মেয়ে আয়েকে যে কারণে প্রকাশ্যে আনলেন কিম জং–উন

উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং–উন ও তাঁর মেয়ে কিম জু–আয়ে।
ছবি: এএফপি

উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং–উন তাঁর পরিবারের বিষয়ে বেশ রক্ষণশীল। সংবাদমাধ্যমের আলো থেকে পরিবারের সদস্যদের দূরে রাখতেই পছন্দ করেন তিনি। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় আয়োজনে তাঁকে সচরাচর একাই অংশ নিতে দেখা যায়। কদাচিৎ পাশে থাকেন স্ত্রী রি সল–জু। গত সপ্তাহে সেই ধারা ভেঙেছেন কিম। পরপর দুটি রাষ্ট্রীয় আয়োজনে সপরিবার অংশ নিয়েছেন তিনি। তবে স্ত্রী রি সল নন, এসব আয়োজনে পুরো দুনিয়ার নজর কেড়ে নিয়েছে কিমের মেয়ে কিম জু–আয়ে।

প্রথা ভেঙে মেয়েকে প্রকাশ্যে আনায় কিম জং–উনের উদ্দেশ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই বলছেন, তবে কি কিমের উত্তরসূরি হিসেবে উত্তর কোরিয়ার পরবর্তী কান্ডারি হতে যাচ্ছে মেয়ে জু–আয়ে?


বিশ্লেষকদের মতে, নিজের মেয়েকে প্রকাশ্যে আনার এ ঘটনা কাকতালীয় নয়। এর পেছনে কিম জং–উনের উদ্দেশ্য রয়েছে। পুরো বিশ্বকে তিনি মোটাদাগে দুটি বিষয় দেখাতে চান। এক, উত্তর কোরিয়াকে পরিচালনার জন্য কিম পরিবারে আরও একটি প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে। দুই, বিশ্বের কোনো শক্তি উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পথ থেকে হটাতে পারবে না।

গত মঙ্গলবার রাতে রাজধানী পিয়ংইয়ংয়ে একটি সামরিক ব্যারাকে ভোজসভায় অংশ নেন কিম জং–উন। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী রি সল ও মেয়ে কিম জু–আয়ে। এ প্রথম মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে সেনাদের অনুষ্ঠানে অংশ নেন কিম। ওই আয়োজনের ছবিতে মা ও বাবার সঙ্গে জু–আয়েকে খাবারের টেবিলে বসে থাকতে দেখা যায়। পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন উত্তর কোরিয়ার জাঁদরেল সব জেনারেল।

পরদিন পিয়ংইয়ংয়ে অনুষ্ঠিত হয় সামরিক প্যারেড। এ আয়োজনে অন্তত ১১টি আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রদর্শন করে উত্তর কোরিয়া। সামরিক প্যারেড পরিদর্শনের সময়ও বাবার পাশেই ছিল জু–আয়ে। সঙ্গে ছিলেন কিমপত্নী রি সল।

কিম জু–আয়ের বয়স ৯ কি ১০ বছর। ধারণা করা হয়, সে কিম জং–উন ও রি সলের দ্বিতীয় সন্তান। এই দম্পতির আরও দুটি সন্তান রয়েছে। তবে জু–আয়ে কিম জং–উনের সবচেয়ে পছন্দের সন্তান। উত্তর কোরিয়াকে পুরো বিশ্ব থেকে অনেকটা আলাদা করে রেখেছেন কিম জং–উন। দেশটিতে ভ্রমণ করা কিংবা দেশটি সম্পর্কে জানার উৎস খুবই সীমিত। ২০১৩ সালের কিম জং–উনের আমন্ত্রণে পিয়ংইয়ং সফর করেছিলেন মার্কিন বাস্কেটবল তারকা ডেনিস রডম্যান।

উত্তর কোরিয়ায় একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ কেন্দ্র পরিদর্শনে বাবা কিম জং–উনের সঙ্গে মেয়ে কিম জু–আয়ে।
উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্রের একটি প্রতিবেদনে কিম জং–উনের স্ত্রীর আগে জু–আয়ের নাম লেখা হয়েছে। জু–আয়ের নামের আগে ‘প্রিয়’ ও ‘শ্রদ্ধাভাজন’ বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে। এসব জু–আয়ের বাবা কিম জং–উনের উত্তরসূরি হওয়াকে ইঙ্গিত করে।

পরে এক সাক্ষাৎকারে এই তারকা বলেছিলেন, পিয়ংইয়ংয়ে সফরে গিয়ে তাঁর কিম জং–উনের স্ত্রী রি সলের সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছিল। তখন মেয়ে জু–আয়ে তাঁর সঙ্গে ছিল। রডম্যানের ভাষ্য, তিনি যখন উত্তর কোরিয়ায় যান, তখন জু–আয়ের বয়স কয়েক সপ্তাহ। তাই ধারণা করা হচ্ছে, কিমকন্যা জু–আয়ের বয়স ৯ কি ১০ বছর হতে পারে।

এদিকে কিম জং–উনের বয়স এখন ৩৯ বছর। কিম জু–আয়ের বয়সও অল্প। এত অল্প বয়সে কিম জং–উন নিজের উত্তরসূরি নিয়ে ভাববেন, এটাও অবাক করার মতো। তবে উত্তর কোরিয়া ও কিম পরিবারে এটা অনেকটাই স্বাভাবিক ঘটনা। কিম পরিবার ১৯৪৮ সাল থেকে উত্তর কোরিয়া শাসন করে আসছে। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে বাবা কিম দ্বিতীয় জং মারা গেলে উত্তর কোরিয়ায় ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন বয়সে ২০–এর কোটায় থাকা কিম জং–উন।

এই বিষয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলের এওহা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক লেইফ–এরিক অ্যাশলে বলেন, স্ত্রী ও কন্যাকে সামনে এনে কিম জং–উন তাঁর পারিবারিক বংশধারা ও উত্তর কোরিয়ার সামরিকায়নে তাঁর পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশীদারত্ব দেশ–বিদেশের মানুষের সামনে দেখাতে চান।

উত্তর কোরিয়ার মতো একটি দেশের শাসক হতে হলে সামরিক বাহিনীর সমর্থন ও আনুগত্য প্রয়োজন হবে। তাই এখন থেকেই জু–আয়েকে সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, মধ্যমণি করা হচ্ছে।
—চেয়ং সেয়ং–চাং, বিশ্লেষক, সেজং ইনস্টিটিউট, দক্ষিণ কোরিয়া।

দক্ষিণ কোরিয়ার সেজং ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক চেয়ং সেয়ং–চাং বলেন, এমনটা কিম জং–উনের বাবাও করেছিলেন। শাসক থাকা অবস্থায় তিনি তাঁর তিন ছেলের মধ্যে আগেভাগেই উত্তরসূরি হিসেবে কিম জং–উনের নাম ঘোষণা করে রেখেছিলেন। এ নিয়ে তখন সংবাদমাধ্যমে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। এমনকি মাত্র আট বছর বয়স থেকেই কিম জং–উন বাবার হাত ধরে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিতে শুরু করেছিলেন।

গত বছরের নভেম্বরে একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়েছিলেন কিম জং–উন। সঙ্গে ছিল ছোট্ট জু–আয়ে। পরে ওই ছবি উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেখানো হয়েছিল। জু–আয়ের বাবার উত্তরসূরি হবে—তখন থেকেই এমন গুঞ্জন ডালপালা মেলেছিল। গত বছরের শেষভাগে বাবার সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার একটি ক্ষেপণাস্ত্র কারখানা পরিদর্শন করে জু–আয়ে।

দক্ষিণ কোরিয়ার আইনপ্রণেতা ও দেশটির জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সেক্রেটারি ইও সাং–বাম বলেন, উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্রের একটি প্রতিবেদনে কিম জং–উনের স্ত্রীর আগে জু–আয়ের নাম লেখা হয়েছে। জু–আয়ের নামের আগে ‘প্রিয়’ ও ‘শ্রদ্ধাভাজন’ বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে। এসব জু–আয়ের বাবা কিম জং–উনের উত্তরসূরি হওয়াকে ইঙ্গিত করে।

উত্তর কোরিয়ার মতো একটি দেশের শাসক হতে হলে সামরিক বাহিনীর সমর্থন ও আনুগত্য প্রয়োজন হবে। তাই এখন থেকেই জু–আয়েকে সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, মধ্যমণি করা হচ্ছে—এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষক চেয়ং সেয়ং–চাং।

তবে অনেকের মতে, বিশ্ববাসীর মনোযোগ কাড়তে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন আয়োজনে অংশ নিচ্ছেন কিম জং–উন। তাঁদেরই একজন দক্ষিণ কোরিয়ার অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল চুন ইন–বাম। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে চাপে পড়েছে উত্তর কোরিয়া। আমি মনে করি, পিয়ংইয়ং হয় হোঁচট খেয়েছে, নয়তো বুঝতে পেরেছে যে এটি আন্তর্জাতিক মনোযোগ পাওয়ার একটি উপায়।

উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ংইয়ংয়ে রাষ্ট্রীয় একটি আয়োজনে কিম জং–উন ও তাঁর স্ত্রী রি সল–জু।

চুন ইন–বাম আরও বলেন, ‘সাত দশক ধরে উত্তরসূরির বিষয়টি নিয়ে একটি রহস্যময় পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে কিম পরিবার। তাই এখন তারা সেই পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসবে—এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাই আমি বাজি ধরে বলতে পারি, মেয়েটি (জু–আয়ে) বাবার উত্তরসূরি হবে না।’

উত্তর কোরিয়ার সামাজিক অবস্থা ও অতীত ইতিহাস বিবেচনায় নিলে একজন নারীর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসা কঠিন বলে মনে করছেন উত্তর কোরিয়া–বিষয়ক পর্যবেক্ষণকারী প্ল্যাটফর্ম এনকে নিউজের বিশ্লেষক জেমস ফ্রেটওয়েল। বিবিসিকে তিনি বলেন, উত্তর কোরিয়া ও কিম পরিবার—দুটিই পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের। এই পরিস্থিতিতে কিম জং–উনের মেয়ের ক্ষমতায় বসাটা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। কেননা, ২০২১ সালে কিম জং–উন তাঁর বোন কিম ইয়ো–জংকে সরকারের অন্যতম শীর্ষ পদ স্টেট অ্যাফেয়ার্স কমিশনের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন।

সিএনএন, বিবিসি ও এনডিটিভি অবলম্বনে লিখেছেন অনিন্দ্য সাইমুম ইমন।