জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইশিবা শিগেরু
জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইশিবা শিগেরু

জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইশিবা আগাম নির্বাচনের পরীক্ষা উতরাতে পারবেন কি

জাপানের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের নির্বাচন ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে। ভোট সামনে রেখে আজ মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) থেকে শুরু হয়েছে নির্বাচনী প্রচার।

নির্ধারিত সময়ের আগেই জাপানে এই নির্বাচন হচ্ছে। কারণ, নতুন প্রধানমন্ত্রী ইশিবা শিগেরু নিম্নকক্ষ ভেঙে দিয়েছেন। তিনি নতুন করে জনগণের ‘ম্যান্ডেট’ আদায়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে এই নির্বাচনকে ইশিবার জন্য কঠিন পরীক্ষা হিসেবে দেখছেন অনেকে।

জাপানের পার্লামেন্ট দুই কক্ষবিশিষ্ট। নিম্নকক্ষের আসনসংখ্যা ৪৬৫টি। ভেঙে দেওয়ার আগে নিম্নকক্ষের প্রধান ক্ষমতাসীন উদার গণতন্ত্রী দল এলডিপি ও জোটের ছোট অংশীদার কোমেই পার্টির সম্মিলিত আসনসংখ্যা ছিল ২৮৮টি।

আসন্ন নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রাখতে হলে এই দুই দলের ২৩৩টি আসনে জয়লাভ করতে হবে। এই লক্ষ্য অর্জনকে কঠিন কাজ বলে মনে করছেন না জাপানের রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। এ বিষয়ে একই মত উঠে আসছে জাপানের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে।

তবে কথা হলো, আগের স্বস্তিপূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখা জোটের পক্ষে সম্ভব হবে কি না, তা সম্ভব না হলে ইশিবাকে নিজ দলের ভেতরেই প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে।

কেননা, ইশিবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার প্রক্রিয়ায় তাঁকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সমর্থক হিসেবে পরিচিত একটি গোষ্ঠীর বলিষ্ঠ বিরোধিতা মোকাবিলা করতে হয়েছিল।

এই গোষ্ঠীটির সবচেয়ে পরিচিত মুখ তাকাইচি সানায়ে। তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিযোগিতায় টিকে ছিলেন।

ইশিবা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়ার জন্য তাকাইচিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু তাকাইচি এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন।

ফলে দলের ভেতরের বিরোধীরা যে সামনে সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে, সে কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। তাই ২৭ অক্টোবরের সাধারণ নির্বাচনকে অনেকেই ইশিবার জন্য কঠিন পরীক্ষা হিসেবে দেখছেন।

এলডিপির সংসদ সদস্যদের আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। নির্বাচনী প্রচার শুরু হওয়ার মুখে এই অভিযোগ সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে ইশিবার নেওয়া পদক্ষেপকে অনেকেই বিতর্কিত হিসেবে দেখছেন।

আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠা সংসদ সদস্যদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় অনেকে এবারের নির্বাচনে দলের প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।

ইশিবা অবশ্য সমালোচনা খারিজ করে দিয়েছেন। বলছেন, একক আসনবিশিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় এঁদের (অভিযোগ ওঠা) প্রার্থী হওয়ার সুযোগ তিনি করে দিয়েছেন। তবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নির্বাচনে এঁরা অংশ নিতে পারবেন না। এই বিষয়টিকে তিনি অপরাধের শাস্তি হিসেবে বিবেচনা করছেন।

তবে ভোটারেরা ইশিবার এমন যুক্তি কতটা গ্রহণ করবেন, তা স্পষ্ট নয়।

জাপানের প্রধান বিরোধী সাংবিধানিক গণতন্ত্রী দল সিডিপি প্রতিদ্বন্দ্বীর দুর্বল দিকগুলোতে আঘাত করার মধ্যে দিয়ে নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছে।

সিডিপি আগাম নির্বাচন ডাকারও বিরোধিতা করেছিল। দলটির নেতা নোদা ইওশিহিকো অভিযোগ করে বলেছিলেন, তড়িঘড়ি করে নির্বাচন আহ্বানের উদ্দেশ্য হলো, আর্থিক কেলেঙ্কারি থেকে ভোটারদের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা। এই চেষ্টার জন্য তিনি ইশিবাকে অভিযুক্ত করেন।

প্রধান বিরোধী দল বলছে, প্রতিরক্ষানীতির প্রশ্নে এশিয়া মহাদেশের জন্য একটি ‘ন্যাটো’ জোট গড়ার চেষ্টার কথা উল্লেখ করেছিলেন ইশিবা। কিন্তু তিনি দেশের বাইরে খুব বেশি সমর্থন নিশ্চিত করতে পারেননি। তাই আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন তিনি। এই সরে আসাকে বিষয়টিকে প্রধান ইশিবার দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করছে প্রধান বিরোধী দল।

ইশিবা অবশ্য বলছেন, ‘এশিয়ার ন্যাটো’ প্রশ্নে তিনি উল্টো দিকের পথে হেঁটে যাননি। বরং বাস্তব পরিস্থিতির আলোকে অবস্থানগত দিক থেকে কিছুটা সমন্বয় তাঁকে করে নিতে হয়েছে।

বিরোধী দলগুলো অন্য আরেকটি বিষয় নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা করছে আর তা হলো জাপানে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়া।

বিরোধী দলগুলো বলছে, নাগরিকদের ওপর বাড়তি চাপ হয়ে দেখা দিচ্ছে জীবনযাত্রার ব্যয়ের দিকটি। পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে যা করা দরকার, তা হলো গৃহস্থলী সমর্থন জোরদার করা।

সিডিপি বলছে, সরকার গঠনে সক্ষম হলে তারা নাগরিক জীবনের সমস্যা সমাধানে সহায়তামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেবে।

বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন, সাধারণ ভোটারদের আকৃষ্ট করার লক্ষ্যেই সিডিপি বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে। তবে এমন সব কর্মসূচির কথা বলে আসন্ন নির্বাচনে এলডিপিকে ক্ষমতা থেকে হটানো সিডিপির পক্ষে সম্ভব হবে না।

বিশ্লেষকদের এই ধারণার পেছনে আছে এক দশকের বেশি আগে ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় সিডিপির ভেতরকার বিভিন্ন উপধারার অনুসারীদের মধ্যে শুরু হওয়া কোন্দল। আর সেই কোন্দল থেকে সরকারি কর্মকাণ্ডে দেখা দেওয়া স্থবিরতা।

ধারণা করা হচ্ছে, আসন্ন নির্বাচনে এলডিপির আসনসংখ্যা কমে গেলেও তা ২৩৩টির নিচে কোনো অবস্থাতেই যাবে না। তবে আসনসংখ্যা কমলে তা দলের ভেতরে ইশিবার অবস্থানকে দুর্বল করে দিতে পারে।

বার্তা সংস্থা কিওদো নিউজ গত শনি ও রোববার দেশব্যাপী একটি জরিপ চালিয়েছে। জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তাঁরা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নির্বাচনে ইশিবার নেতৃত্বাধীন এলডিপিকে বেছে নেবেন।

অন্যদিকে ১২ দশমিক ৪ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তাঁরা প্রধান বিরোধী সাংবিধানিক গণতন্ত্রী দলকে ভোট দেবেন।

একক আসনের নির্বাচনী এলাকার ক্ষেত্রে ৪৬ দশমিক ৬ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তাঁরা কাকে ভোট দেবেন, তা তাঁদের জানা নেই। ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, এলডিপির প্রার্থীকে তাঁরা ভোট দেবেন। আর ২২ দশমিক ৯ শতাংশ উত্তরদাতা বিরোধী দলের প্রার্থীকে বেছে নেওয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন।

জাপানের অতীতের বেশ কয়েকটি নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যাঁরা এখনো সিদ্ধান্ত নেননি, এমন অনিশ্চিত ভোটারদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর দিকে ঝুঁকে পড়েন। তাই আসন্ন নির্বাচনে ইশিবার সামনে যে বড় কোনো বিপদ দেখা দেবে না, তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়।

জাপানের নিম্নকক্ষের ৪৬৫টি আসনের মধ্যে ২৮৯টি একক আসনবিশিষ্ট নির্বাচনী এলাকার জন্য নির্ধারিত। এসব আসনে বিভিন্ন প্রার্থীর মধ্যে সরাসরি প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে। আর সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া প্রার্থী বিজয়ী হন।

অবশিষ্ট ১৭৬টি আসনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নির্বাচন হয়ে থাকে। সারা দেশকে ১১টি ভাগে ভাগ করে প্রতিটি অংশের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের প্রার্থীদের একটি তালিকা নির্বাচন পরিচালনা কার্যালয়ে জমা দিতে হয়। দলের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাত অনুসরণ করে এই তালিকা থেকে বিজয়ীদের নির্ধারণ করে নেওয়া হয়।