২০০১ সালের ১ জুন রাতে নেপালের রাজপ্রাসাদে রাজপরিবারের সদস্যদের নিয়ে নৈশভোজের আয়োজন করা হয়েছিল। শেষপর্যন্ত এই নৈশভোজ এক রক্তাক্ত ট্র্যাজেডিতে রূপ নেয়। সেদিনের ঘটনায় রাজা-রানি-যুবরাজসহ রাজপরিবারের মোট ১০ সদস্য নিহত হন। আমাদের বিশেষ আয়োজনে আজ থাকছে নেপালের প্রাসাদ-হত্যাযজ্ঞের আদ্যোপান্ত।
এমনই এক গ্রীষ্মের রাত। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর নারায়ণহিতি রাজপ্রাসাদে রাজপরিবারের সদস্যরা নৈশভোজ সারতে একসঙ্গে বসেছেন।
কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই নৈশভোজ স্থলে অতর্কিতে শুরু হয় মুহুর্মুহু গুলি। নিহত হন নেপালের রাজা বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব, রানি ঐশ্বরিয়া রাজ্য লক্ষ্মী দেবীসহ রাজপরিবারের ৯ সদস্য।
এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত অন্যরা হলেন বীরেন্দ্রর ছেলে নিরাজন, মেয়ে শ্রুতি, ভাই ধীরেন্দ্র, বোন শান্তি ও শারদা, শারদার স্বামী কুমার খড়গা ও বীরেন্দ্রর আত্মীয় জয়ন্তী।
বীরেন্দ্রর বড় ছেলে যুবরাজ (ক্রাউন প্রিন্স) দীপেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেবের গুলিতে রাজপরিবারের এই সদস্যরা নিহত হন। পরে দীপেন্দ্র নিজেই নিজেকে গুলি করেন বলে বলা হয়। গুলিতে আহত হয়ে তিনি কোমায় চলে যান।
বাবার মৃত্যুর পর কোমায় থাকা দীপেন্দ্রকে নেপালের রাজা ঘোষণা করা হয়। ঘটনার তিন দিন পর তিনি হাসপাতালে মারা যান। নিয়ম অনুসারে, নেপালের রাজা হন তাঁর চাচা জ্ঞানেন্দ্র (বীরেন্দ্রর ভাই)।
বলতে গেলে এক রাতে নেপালের পুরো রাজপরিবার শেষ হয়ে যায়। হিমালয়–কন্যা হিসেবে পরিচিত নেপালের রাজপরিবারে এই রক্তাক্ত ট্র্যাজেডি ঘটে আজ থেকে ২৩ বছর আগে, ২০০১ সালের ১ জুন।
বীরেন্দ্রর জন্ম ১৯৪৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর। কাঠমান্ডুর এই রাজপ্রাসাদেই জন্ম নেন তিনি। তাঁরা বাবা রাজা মহেন্দ্র।
যুক্তরাজ্যের ঐতিহ্যবাহী ইটন কলেজে পড়েছেন বীরেন্দ্র। পড়েছেন জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঐশ্বরিয়াকে বিয়ে করেন বীরেন্দ্র। এই দম্পতির প্রথম ছেলে দীপেন্দ্র। তাঁর জন্ম ১৯৭১ সালে।
বাবার মতো দীপেন্দ্রও পড়েছেন ইটন কলেজে। তিনি নেপালের মিলিটারি একাডেমিতে যোগ দিয়েছিলেন। রয়্যাল নেপালিজ গুর্খা আর্মির একাডেমি থেকে নিয়েছিলেন সামরিক প্রশিক্ষণ।
পরে বীরেন্দ্র-ঐশ্বরিয়ার আরও দুই সন্তান হয়। মেয়ে শ্রুতি, জন্ম ১৯৭৬ সালে। ছেলে নিরাজনের জন্ম ১৯৭৮ সালে।
রাজা মহেন্দ্রর মৃত্যুর পর ১৯৭২ সালে নেপালের সিংহাসনে বসেন বীরেন্দ্র। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি পূর্ণ রাজা হিসেবে নেপাল শাসন করেন। ১৯৯০ সালে দেশটিতে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হয়। নতুন এই ব্যবস্থায় রাজার পদ হয়ে পড়ে পুরোপুরি সাংবিধানিক।
নৈশভোজ স্থলে সবার আগে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় হাজির হয়েছিলেন যুবরাজ দীপেন্দ্র। তিনি সেখানে মদ্যপান করতে থাকেন। মাতাল হয়ে টলতে থাকেন। এমনকি তিনি বাজে আচরণও করেন। নৈশভোজ থেকে তাঁকে চলে যেতে বলেন রাজা বীরেন্দ্র।
রাত ৮টা ১৫ মিনিটের দিকে দীপেন্দ্রকে ধরাধরি করে তাঁর শোবার ঘরে নিয়ে যান ছোট ভাই নিরাজন, চাচাতো ভাই পরসসহ অন্যরা।
শোবার ঘরে যাওয়ার পর দীপেন্দ্র তাঁর প্রেমিকা দেবযানী রানাকে তিনবার ফোন করেন। শেষবার তিনি দেবযানীকে ‘শুভরাত্রি’ জানিয়ে নিজে ঘুমাতে যাওয়ার কথা বলেছিলেন।
দীপেন্দ্র হাসিস দিয়ে তৈরি সিগারেট পান করে। পরে শৌচাগারে গিয়ে বমি করেন। এবার তিনি সামরিক পোশাক পরেন। একটি এম-১৬ অ্যাসল্ট রাইফেলসহ একাধিক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে তিনি তাঁর শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন।
রাজপ্রাসাদের এক সহকারী দীপেন্দ্রকে আগ্নেয়াস্ত্রসহ সিঁড়িতে দেখেছিলেন। কিন্তু দীপেন্দ্র যে ভয়ংকর কিছু ঘটাতে যাচ্ছেন, তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। কারণ, আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করাটা দীপেন্দ্রর শখ ছিল।
রাত ৯টার দিকে নৈশভোজ স্থলে ফিরে আসেন দীপেন্দ্র। তিনি প্রথমে ছাদের দিকে গুলি ছোড়েন। এরপর মেতে ওঠেন হত্যাযজ্ঞে।
দীপেন্দ্র প্রথমেই তাঁর বাবা বীরেন্দ্রকে গুলি করেন। তারপর একে একে অন্যদের। সেখানে বেশ কয়েকজনকে হত্যার পর তিনি রাজপ্রাসাদের বাগানে যান তাঁর মায়ের খোঁজে।
ছোট ভাই নিরাজন মাকে রক্ষায় এগিয়ে আসেন। সেখানে ছোট ভাই ও মা দুজনকেই গুলি করে হত্যা করেন দীপেন্দ্র।
মা–বাবা, ভাই-বোনসহ মোট ৯ জনকে হত্যার পর দীপেন্দ্র নিজেই নিজেকে গুলি করেন বলে কথিত আছে।
এ ছাড়া সেদিন দীপেন্দ্রর গুলিতে রাজপরিবারের চার সদস্য আহত হন। ঘটনার ১৬ ঘণ্টা পর রাজপ্রাসাদে হত্যাযজ্ঞের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়।
রাজপ্রাসাদে হত্যাযজ্ঞের ঘটনা তদন্তে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি করা হয়। মাত্র এক সপ্তাহের তদন্তের ভিত্তিতে প্রতিবেদন দেয় কমিটি। তারা এই হত্যাযজ্ঞের জন্য দীপেন্দ্রকে দায়ী করে। তবে তিনি কেন এই হত্যাযজ্ঞ ঘটালেন, সে বিষয়ে কমিটি কিছু বলেনি। কমিটির প্রতিবেদন নেপালের মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়নি।
নেপালের রাজপরিবারে সংঘটিত এই হত্যাযজ্ঞের নেপথ্যের কারণ নিয়ে নানা ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ ছড়ায়। বহুল চর্চিত ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বটি’ হচ্ছে দীপেন্দ্রর প্রেম-ভালোবাসা-বিয়েঘটিত।
ইটন কলেজে পড়ার সময় দীপেন্দ্রর সঙ্গে দেবযানীর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সে সময় দেবযানীও যুক্তরাজ্যে পড়ছিলেন।
দেবযানী নেপালের একসময়ের সাবেক শাসক জঙ্গ বাহাদুর রানা পরিবারের মেয়ে। তাঁর বাবা পশুপতি রানা। তিনি নেপালের একজন নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদ। তিনি মন্ত্রীও ছিলেন। দেবযানীর মা ঊষা রাজে সিন্ধিয়া। তিনি ভারতের সিন্ধিয়া রাজপরিবারের মেয়ে।
এমন কথা বলা হয়ে থাকে, দীপেন্দ্র-দেবযানীর সম্পর্ক মানতে চাইছিলেন না বীরেন্দ্র-ঐশ্বরিয়া। বিশেষ করে ঐশ্বরিয়া তাঁর ছেলের এই সম্পর্ক ভেঙে দিতে অনড় ছিলেন। এ নিয়ে মা–বাবার সঙ্গে দীপেন্দ্রর ঝগড়াবিবাদ পর্যন্ত হয়েছিল।
মা–বাবার আপত্তি সত্ত্বেও দীপেন্দ্র তাঁর প্রেমিকা দেবযানীর সঙ্গে সম্পর্ক চালিয়ে যান। তাঁরা গোপনে পরস্পরের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ অব্যাহত রাখেন।
দেবযানীকে বিয়ের পরিকল্পনা করছিলেন দীপেন্দ্র। একপর্যায়ে তিনি মা–বাবার কাছে এই পরিকল্পনার কথা বলেন। এতে ঘোর আপত্তি জানান বীরেন্দ্র-ঐশ্বরিয়া। তাঁরা কোনোমতেই দেবযানীকে রাজবধূ করতে চাইছিলেন না। তাঁরা চেয়েছিলেন, দীপেন্দ্র শাহ পরিবারের ভেতরের কাউকে বিয়ে করুক।
দেবযানী ইস্যুতে ২০০১ সাল নাগাদ রাজা-রানির সঙ্গে দীপেন্দ্রর সম্পর্ক চরম তিক্ত পর্যায়ে চলে যায়। বলা হয়, দীপেন্দ্র যদি দেবযানীকে বিয়ের পরিকল্পনায় অনড় থাকেন, তাহলে তাঁকে সিংহাসনের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। তাঁকে বলা হয়েছিল, দেবযানীকে নিয়ে দীপেন্দ্র বেশি বাড়াবাড়ি করলে তাঁর ছোট ভাইকে ক্রাউন প্রিন্স (সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকার) করা হবে। দেবযানীকে বিয়ে করার বিষয়ে মা–বাবার কাছ থেকে অনুমতি না পাওয়ায় ‘প্রণয়কাতর’ যুবরাজ দীপেন্দ্র রাজ-নৈশভোজের আসরে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছিলেন।
দীপেন্দ্রকে বিয়ে করার বিষয়টি নিয়ে দেবযানীদের পরিবারেরও ‘দ্বিধাদ্বন্দ্ব’ ছিল বলে বলা হয়। দেবযানী স্থানীয় অভিজাত, ধনি পরিবারের মেয়ে। তিনি বিপুল বিত্তবৈভবের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন। বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত দেবযানীর মা এই বিষয়ে মেয়েকে সতর্ক করেছিলেন। বলেছিলেন, দীপেন্দ্রর সঙ্গে বিয়ে হলে দেবযানী নেপালের ভবিষ্যৎ রানি হবেন ঠিকই, কিন্তু রানা পরিবারের তুলনায় নেপালি রাজপরিবার ‘গরিব’। দেবযানী বিয়ে করে এমন ঘরে গেলে তিনি টিকতে পারবেন কি না, তা তাঁর গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা দরকার।
হত্যাযজ্ঞ নিয়ে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কথাও চাউর হয়েছিল। সন্দেহের তীর যায় দীপেন্দ্রর চাচা জ্ঞানেন্দ্রর দিকে। হত্যাযজ্ঞের রাতে তিনি রাজপ্রাসাদে ছিলেন না। আর দীপেন্দ্রর মৃত্যুর পর তিনিই হন নেপালের রাজা।
ব্যাপক গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে জ্ঞানেন্দ্র ও তাঁর ছেলে পরসের যোগসাজশে এই হত্যাযজ্ঞ ঘটে। এই সন্দেহের কারণ হিসেবে বলা হয়, নৈশভোজে জ্ঞানেন্দ্র ছিলেন না। তাঁর ছেলে পরস নৈশভোজে থাকলেও তিনি ঠিকই বেঁচে যান। কাজেই তাঁরা এই হত্যাযজ্ঞের মূল হোতা, সুবিধাভোগী। তাঁরা দীপেন্দ্রকে ফাঁসিয়েছেন।
বীরেন্দ্র-দীপেন্দ্রদের চিরতরে সরিয়ে দিয়ে সিংহাসন দখল করেন জ্ঞানেন্দ্র। আর তাঁর ছেলে হন সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী। যদিও জ্ঞানেন্দ্র ও পরস এই অভিযোগ নাকচ করেন।
বলা হয়, সবাইকে মেরে দীপেন্দ্র নিজেই নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন। তবে এ নিয়েও নেপালিদের মধ্যে বিস্তর সন্দেহ আছে।
কেউ কেউ বলেন, গণতন্ত্রের জন্য গণবিক্ষোভের মুখে ১৯৯০ সালে নেপালে বহুদলীয় গণতন্ত্র শুরু হয়। দেশটিতে পূর্ণ রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। আসে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। রাজা বীরেন্দ্রর এই সিদ্ধান্ত তাঁর ছেলে দীপেন্দ্রকে ক্ষুব্ধ করেছিল। তাঁর মনে হয়েছিলে, উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি যে ক্ষমতা পাবেন, তা হবে নামমাত্র। এই ক্ষোভ থেকে তিনি হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়ে থাকতে পারেন।
হত্যাযজ্ঞের ঘটনার পর নেপালের মাওবাদী নেতা বাবুরাম ভট্টরাই এক নিবন্ধে রাজপরিবারে এই হত্যাযজ্ঞকে একটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ফল বলে ইঙ্গিত দেন। নেপালের সাবেক এক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই দাবি করেন, রাজপরিবারকে শেষ করে দেওয়াটা ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ চক্রান্তের অংশ ছিল।
তবে কারও কারও মতে, এই হত্যাযজ্ঞ ছিল স্রেফ নিয়তি।
ঘটনার এত বছর পরও নেপালের প্রাসাদ-হত্যাযজ্ঞের নেপথ্যের কারণ অজানা রয়ে গেছে। এই হত্যাযজ্ঞের সাত বছর পর ২০০৮ সালে নেপালে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করা হয়। দেশটিকে একটি প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। রাজপ্রাসাদকে করা হয় জাদুঘর।
তথ্যসূত্র: নেপালি টাইমস, নিউইয়র্ক টাইমস, বিবিসি, এবিসি নিউজ (অস্ট্রেলিয়া), নেপাল রিসার্স ডটকম।