ধ্বংসস্তূপ থেকে নবজাতক ইয়াগিজকে উদ্ধারের পর হাসপাতালে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়
ধ্বংসস্তূপ থেকে নবজাতক ইয়াগিজকে উদ্ধারের পর হাসপাতালে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়

১০ দিনের সন্তানকে নিয়ে ধ্বংসস্তূপে এক তুর্কি মায়ের টিকে থাকার গল্প

তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় হাতায় প্রদেশের একটি বাড়িতে সপরিবার থাকতেন নেচলা কামুজ। এই নারী গত ২৭ জানুয়ারি দ্বিতীয় ছেলেসন্তানের জন্ম দেন। নাম রাখা হয় ইয়াগিজ। এর অর্থ ‘সাহসী’। ছেলের জন্মের ১০ দিন পর ৬ ফেব্রুয়ারি ভোরে সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছিলেন। স্থানীয় সময় ৪টা ১৭ মিনিটে হঠাৎই শক্তিশালী ভূমিকম্পে ভবনটি বিধ্বস্ত হয়। নবজাতকসহ তিনি ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়েন। চার দিন পর নবজাতকসহ জীবিত উদ্ধার হন তাঁরা। বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ধ্বংসস্তূপে থাকাকালীন সেই দুঃসহ স্মৃতি বর্ণনা করেছেন এই নারী।

সামানদাগ শহরে একটি আধুনিক পাঁচতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় সপরিবার থাকতেন নেচলা। তাঁর ভাষায়, ভবনটি দারুণ ছিল। এটিকে নিরাপদ মনে হতো তাঁর।

ভূমিকম্পের সময়ের কথা বর্ণনা করে নেচলা কামুজ বলেন, ‘ভূমিকম্প শুরুর পর আমি আরেক কক্ষে থাকা আমার স্বামীর কাছে যেতে চেয়েছিলাম। সে–ও একই কাজ করতে চেয়েছিল। কিন্তু অন্য সন্তানকে নিয়ে সে যখন আমার কাছে আসার চেষ্টা করল, তখন তাদের গায়ের ওপর ওয়ার্ডরোবটি পড়ে যায়। সেখান থেকে সরাটা তাদের জন্য কঠিন ছিল।’

নেচলা আরও বলেন, এরপর দেয়াল ভেঙে পড়ে, কক্ষটিতে ঝাঁকুনি হচ্ছিল। ভূমিকম্প শেষ হওয়ার পর ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে স্বামী আর বড় সন্তানের নাম ধরে ডাকছিলেন। কিন্তু সাড়া পাচ্ছিলেন না।

৩৩ বছর বয়সী নেচলা তখনো নবজাতক সন্তানকে দুই হাত দিয়ে ধরে বুকে আগলে রেখেছিলেন। তাঁদের পাশেই পড়ে আছে একটি ওয়ার্ডরোব। সেটির কারণেই তাঁরা প্রাণে বেঁচে যান। ওই ওয়ার্ডরোবের কারণেই কংক্রিটের বিশাল একটি স্ল্যাব তাঁদের গায়ের ওপর পড়তে পারেনি।

ধ্বংসস্তূপের নিচে মা-ছেলে প্রায় চার দিন ওই অবস্থায় ছিলেন।

আটকে পড়ার প্রথম দিন

ধ্বংসস্তূপের নিচে শুয়ে নেচলা কিছুই দেখতে পারছিলেন না। সবকিছু অন্ধকার মনে হচ্ছিল। এমন অবস্থায় কী ঘটছে, তা বোঝার জন্য অন্য ইন্দ্রিয়গুলোর ওপর ভর করতে হয়েছে তাঁকে। ইয়াগিজ তখনো নিশ্বাস নিচ্ছে, সে কথা ভেবে নিজেকে আশ্বস্ত করছিলেন। শুরুতে ধুলার কারণে তিনি শ্বাস নিতে পারছিলেন না। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে তা ঠিক হয়ে যায়। ধ্বংসস্তূপের ভেতরে তিনি উষ্ণ ছিলেন।

নেচলার মনে হচ্ছিল তাঁর শরীরের নিচে শিশুদের খেলনা পড়ে আছে। কিন্তু তা পরীক্ষা করার জন্য নড়াচড়া করতে পারছিলেন না। চারপাশে শুধু কংক্রিট আর ধ্বংসাবশেষ।

দূর থেকে মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে নেচলা চিৎকার করে সাহায্যে চাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু এতে কাজ হয়নি। এরপর পাশ থেকে কিছু ধ্বংসাবশেষ নিয়ে তা ওয়ার্ডরোবের দিকে ছুড়ে মেরে শব্দ করার চেষ্টা করেন। এরপরও কারও সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না।

নেচলা ভয় পেয়ে যান। মনে হতে থাকে সেখানে হয়তো কেউ আর আসবে না।

সপরিবার নেচলা কামুজ

ধ্বংসস্তূপের নিচে কাটানো জীবন

ধ্বংসস্তূপের নিচে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সময় বোঝার উপায় নেই। তবে নেচলা জানতেন যে ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও ছেলে ইয়াগিজকে দেখে রাখতে পারবেন। বদ্ধ জায়গাটিতেও সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে পেরেছেন তিনি। তবে নিজের জন্য কোনো খাবার বা পানি খুঁজে পাননি। উপায় না পেয়ে নিজের বুকের দুধ খাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি।

ধ্বংসাবশেষের নিচে থাকা নেচলা ড্রিল মেশিনের শব্দ, মানুষের পায়ের শব্দ এবং গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলেন। তবে শব্দগুলো শুনে মনে হচ্ছিল অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে।

নেচলা সিদ্ধান্ত নিলেন, ওই শব্দ কাছাকাছি না আসা পর্যন্ত তিনি তাঁর মনোবল ধরে রাখবেন এবং চুপচাপ থাকবেন।

ধ্বংসস্তূপের নিচে বসে বসে স্বামী আর অপর সন্তানের কথা মনে হতো। অন্য স্বজনেরা কী অবস্থায় আছেন, তা নিয়েও ভাবতেন। নবজাতক ইয়াগিজের দিকে তাকিয়ে সাহস সঞ্চার করতেন নেচলা।

ইয়াগিজ বেশির ভাগ সময় ঘুমাত। আবার কাঁদতে কাঁদতে জেগে উঠলে বুকের দুধ পান করিয়ে শান্ত করতেন নেচলা।

উদ্ধারকাজ

৯০ ঘণ্টার বেশি সময় পর নেচলা কুকুর ডাকার শব্দ শুনতে পেলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল স্বপ্ন দেখছেন। কুকুর ডাকার পর মানুষের কণ্ঠস্বরও তাঁর কানে এল।

বাইরে থেকে একজন বলছিলেন, ‘আপনি ঠিক আছেন?’ নেচলা তখন ‘হ্যাঁ’ বলে সাড়া দিলেন।

এরপর নেচলার কাছে জানতে চাওয়া হয়, ‘আপনি কোন অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন?’

পরে উদ্ধারকারীরা ধ্বংসাবশেষ খুঁড়ে নেচলাকে শনাক্ত করেন। তিনি তখনো ইয়াগিজকে আগলে রেখেছিলেন। উদ্ধারকারীদের টর্চের আলোতে সেখানকার অন্ধকার দূর হলো।

ইস্তাম্বুল পৌর ফায়ার সার্ভিস বিভাগের উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা নেচলার কাছে ইয়াগিজের বয়স জানতে চান। তিনি তা নিশ্চিত করে বলতে পারছিলেন না। তিনি শুধু জানতেন, ভূমিকম্পের সময় ইয়াগিজের বয়স ১০ দিন ছিল।

ইয়াগিজকে উদ্ধারকারীদের হাতে দেওয়ার পর নেচলাকে স্ট্রেচারে করে অ্যাম্বুলেন্সের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। নেচলা বলেন, সামনে অনেক ভিড় মনে হচ্ছিল। কাউকে চিনতে পারছিলেন না।

অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানোর পর নেচলার তাঁর অপর সন্তানের খোঁজ জানতে চান।

এ ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার হন নেচলা ও তাঁর সন্তান

ধ্বংসস্তূপ থেকে হাসপাতালের বিছানায়

নেচলাকে হাসপাতালে নেওয়ার পর পরিবারের সদস্যরা জানান, তাঁর স্বামী ইরফান ও তিন বছরের সন্তান ইগিত কেরিমকেও ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁদের পায়ে গুরুতর আঘাত লেগেছে। দুজনকেই আদানা প্রদেশের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। নেচলাকে যেখানে ভর্তি করা হয়, সেখান থেকে ওই হাসপাতালে যেতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে।

তবে নেচলা ও ইয়াগিজ দুজনের কারও গায়েই তেমন একটা আঘাত লাগেনি। ২৪ ঘণ্টা ধরে তাঁদের হাসপাতালে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছিল। পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ফেরার জন্য কোনো বাড়ি ছিল না নেচলার। পরিবারের এক সদস্য তাঁকে কাঠ ও ত্রিপল দিয়ে তৈরি একটি তাঁবুতে নিয়ে যান। সেখানে ১৩ জন থাকেন। তাঁদের সবারই বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে।

নেচলা মনে করেন, নবজাতক সন্তান ইয়াগিজের কারণে তিনি ধ্বংসস্তূপের নিচে টিকে থাকার শক্তি পেয়েছেন।

নেচলা বলেন, ‘আমি মনে করি আমার সন্তান যদি এতটা শক্তভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারত, তাহলে আমার পক্ষেও তা সম্ভব হতো না।’

কথা বলতে বলতেই একটি ভিডিও কল পেয়ে নেচলার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। মুঠোফোনের পর্দায় দেখা যায়, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে স্বামী ইরফান ও বড় ছেলে ইগিত হাসছে আর হাত নাড়ছে।

ইরফান ছোট সন্তানকে বলছিলেন, ‘হে আমার যোদ্ধা পুত্র, কেমন আছ তুমি?’

তুরস্ক-সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পের সাত দিন পেরিয়েছে। ইতিমধ্যে দুই দেশে মৃতের সংখ্যা ৩৩ হাজার ছাড়িয়েছে। বিধ্বস্ত এলাকায় এখনো চলছে উদ্ধার তৎপরতা। ধ্বংসস্তূপে অনেক ভয়াবহতার মধ্যেও মাঝেমধ্যেই অলৌকিকভাবে উদ্ধার হচ্ছে কেউ কেউ। নেচলা কামুজের ঘটনাটিকে তেমনই অলৌকিক ঘটনা বলে উল্লেখ করেছে বিবিসি।