প্যারিস চুক্তিতে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন ও গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ৫০ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
গতকাল সম্মেলন শুরু হয়েছে। চলবে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিস্ময়কর বিজয় জলবায়ু সম্মেলনের আসরে কতটা প্রভাব ফেলেছে, বাকুতে পা দিয়ে বোঝা যাবে না। কারণ, আজারবাইজানের রাজধানী বাকু এই মুহূর্তে জলবায়ুময়। বিমানবন্দর থেকে শহরের আনাচকানাচে যেখানে যাবেন; দেখবেন, এ দেশের সরকারের দৃপ্ত অঙ্গীকার, ‘ইন সলিডারিটি ফর আ গ্রিন ওয়ার্ল্ড’। পৃথিবীকে তাপমুক্ত করা ছাড়া যেন আর কোনো কাজই এ দেশের সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়।
কথা ও কাজের ফারাক যাতে না থাকে, তাই ছবিতুল্য শহরটাকে মুড়ে দেওয়া হয়েছে হালকা সবুজের চাদরে। কচি কলাপাতার সেই রং, যা উষ্ণায়ন কমানোর প্রতীক হয়ে গেছে পশ্চিম এশিয়া ও ইউরোপের দ্বারপ্রান্তে অবস্থিত এই দেশের রাজধানীর, তার অর্থবলের উৎস অঢেল তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস। সম্মেলনের আনাচকানাচে এই বৈপরীত্য পরিহাসের মতো ঝুলে রয়েছে আরও এ কারণে—জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে এ দেশের সরকার কিছুদিন আগেও তেমন কোনো গরজ দেখায়নি।
সম্মেলনের অন্যতম লক্ষ্য জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ধনী রাষ্ট্রের কাছ থেকে গরিব ও মধ্যবিত্ত দেশের জন্য অর্থের বন্দোবস্ত করা।
তাহলে কেন আজারবাইজানকে জলবায়ু সম্মেলনের আসর হিসেবে বেছে নেওয়া হলো—জানতে চাইলে স্থানীয় পরিবেশকর্মীদের কণ্ঠে সহাস্য বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর ঝরে পড়ে। প্রত্যয়ের সঙ্গে তাঁরা বলেন, ‘ক্লাসের দুর্বিনীতদের মনিটরের দায়িত্ব দিয়ে শোধরানোর সুযোগ দেওয়া হয়। ভেবে দেখুন, গতবার ছিল দুবাই, এবার বাকু। দুই দেশের অর্থনীতিই জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর ভেসে রয়েছে।’
এই প্রত্যয় স্বতঃস্ফূর্ত হলেও বাস্তবে কতটা ফলদায়ী হতে চলেছে, সেই সন্দেহ ও সংশয় বাকুর জলবায়ু সম্মেলনের পরতে পরতে মাখামাখি হয়ে রয়েছে। গতকাল সোমবার সম্মেলন শুরুর প্রথম দিনেই তার চর্চা সর্বত্র। সম্মেলন চলবে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতাসীন হওয়া সেই সন্দেহের মূল হলেও বাকুতে একের পর এক বৈশ্বিক নেতার অনুপস্থিতির খবরও হতাশা ছড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আসছেন না। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংও নন।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েনও জানিয়ে দিয়েছেন আসতে পারছেন না। গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেওয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও বাকু থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখলেন। শোনা যাচ্ছে, সে দেশের পরিবেশমন্ত্রী ভূপেন্দ্র যাদবও দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন না। তাঁর ওপর গুরুদায়িত্ব পড়েছে মহারাষ্ট্র নির্বাচনে বিজেপির বৈতরণি পারের। ভারতের প্রতিনিধিত্ব করতে বাকু আসছেন পররাষ্ট্র ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী কীর্তিবর্ধন সিং। ফলে রথী–মহারথীহীন বাকু বৈশ্বিক তাপমান প্রাক্–শিল্পায়ন যুগের মতো ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ধরে রাখার অঙ্গীকারটুকু পর্যন্ত সগর্বে করতে পারবে কি না, সেই সন্দেহের ঢেউ তিরতির করে বইছে সম্মেলন শুরুর আগে থেকেই।
নইলে গরিব দেশ তো মরেই রয়েছে, বড়লোক দেশগুলোরও পঞ্চত্বপ্রাপ্তি অনিবার্য। দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস পেরিয়ে তাপমান তিন ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। দেশে দেশে তার ঝলক দৃশ্যমান।
প্যারিস চুক্তিতে ঠিক হয়েছিল, বৈশ্বিক তাপমান দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে ধরে রাখা। সে জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে কার্বন ও গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ৫০ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য লড়াই করতে উন্নত দেশগুলোর বছরে ১০ কোটি ডলার অর্থসাহায্য দেওয়ার বিষয়টিও নির্দিষ্ট হয়েছিল। প্যারিস চুক্তি ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম দফার ক্ষমতায়ন প্রায় পিঠাপিঠি। তার প্রভাব কী হয়েছিল সবার জানা।
সেই চক্র ফের ঘুরে আসতে চলেছে কি না, আবহজুড়ে চলছে তারই চর্চা। অথচ বিশ্বের ১৩০টি দেশের ১ হাজার ৯০০ নাগরিক সমাজ সংগঠনের ফোরাম ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক’–এর নির্বাহী পরিচালক তাসমিন ইসপ তাঁদের প্রত্যাশার কথা দৃপ্তভাবে জানিয়ে দিয়ে বলেছেন, পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে বছরে একনাগাড়ে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করতে হবে। নইলে গরিব দেশ তো মরেই রয়েছে, বড়লোক দেশগুলোরও পঞ্চত্বপ্রাপ্তি অনিবার্য। দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস পেরিয়ে তাপমান তিন ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। দেশে দেশে তার ঝলক দৃশ্যমান।
চাহিদা ও বাস্তবের ফারাক কতখানি, বাকু সম্মেলনেই বোঝা যাবে। এই সম্মেলনের মূল লক্ষ্যই তো ধনী রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে গরিব ও মধ্যবিত্ত দেশের জন্য অর্থের বন্দোবস্ত করা। যাতে উষ্ণায়নের ছ্যাঁকা থেকে সবাই বাঁচতে পারে। তা হবে কি? প্রশ্নটা ঝুলে রয়েছে।
বাকুর একটি হোটেলে সমন্বয় সভায় বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের প্রধান প্রচেষ্টা হবে আমাদের উদ্বেগ ও দাবিগুলো কপ ২৯-এর চূড়ান্ত ঘোষণায় অন্তর্ভুক্ত করা।’
বাকুতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস
গতকাল সপর্ষদ বাকুতে পৌঁছেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বাসস জানায়, সেখানে পৌঁছানোর পরপরই তিনি বাংলাদেশের কর্মকর্তা, এনজিও ও সুশীল সমাজের নেতাদের জলবায়ু সংকটের উদ্বেগ তুলে ধরতে অতিরিক্ত প্রচেষ্টা চালানোর আহ্বান জানান।
বাকুর একটি হোটেলে সমন্বয় সভায় বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের প্রধান প্রচেষ্টা হবে আমাদের উদ্বেগ ও দাবিগুলো কপ ২৯-এর চূড়ান্ত ঘোষণায় অন্তর্ভুক্ত করা।’ আজ মঙ্গলবার ড. ইউনূসের কপের মূল শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবেন। সম্মেলনে অন্তত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার কথা রয়েছে তাঁর।