২০২১ সালে বিশ্বের নানা প্রান্তে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নিয়ে বিশ্লেষণ, পর্যবেক্ষণ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছে প্রথম আলো অনলাইন। এই আয়োজনের দ্বিতীয় লেখাটি এখন প্রকাশিত হলো।
ক্ষমতার দৌড়ে সামনের সারিতে থাকা চীনের বিষফোড়া এখন তাইওয়ান। নিজেদের সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে দাবি করে তাইওয়ান। চীন তা মানতে নারাজ। ক্ষমতার ঘেরাটোপ থেকে বের হয়ে যেতে চাওয়া তাইওয়ানকে চীন মনে করে বিচ্ছিন্ন প্রদেশ। বছরজুড়েই আলোচনায় ছিল চীন-তাইওয়ান দ্বন্দ্ব।
চীন-তাইওয়ানের একে অন্যকে চোখরাঙানি, বাদানুবাদ, আকাশসীমায় যুদ্ধবিমান ঢুকে পড়া, পাল্টাপাল্টি হামলার জবাব—সবই চলেছে। কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনিভাবে দুই দেশের এই দ্বন্দ্বে অনুপ্রবেশ ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রের। ‘শত্রুর শত্রু আমার মিত্র’ প্রবাদকে আবারও সত্য প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্র পাশে দাঁড়িয়েছে তাইওয়ানের। এই ইস্যুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের মধ্যে টক–ঝাল আলোচনাও চলেছে। বিদায়ী বছরে এই আলোচনাতেও চোখ ছিল বিশ্বের। তবে আলোচনায় কোনো সুফল মেলেনি শেষ পর্যন্ত।
তাইওয়ানের আকাশসীমায় চীনা যুদ্ধবিমানের অনুপ্রবেশ নিয়ে অভিযোগ অনেক আগে থেকেই। বিবিসির খবরে জানা যায়, গত জুনে তাইওয়ানের আকাশ প্রতিরক্ষাসীমানায় চীনের ১৮টি যুদ্ধবিমান অনুপ্রবেশ করে। এ নিয়ে সে সময় শঙ্কা প্রকাশ করে তাইওয়ান সরকার। তিন মাস পর আবারও আসে অভিযোগ। গত সেপ্টেম্বরে তাইওয়ানের আকাশ প্রতিরক্ষাসীমানায় চীনের ১৯টি যুদ্ধবিমান অনুপ্রবেশ করেছে বলে অভিযোগ করেছে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। সেগুলোর মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম বোমারু বিমানও ছিল বলে দাবি করা হয়।
গত অক্টোবরেও চার দিনে চীনের প্রায় দেড় শ যুদ্ধবিমান ঢুকে পড়ার কথা জানিয়েছে তাইপে। এটি ছিল এ পর্যন্ত রেকর্ড যুদ্ধবিমান ঢুকে পড়ার ঘটনা। তাইওয়ানকে চীনের অব্যাহতভাবে হয়রানি করে যাওয়ারই এটি একটি অংশ বলে আখ্যা দিয়েছে তাইপে। রয়টার্সের খবরে জানা যায়, আকাশসীমায় পরপর কয়েকটি চীনা বিমান ঢুকে পড়ার কয়েক দিন পর তাইওয়ানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলে বসেন, চীনের সঙ্গে তাইওয়ানের সম্পর্ক ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
অবশ্য শুধু অভিযোগ তুলেই ক্ষান্ত দেয়নি তাইওয়ান; দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, অনুপ্রবেশের পর চীনের যুদ্ধবিমানগুলোকে সতর্ক করতে তাইওয়ানের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ক্ষেপণাস্ত্রগুলো তৈরি রাখা হয়েছিল। আকাশসীমায় বিমান ঢুকে পড়া নিয়ে চীন ও তাইওয়ানের এই উত্তপ্ত অবস্থার মধ্যে গত নভেম্বরে এসে নতুন চমক দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটনের কাছ থেকে এফ-১৬ যুদ্ধবিমানের অত্যাধুনিক সংস্করণ পায় তাইওয়ান। দেশটির প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন এই প্রকল্পের মধ্য দিয়ে তাইওয়ান ও যুক্তরাষ্ট্র অংশীদারত্বের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দেখিয়েছে বলে জানান।
তাইওয়ানকে যুক্তরাষ্ট্রের এ রকম নতুন নতুন অস্ত্র উপহারের ঘটনা অবশ্য নতুন নয়। আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের প্রধান আন্তর্জাতিক সমর্থনকারী এবং অস্ত্র সরবরাহকারী। এ কারণে বেইজিং বিক্ষুব্ধ। তাইওয়ানের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জোরদার করার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিন ও তাইওয়ানে অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের সঙ্গে ৩৯৬ কোটি মার্কিন ডলারের চুক্তি হয়েছে।
গত অক্টোবরের শেষ দিকে এসে চীনের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা দুশ্চিন্তায় ফেলে মার্কিন প্রশাসনকে। পশ্চিমা বিভিন্ন গণমাধ্যমের বরাতে জানানো হয়, পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে ছোড়া হয়েছিল ক্ষেপণাস্ত্রটি। তবে ভূপৃষ্ঠে সেটি লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারেনি। এমন দাবি সরাসরি নাকচ করে দেয় চীন। জানায়, তারা আদতে পুনরায় ব্যবহার করা যায়, এমন মহাকাশযানের পরীক্ষা চালিয়েছিল। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোয় বিভিন্ন সূত্রের খবরে অভিযোগ ওঠে তাইওয়ানকে নিশানায় রেখে সুপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে চীন। বাড়াচ্ছে অস্ত্রের মজুত। এতে রাশিয়ার সহযোগিতা নিচ্ছে বলেও অভিযোগ তোলা হয়।
আকাশসীমায় বিমান ঢুকে পড়ার এই উত্তেজনার মধ্যেই আবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং একাধিকবার ফোনালাপ ও ভার্চ্যুয়াল বৈঠক করেন। সবশেষ গত নভেম্বরের মাঝামাঝিতে ভার্চ্যুয়াল আলোচনায় অংশ নেন দুই নেতা। সি চিন পিং বেইজিং থেকে বাইডেনকে পুরোনো বন্ধু হিসেবেও সম্বোধন করেন। বাইডেনও চীনের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করার কথা বলেন। তবে মুখে মিষ্টি কথা থাকলেও কার্যত এই বৈঠকে অর্জন ছিল সামান্য। বৈঠকে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে তাইওয়ান ইস্যু। বাইডেন বৈঠকের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তাইওয়ানের সঙ্গে চীনের চলমান উত্তেজনা নিরসনের চেষ্টা করেছেন।
এএফপির খবরে বৈঠকের অংশ নেওয়া ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার সূত্রে জানা যায়, তাইওয়ানের প্রতি চীনের দখলদারি ও উসকানিমূলক আচরণের বিষয়ে বাইডেন সরাসরি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তবে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়ান ই সাফ জানিয়েছেন, তাইওয়ানের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্রের নেওয়া কোনো পদক্ষেপ চীন মেনে নেবে না। তাই তাইওয়ান ইস্যুতে বৈঠকের ইতি সেই ‘খাড়া বড়ি থোড়, থোড় বড়ি খাড়াই’।
তবে এই বৈঠক থেকে লাভবান হয়েছে বিশ্ব। হোয়াইট হাউসের তথ্য অনুযায়ী, ভার্চ্যুয়াল বৈঠকে বৈশ্বিক জ্বালানি তেল সরবরাহের বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন দুই নেতা। হোয়াইট হাউস থেকে নেওয়া উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় সমন্বিত পদক্ষেপের পর লাখো ব্যারেল তেল বাজারে আসে। আর এর কদিন পরই বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার সুখবর আসে।
চীন-তাইওয়ান আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান উত্তেজনার পারদ আরেকটু বেড়েছে হংকং ইস্যুতে। সে জন্য তাকানো যাক একটু পেছনে। ১৯৮৯ সালের ৪ জুন চীনের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে গণতন্ত্রের দাবিতে জড়ো হয়ে বিক্ষোভে শত শত ছাত্র-শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করে দেশটির ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট সরকার। ওই ঘটনা নিয়ে এরপর কোনো রকম আলোচনা নিষিদ্ধ করে চীন। তবে সেই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ওই ঘটনার বর্ষপূর্তিতে গত বছর বিক্ষোভে অংশ নেন হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থী রাজনীতিবিদেরা।
বিবিসির খবরে জানা যায়, এ বছরের এপ্রিলে গণতন্ত্রের পক্ষে বিক্ষোভের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন অ্যাপল ডেইলির প্রতিষ্ঠাতা জিমি লাই। নিজের পত্রিকায় বেইজিংয়ের স্বৈরশাসনের কড়া সমালোচনা করেন তিনি। হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থী ‘মিডিয়া মোগল’ হিসেবে পরিচিত জিমি লাইকে ১৪ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বছরের শেষ দিকে এসে বন্ধ করা হয় তাঁর অ্যাপল ডেইলির প্রকাশনাও। জিমি লাইসহ (৭৪) আট গণতন্ত্রপন্থীকে ১৪ ডিসেম্বর আবারও ১৪ মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া হয়। গত বছর এক মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচির আয়োজন করায় তাঁদের এই দণ্ড দেওয়া হয়।
হংকংয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর দমনপীড়নে ভূমিকা রাখছেন বলে অভিযোগ তুলে সেখানকার কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর জুলাইতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। হংকংয়ে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির বিষয়ে মার্কিন ব্যবসায়ীদের সতর্কও করে দেয় ওয়াশিংটন। এর জবাবে চীনও মার্কিন কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
এত উত্তেজনার মধ্যে জানা দরকার, তাইওয়ানের সাধারণ জনগণ কী চায়। বিবিসি, এএফপি ও রয়টার্সের মতো পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর খবর বলছে, অধিকাংশ তাইওয়ানবাসী চীনের অধীনে থাকার আগ্রহ দেখান না। তবে চীনের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে তাইওয়ানকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়া দেশ কম।
বছরের একেবারে শেষ দিকে এসে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার উত্তপ্ত সম্পর্ক আবারও আলোচনায় আসে। বিশ্বের ১১০টি দেশকে নিয়ে বৈশ্বিক গণতন্ত্র সম্মেলনের আয়োজন করে যুক্তরাষ্ট্র। ১০ ডিসেম্বর ভার্চ্যুয়াল এই আলোচনা শেষ হয়। বলাই বাহুল্য, চীন এই সম্মেলনে আমন্ত্রণ পায়নি; বরং বেইজিং যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে ‘গণবিধ্বংসী অস্ত্র’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। এর ব্যাখ্যাও দিয়েছে চীন। বলেছে, জো বাইডেন স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার মতাদর্শগত বিভেদ সৃষ্টি করছেন। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে অন্য দেশে হস্তক্ষেপ করার জন্য গণতন্ত্রকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র।
এভাবেই বছরজুড়ে চলেছে চীন–তাইওয়ান–হংকংয়ের উত্তেজনা। আর যুক্তরাষ্ট্রের নানা কর্মকাণ্ড সেই উত্তেজনায় ঘি ঢেলেছে। এই উত্তেজনা আসলে বহু পুরোনো। চীনে ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্টরা শাসনক্ষমতা দখল করার পর তাইওয়ান মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা হয়ে যায়। তাইওয়ানের স্বাধীনতা চীন ঠেকাতে চায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দৃশ্যত ওয়াশিংটনের দীর্ঘদিনের ‘এক চীন’ নীতির প্রতি ইঙ্গিত করছেন, যেখানে রাষ্ট্র হিসেবে তাইওয়ান নয়, চীনকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। তিনি তাইওয়ান চুক্তি মেনে চলতে সি চিন পিংকে অনুরোধ–উপরোধ করে আসছেন। আবার তাইওয়ানকে প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতাও দিয়ে আসছেন।
আগামী বছর তাইওয়ান ইস্যুতে চীন কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে কি না অথবা যুক্তরাষ্ট্র বিরোধ আরও উসকে দেবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, বিবিসি, এএফপি