেন, সেটাও নজরে রাখেন সবাই। সি ছাড়াও বাকি যে ছয়জন এই কমিটিতে এলেন, এবার তাঁদের মধ্যে আছেন লি কিয়াং, ঝাও লেইজি, ওয়াং হুনিং, কাই কি, ডিং জুয়েজিয়াং ও লি জি মিট। এই ছয়জনই সিকে সহায়তা দেবেন বৈশ্বিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবিলায় এবং বিশেষভাবে তাইওয়ান নীতিতে।

এবারের কংগ্রেসের বড় দুই ব্যতিক্রমী দিক—গত ২৫ বছরের মধ্যে এই প্রথম সিসিপির পলিটব্যুরোতে কোনো নারী নেই এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যই প্রথমবারের মতো পলিটব্যুরোতে এলেন। শেষের বৈশিষ্ট্যের কারণে কংগ্রেসের পর আন্তর্জাতিক কোনো চীনা ভাষ্যকারই বলতে পারছেন না সির উত্তরসূরি কে!

সি চিন পিং ও নতুন পলিটব্যুরোর স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যরা

বার্তাটি স্পষ্ট। সি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। অন্তত ২০২৭ সাল পর্যন্ত তাঁর কোনো রাজনৈতিক উত্তরসূরির কথা না ভাবাই ভালো হবে। হয়তো তাঁর শাসনামল কেবল শুরু হলো। সিসিপির আগের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুই নেতা মাও সে–তুং কিংবা তেং শিয়াও ফিং বয়স ৮০ পার হওয়ার আগে রাজনীতি থেকে বিদায় নেননি। সিকে কেন নিতে হবে? যদি তিনি (‘জনগণের স্বার্থে’) থাকতে চান?

অন্যদিক থেকে অবশ্য সি চিন পিং অনেক আলাদা। অন্তত তেং শিয়াও ফিংয়ের আমল থেকে চীন ‘চুপচাপ এগিয়ে চলা’র যে নীতিতে ছিল, সেটা থেকে এখনকার ধারা স্পষ্টই অন্য রকম দেখাচ্ছে। সির চীন সদম্ভ, সাহসী! সিসিপির সংবিধানে এই সিকে তুলে ধরা হচ্ছে ‘সি চিন পিংয়ের চিন্তাধারা’ শিরোনামে। ইতিমধ্যে প্রায় ১০ খণ্ডে তাঁর ভাষণ ও নিবন্ধের সংকলনও প্রকাশ হয়েছে। এসবই তাঁকে মাও এবং তেংয়ের ‘সমকক্ষ’ দেখানোর প্রয়াস।

তবে সবই জবরদস্তিমূলকভাবে হচ্ছে না। ২০ বছর বয়সে সিসিপিতে যুক্ত হয়েছিলেন সি। ৪৯ বছর পর তিনি দলটির দিকে বিশ্বের সবার নজর কাড়তে বাধ্য করছেন, কেউ হয়তো তাঁকে দেখছে উদ্বেগের সঙ্গে, কেউ বিস্ময়ে। কিন্তু সি এবং সিসিপি—কাউকে আর অবজ্ঞা করা যাচ্ছে না।

সি চিন পিং কি ছং চেনের মতো কেউ?

ঠান্ডাযুদ্ধ গত এক-দুই বছরে কত দ্রুতলয়ে উত্তাপ ছড়াচ্ছে, তা নতুন করে বোঝা গেল সিসিপির এবারের ২০তম কংগ্রেসকালে। ইউরোপ–যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমকে চীনের পার্টির কোনো কংগ্রেস নিয়ে এত উতলা দেখা যায়নি ইতিহাসে। যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক মুরব্বিপনায় সি ও পুতিনের মাঝে কে প্রধান প্রতিপক্ষ—এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সির তৃতীয় মেয়াদে পার্টিপ্রধান হওয়া ওয়াশিংটনের জন্য মোটেই ভালো লাগার কোনো সংবাদ নয়। তাদের পত্রপত্রিকায় তার ছাপ দেখা যাচ্ছে প্রবল।

সি যে প্রতিপক্ষ হিসেবে যথেষ্ট অনমনীয় এবং একরোখা, সেটা ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্র ভালোভাবেই ইতিমধ্যে টের পেয়েছে, বিশেষ করে হংকং অধ্যায় থেকে। পশ্চিমের উচ্চবাচ্যকে আমলে না নিয়ে নির্মমভাবে হংকংয়ের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে বর্তমান চীনা নেতৃত্ব। সি এবার যেভাবে পলিটব্যুরো এবং দলকে সাজালেন, তাতেও ইঙ্গিত মিলছে, যুক্তরাষ্ট্রকে তাইওয়ান ফ্রন্টে মোকাবিলা করতে রাজনৈতিক প্রস্তুতির অনেকখানি সম্পন্ন হলো বেইজিংয়ে।

এই কংগ্রেসের পর চীনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে সিকে আর না ভাবলেও চলবে। এত দিন বিশ্ব সিকে দেখেছে চীনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে। এখন সবাই পেল ‘আধুনিক এক সম্রাট’কে। অনেক পশ্চিমা প্রচারমাধ্যম ছদ্ম শ্লেষে ওভাবে বললেও কথাটি মিথ্যা নয়। সিসিপিতে এবার নেতৃত্ব পর্যায়ে ‘যৌথতা’র বদলে ‘একক’ চরিত্র প্রাধান্য পেয়েছে। মাওয়ের পরের চীনে এটা বড় এক সাংগঠনিক মোড় পরিবর্তন।

নিজেকে একচেটিয়া করে তোলায় সুবিধা ও ঝুঁকি দুটোই থাকে। নিশ্চয়ই সি সেটা জানেন। তাঁর প্রতিপক্ষদেরও সেটা অজানা নেই। সির পুনর্নির্বাচন নিশ্চিতভাবে চীননীতিতে যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে ব্যবধান আরও কমে আসবে। দেশটিকে মোকাবিলায় ‘কৌশলগত অস্পষ্টতা’র আর সুযোগ নেই তাঁদের জন্য।

কিন্তু চীনের প্রতিপক্ষদের অবশ্যই খেয়াল রাখা দরকার দেশটির ইতিহাসে-অতীত সম্রাটেরা রাজত্ব এবং নিজস্ব ইচ্ছা-অনিচ্ছা জারি রাখতে বাকি বিশ্ব থেকে একঘরে থাকতেও দ্বিধান্বিত থাকতেন না। সি সেই পরম্পরার নতুন সম্রাট।

২০তম কংগ্রেসের ৭২ পৃষ্ঠার উদ্বোধনী ভাষণে সি যদিও দেশের দ্বার উন্মুক্ত রাখার পক্ষেই বললেন। কিন্তু ১৯৮০ সাল থেকে পরবর্তী চার দশকের মতো ব্যাপক খোলা হাওয়ার মনোভঙ্গিতে নেই আর গণচীন। অনেকে হয়তো এতে চীনের মিং রাজত্বের (১৩৬৮-১৬৪৪) গন্ধ পেয়ে থাকবেন। কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে সির সঙ্গে শেষ মিং রাজা ছংচেনের তুলনা করছেন। ছংচেনের আমলে মিং রাজত্ব সবচেয়ে বেশি বিকশিত হয়। কিন্তু ১৬৪৪ সালে রাজধানী বেইজিং বিদ্রোহীদের হাতে পতনের মুখে যিনি আত্মহত্যা করেছিলেন।

এ রকম তুলনাকারীদের খেয়াল রাখতে হবে ছংচেনও ১৭ বছর ক্ষমতায় ছিলেন এবং সি চিন পিং অনেক আগেই দুবারের বেশি প্রেসিডেন্ট হওয়ার নিয়ম বদলে নিয়েছেন। ২০১৮ সালের মার্চে ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসে সি যখন এই নিয়ম ভাঙেন, তখন পক্ষেÿভোট পড়েছিল ২ হাজার ৯৫৮টি এবং বিপক্ষে ২টি। সুতরাং ২০২২ সালের অক্টোবরে এসে সির তৃতীয় মেয়াদের অনুমোদন দেখে আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমের আহাজারির মানে দাঁড়ায় চীনকে অধ্যয়নে ব্যর্থতা।

মারিও পুজোর কোন কর্লিয়নির মতো হবেন তিনি?

সির পুনর্নির্বাচনে সবার আগে অভিনন্দন এসেছে পিয়ংইয়ং ও মস্কো থেকে। এটাও প্রত্যাশিত। সির ২০২৭ সাল পর্যন্ত থাকার নিশ্চয়তা পুতিনের জন্য ভরসার বার্তাই বটে। তবে বড় প্রতিবেশী ভারতের জন্য বিষয়টা যুক্তরাষ্ট্রের মতোই সুখকর নয়। আপাতত ইউক্রেনসহ আন্তর্জাতিক অনেক প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভিন্নমতের বেলায় ভারত-চীনের নৈকট্য দেখা গেলেও নিজ সীমান্তে তাদের রয়েছে চিরায়ত বৈরিতা।

সির দ্বিতীয় মেয়াদে ভারতকে একাধিক সীমান্ত ফ্রন্টে চাপের মুখে পড়তে হয়েছে। মোদি-সি এ পর্যন্ত ১৮ দফা বৈঠক হলেও তাতে সীমান্তের উত্তাপে জল পড়েনি। ভবিষ্যতে এই চাপ কমার কোনো লক্ষণ নেই বলেই ২২ অক্টোবর গ্রেট হল থেকে বার্তা মিলল। এর একটা প্রতিক্রিয়া এখনই অনুমান করা যায়, জাপানের মতো ভারতেও সামরিক ব্যয় বাড়ানো অব্যাহত থাকবে। সুতরাং তাদের প্রতিবেশীরাও তাই করবে। অর্থাৎ নতুন চীন সম্রাটের আমলে এশিয়ায় নীরবে সমরবাদের নতুন অধ্যায় শুরু হচ্ছে। আসিয়ানভুক্তদেরও হয় সি চিন পিং, নইলে ওয়াশিংটন—এক পক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে চলতে হবে।

সিসিপির ২০তম কংগ্রেস মাঝারি এবং ছোট দেশগুলোকে পরোক্ষভাবেÿ জানিয়ে দিল আসন্ন বিশ্বে মধ্যবর্তী অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকার সুযোগ কম এবং ১৮ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির চীন নিজে তাদের ‘পছন্দ’ করার মতো একটা ‘পক্ষ’।

বাংলাদেশের জন্যও সিসিপির এই কংগ্রেস গুরুত্বপূর্ণ বার্তাবহ। দক্ষিণ এশিয়ায় এবং বঙ্গোপসাগর উপকূলে ওয়াশিংটন নিজেকে নতুনভাবে যে সক্রিয় করছে, তা ইতিমধ্যে স্পষ্ট। চীনের অন্যতম ‘কমফোর্ট জোন’ হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতি-অর্থনীতিতেও ‘আমেরিকান মূল্যবোধে’র চাপ বাড়ছে। এ রকম বিবিধ বিবেচনায় সির পুনর্নির্বাচনে দীর্ঘমেয়াদি এক উত্তেজনাকর সময়ের সূচনা হিসেবে দেখাই যথার্থ হবে। তবে এ–ও মনে রাখতে হবে, চীন নিজে যুদ্ধবাজ নয়, এমনকি কংগ্রেসের উদ্বোধনী ভাষণে সি ৭৩ বার ‘নিরাপত্তা’ শব্দ উচ্চারণের পরও। গত ৪৩ বছর তারা কোনো যুদ্ধে জড়ায়নি এবং এ সময়টাতেই চীন নিজেকে পরাশক্তিতে রূপান্তর করতে পারল। প্রশ্ন উঠেছে, তাইওয়ান চীনের ওই ধারাবাহিকতায় ছেদ ঘটাতে চলেছে কি না?

সম্রাট সির ভঙ্গিমায় সে রকম লক্ষণ আছে। খেয়াল করার মতো ব্যাপার, বিশ্ব থেকে কোভিড-১৯ অনেকখানি বিদায় নিয়েছে ঘোষণা দিয়ে অনেক দেশ যখন মাস্ক খুলে ফেলছে, চীন তখনো ‘জিরো-কোভিড নীতি’তে আছে। তাইওয়ানের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে কেউ ভাইরাসের সঙ্গে তুলনা করলে ‘জিরো-কোভিড নীতি’র অন্য মানেও দাঁড়ায়। তবে সিসিপি নেতৃত্ব যে কেবল জীববিদ্যা ও রাজনীতিবিদ্যার ‘ভাইরাস’ নিয়ে ভাবছে, এমন নয়। এ দশকে তাদের বড় এক লক্ষ্য প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ। শেষের লক্ষ্যে তারা ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করে যেতে ইচ্ছুক। বলা যায়, এ মুহূর্তে তাইওয়ানের চেয়েও এটাকে বড় ‘যুদ্ধ’ হিসেবে দেখছে জাতীয়তাবাদী গণচীন। সম্রাট সির আসন্ন মেয়াদেই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে অতিক্রম করে যাওয়ার পুরোনো যুদ্ধেও তারা জিততে চলেছে বলে জোর আত্মবিশ্বাস আছে সিসিপিতে।

বাকি থাকছে কেবল তাইওয়ান! এই ফ্রন্টে সি চিন পিং কার মতো করে সিদ্ধান্ত নেবেন—মারিও পুজোর দ্য গডফাদার উপন্যাসের পিতা ভিটো কর্লিয়নি, নাকি পুত্র মাইকেল কর্লিয়নির মতো? ভিটোর মতো দেখেশুনে এগোবে, নাকি মাইকেলের মতো দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্রুত বাস্তবায়ন করবে? সেটা বলা মুশকিল। বিখ্যাত সাংবাদিক ইভান অসনসের অনুসন্ধান থেকে দ্য নিউয়র্কার ২০১৫ সালের ৬ এপ্রিল এক লেখায় বিশ্বকে জানিয়ে রেখেছে তরুণ বয়সে সির প্রিয় সিনেমা ছিল দ্য গডফাদার। সেই সিনেমার দ্বিতীয় সংস্করণ হয়তো বিশ্ব কখনো দেখবে ভূমধ্যসাগরের সিসিলি ও নিউইর্য়ক শহরের বদলে দক্ষিণ চীন সাগরের অপর কোনো দ্বীপের পটভূমিতে।

আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক