চীনে যে কারণে একলা মা হওয়া সহজ হচ্ছে

চীন সরকার এখন চায়, দেশটির তরুণ দম্পতিরা একাধিক সন্তান নিক
ফাইল ছবি: রয়টার্স

চীনে গত বছর নাগাদ বেশির ভাগ অবিবাহিত নারীর পক্ষে মা হওয়া সত্যিই অসম্ভব ছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে দেশটিতে একটি সামাজিক ও নীতিগত পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।

এই যেমন, ঝাং মেইলির কথা বলা যায়। তিনি একজন একলা মা। চীনের সাংহাই শহরের উপকণ্ঠের একটি ফ্ল্যাটে থাকেন তিনি।

মেইলি যখন ব্যবসার কাজে বাইরে যান, তখন তাঁর দুই মাস বয়সী ছেলে হেং হেংকেকে দেখাশোনা করেন নানি। তিনি গ্রামীণ হেনান এলাকা থেকে সম্প্রতি সাংহাইয়ে মেয়ের বাসায় এসেছেন। উদ্দেশ্য, মেয়ে মেইলিকে তাঁর সন্তান লালনপালনে সহায়তা করা।

চীনের, বিশেষ করে রক্ষণশীল আঞ্চলিক ও গ্রামীণ এলাকায় একলা মায়ের বিষয়টিকে ভ্রুকুটির চোখে দেখার চল রয়েছে। বিবাহ ছাড়া সন্তান তাঁদের কাছে এখনো গ্রহণযোগ্য নয়।

মেইলির ভাষ্য, তাঁর নিজের এলাকা হেনানের চেয়ে মেগাসিটি সাংহাইয়ে একলা মা হওয়ার বিষয়টি অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। ফলে তিনি ভাগ্যবান যে ব্যবসা চালানোর জন্য সাংহাইয়ে চলে এসেছিলেন।

মেইলি বলেন, একলা মায়ের প্রতি সাংহাইয়ের সহনশীলতার জন্য তিনি কৃতজ্ঞ। কিন্তু তিনি যদি তাঁর নিজ এলাকা হেনানে থাকতেন, তাহলে অনেক বৈষম্যের শিকার হতেন।

একজনের সঙ্গে মেইলির প্রেমের সম্পর্ক ছিল। একপর্যায়ে মেইলি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। ওদিকে মেইলির প্রেমিকের পরিবার তাঁকে বধূ করতে অস্বীকৃতি জানায়। তখন মেইলি তাঁর প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন, তবে তিনি তাঁর গর্ভের সন্তান রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

মেইলির মায়ের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, যখন তিনি তাঁর মেয়ের এমন সিদ্ধান্তের কথা শুনেছিলেন, তখন তাঁর কী মনে হয়েছিল।

মেইলির মা বলেন, ‘আমার অনুভূতি? আমার হৃদয় ভেঙে গিয়েছিল।’ মেইলির মা বলেন, তাঁর মনে হয়েছিল, একলা মায়ের সন্তান বড় করা খুব কঠিন কাজ। তা ছাড়া এ নিয়ে প্রতিবেশীরা সমালোচনা করবেন।

নানি হওয়ার পর ভাবনায় বদল এসেছে কি না, এমন প্রশ্নে মেইলির মা বলেন, এখন তিনি তাঁর নাতিকে দেখাশোনা করেন। তিনি সত্যিই খুশি।

মেইলি সন্তান জন্মের সিদ্ধান্তটা নিতে পেরেছিলেন, কারণ, তিনি নিজে একটা ছোট ব্যবসা চালান। তবে চীনের অনেক অবিবাহিত নারীর এই সুযোগ নেই। নিজের ব্যবসা থাকার বিষয়টি মেইলিকে অধিক স্বাধীনতা দিয়েছে, দিয়েছে নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা।

মেইলি বলেন, বন্ধুদের কেউই তাঁর গর্ভের সন্তান রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সমর্থন করেননি। তাঁদের ভাবনা ছিল, এই সিদ্ধান্তের কারণে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ভবিষ্যতে বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজে পাবেন না। সন্তানের জন্যও বিষয়টি ভালো হবে না।

মেইলি বলেন, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় তিনি একা হাসপাতালে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি স্বামীসহ নারীদের দেখতে পান। এই নারীদের দেখে তাঁর হিংসা হয়েছিল, তবে তিনি শেষ পর্যন্ত একলা মা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

চীনে একলা মা হওয়ার বিষয়টি এত দিন শুধু সামাজিক কারণেই কঠিন ছিল না। এখানে সরকারের নীতিরও একটা ভূমিকা ছিল।

২০১৬ সালের আগপর্যন্ত চীনে মা–বাবার বিয়ের বৈধ প্রমাণপত্র ছাড়া তাঁদের সন্তানের জন্মসনদ ইস্যু করা নিষিদ্ধ ছিল।

তা ছাড়া স্কুলে ভর্তিসহ নানা কাজে চীনের প্রত্যেক নাগরিকের পরিচয়পত্রের প্রয়োজন পড়ে। এটি পাওয়ার ক্ষেত্রে সন্তানের মাতাপিতা উভয়ের পরিচয়সংক্রান্ত নথি দিতে হয়।

বিবিসির সংবাদদাতা স্টিফেন ম্যাকডোনেল দুই দশক আগে প্রথম চীনে গিয়েছিলেন। তখন দেশটির অবিবাহিত নারীরা বলেছিলেন, যদি তাঁরা দুর্ঘটনাক্রমে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন, তাহলে গর্ভপাত করা ছাড়া তাঁদের আর কোনো উপায় নেই না। কারণ, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়া চীনে একটি শিশুর পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়।

এমনকি নিয়মে পরিবর্তন আসার পরও চীনে বেশির ভাগ অবিবাহিত নারীর ক্ষেত্রে গত বছর পর্যন্ত সন্তান ধারণের কথা চিন্তা করা কার্যত অসম্ভব ছিল। কারণ, হাসপাতাল খরচের অর্থ দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিমার সুবিধা তাঁরা পেতেন না। আবার বেতনসহ মাতৃত্বকালীন ছুটিও তাঁরা পেতেন না।

এই দুই ক্ষেত্রে তথাকথিত পরিবর্তন এসেছে। তবে বাস্তবের পরিস্থিতি এখনো কঠিন। অনেক কোম্পানি এখনো একলা মায়েদের এসব অধিকার দিতে চায় না।

এ-সংক্রান্ত মামলা নিয়ে কাজ করেন, এমন একজন আইনজীবী বলেন, বিষয়টি আসলে কোম্পানির খোলা মানসিকতা ও কর্মীদের অধিকারের বিষয়ে চাকরিদাতার সচেতনতার ওপর নির্ভর করে। তা ছাড়া স্থানীয় নীতিগুলোও অস্পষ্ট।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক আইনজীবী আরও বলেন, বিধান পরিবর্তিত হয়েছে, এই বিষয়ে অনেক কর্তৃপক্ষ বুঝতে চায় না। আবার অনেকে এ–সংক্রান্ত খবরও রাখেন না। কারণ, তারা বিষয়টির (একলা মা) পক্ষে নয়।

বেইজিংয়ের মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইয়াং জুহুয়া বলেন, চীনা আইন অনুযায়ী, বৈবাহিক অবস্থা নির্বিশেষে সব মা ও তাঁদের সন্তানদের একই অধিকার ভোগ করা উচিত। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। কারণ, অনেকে একলা মায়ের প্রতি সহনশীল নয়।

জনসংখ্যাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ইয়াং বলেন, নিয়ম তৈরির সময় একলা মায়ের বিষয়টি মাথায় রাখা হয়নি। বিবাহিত দম্পতিদের কথা মাথায় রেখেই নিয়ম তৈরি করা হয়েছে। ফলে এখানে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে বিবাহ একটি পূর্বশর্ত হিসেবে কাজ করে। অবিবাহিত মায়ের ধারণাটি এখানে এখনো একটি নতুন বিষয়। এটি চীনের ঐতিহ্যগত নৈতিক বিষয় থেকে অনেক দূরের একটি ধারণার প্রতিনিধিত্ব করে।

চীনে দশকের পর দশক ধরে ‘এক সন্তান নীতি’ ছিল। তবে ২০২১ সালে দেশটি এই নীতিতে বদল আনে। পাস করে ‘তিন সন্তান নীতি’ আইন। নীতিতে বদল আনার অন্যতম কারণ চীনে বয়স্ক জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়া।

চীন সরকার এখন চায়, দেশটির তরুণ দম্পতিরা একাধিক সন্তান নিক। কিন্তু আর্থিক কারণে দেশটির অনেক দম্পতি সরকারের এই আহ্বানে সাড়া দিচ্ছেন না। তাঁরা মনে করছেন, একাধিক সন্তান লালনপালনের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ তাঁদের নেই। এই পরিস্থিতিতে অবিবাহিত নারীরা যদি সন্তান নিতে চান, তাহলে তাঁদের উৎসাহিত করার পক্ষে দেশটির কর্তৃপক্ষ।

চীনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় শহর হ্যাংঝোর বাসিন্দা পেং কিংকিং। তিনি একটি অনলাইনভিত্তিক বিক্রয় প্ল্যাটফর্ম চালান। তিনি অবিবাহিত। প্রেমের সম্পর্ক থেকে দুর্ঘটনাবশত তিনি অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন। তবে এই সন্তান রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। এই নারী বলেন, নিজে ব্যবসা করার কারণে তাঁর পক্ষে গর্ভধারণের সিদ্ধান্তটি নেওয়া সহজ হয়েছে।

তবে চীনে বিয়ের বাইরে যেসব নারী সন্তান জন্ম দেন, তাঁরা নানা ধরনের বৈষম্যের মুখোমুখি হন। কিন্তু বেইজিংয়ের মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইয়াং মনে করেন, চীনা সমাজ অবিবাহিত মায়েদের প্রতি আরও সহনশীল হলে এই ধরনের বৈষম্য ধীরে ধীরে দূর হবে।