যুক্তরাজ্যের কারাগার থেকে গত সোমবার মুক্তির পর সেদিনই চার্টার্ড উড়োজাহাজে লন্ডন ছেড়েছেন উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। তাঁর চূড়ান্ত গন্তব্য নিজ দেশ অস্ট্রেলিয়া। মুক্ত–স্বাধীন জীবন কাটানো। অবশ্য নিজ দেশে ফেরার আগে আজ বুধবার তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ সাইপানের একটি আদালত তাঁকে মুক্ত ঘোষণা করেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর মুক্তি সম্ভব হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তির জেরে। চুক্তিটি কূটনীতি, রাজনীতি ও আইনের অনন্য একটি মিশেল।
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মুক্তির বিষয়ে পর্দার অন্তরালের কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিতে জনমত আর রাজনৈতিক মনোভাব—দুটিই অ্যান্থনি আলবানিজের অনুকূলে ছিল।সাইমন জ্যাকম্যান, ইউনিভার্সিটি অব সিডনির ইউএস স্টাডিজের সাম্মানিক অধ্যাপক।
প্রায় এক যুগের বন্দিজীবন অ্যাসাঞ্জের। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যে অবস্থিত ইকুয়েডরের দূতাবাসে সাত বছর স্বেচ্ছায় বন্দিত্ব বরণ করেন তিনি। এরপর বছর পাঁচেক থাকতে হয় দেশটির কারাগারে। সেই জীবন থেকে মুক্ত হতে চুক্তিতে পৌঁছাতে কয়েক মাস লেগে গেছে। যদিও শেষ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকভাবে হবে কি না, সেটা নিয়ে ছিল অনিশ্চয়তা।
যুক্তরাজ্যের ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিস (সিপিএস) এক বিবৃতিতে বলছে, চুক্তিসংক্রান্ত একটি আবেদন গত মার্চে প্রথমবারের মতো তাদের নজরে আসে। এরপর থেকে অ্যাসাঞ্জের মুক্তির কৌশল এবং অ্যাসাঞ্জ ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের চাওয়া এক বিন্দুতে এনে মার্কিন ফেডারেল বিচারকের সামনে উপস্থাপনের উপায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে পরামর্শ দিয়ে আসছে সিপিএস।
তবে এই সমঝোতা চুক্তির বীজ হয়তো বপন করা হয়েছিল বেশ আগেই, ২০২২ সালের মে মাসে অস্ট্রেলিয়ায় নতুন সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে। প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজের সরকার চেয়েছিল, বিদেশের কারাগারে বন্দী অস্ট্রেলীয় ‘একজনকে’ মুক্ত করে দেশে ফেরাতে।
যুক্তরাজ্যের হাইকোর্টের এমন নির্দেশনা অ্যাসাঞ্জ ও মার্কিন কর্তৃপক্ষ—উভয় পক্ষকে আলোচনার টেবিলে বসতে ও সমঝোতা চুক্তি চূড়ান্ত করতে চাপ প্রয়োগ করে।নিক ভামোস, সিপিএসের প্রত্যর্পণবিষয়ক সাবেক প্রধান।
অ্যান্থনি আলবানিজ বলেছিলেন, জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ যা করেছেন, এর সবকিছু তিনি সমর্থন করেন না। কিন্তু অ্যাসাঞ্জকে নিয়ে যা যা ঘটেছে, সেটা যথেষ্ট হয়েছে। এখন সময় এসেছে তাঁকে (অ্যাসাঞ্জ) মুক্ত করে দেওয়ার। মুক্ত অ্যাসাঞ্জকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন আলবানিজ। আর এর বেশির ভাগ কর্মকাণ্ড ঘটেছে পর্দার অন্তরালে।
অস্ট্রেলিয়ার আইনপ্রণেতাদের একটি দল গত সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটন সফরে যান। অ্যাসাঞ্জের মুক্তির বিষয়ে তাঁরা মার্কিন কংগ্রেসে আলবানিজের হয়ে সরাসরি তদবির করেন। পরের মাসেই রাষ্ট্রীয় সফরে যুক্তরাষ্ট্রে যান আলবানিজ। হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। সেখানে বাইডেনের কাছে অ্যাসাঞ্জের মুক্তির প্রসঙ্গ তোলেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী।
অ্যাসাঞ্জের মুক্তির প্রসঙ্গটি গত ফেব্রুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টে তোলেন আলবানিজ। ভোটাভুটিতে আইনপ্রণেতারা অ্যাসাঞ্জকে অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে আসার অনুমতি দিতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের প্রতি আহ্বান জানানোর প্রক্রিয়াকে জোরালোভাবে সমর্থন করেন।
অস্ট্রেলিয়ার আইনপ্রণেতাদের একটি দল গত সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটন সফরে যায়। অ্যাসাঞ্জের মুক্তির বিষয়ে তারা মার্কিন কংগ্রেসে আলবানিজের হয়ে সরাসরি তদবির করে। পরের মাসেই রাষ্ট্রীয় সফরে যুক্তরাষ্ট্রে যান আলবানিজ। হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। সেখানে বাইডেনের কাছে অ্যাসাঞ্জের মুক্তির প্রসঙ্গ তোলেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী।
অ্যাসাঞ্জের মুক্তির বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী কূটনীতিক ক্যারোলিন কেনেডির সঙ্গে দেশটির সরকার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে তদবির চালিয়েছে। আরেকজন ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি স্টিফেন স্মিথ। ২০২৩ সালের শুরুর দিকে লন্ডনে অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার পদে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, অ্যাসাঞ্জকে মুক্ত করে দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়াটিকে অনেকটাই যেন ব্যক্তিগত কাজ হিসেবে নিয়েছিলেন স্টিফেন স্মিথ। তিনি বেশ বড় কাজ করেছেন। স্টিফেন স্মিথ অস্ট্রেলিয়ার সাবেক আইনপ্রণেতা। দেশটির বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা আছে তাঁর।
২০২৩ সালের এপ্রিলে যুক্তরাজ্যের বেলমার্শ কারাগারে গিয়ে অ্যাসাঞ্জের সঙ্গে দেখা করেছিলেন স্টিফেন স্মিথ। এই কূটনীতিক অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী কেভিন রাডের সরকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। কেভিন রাড নিজেও এখন যুক্তরাষ্ট্রে নিজ দেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অ্যাসাঞ্জের মুক্তির কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় কেভিন রাড সম্পৃক্ত ছিলেন।
ইউনিভার্সিটি অব সিডনির ইউএস স্টাডিজের অনারারি অধ্যাপক সাইমন জ্যাকম্যান বিবিসিকে বলেন, বিভিন্ন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন জুগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়া সরকারের ‘স্বাভাবিক প্রবণতা’ ছিল। তবে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মুক্তির বিষয়ে পর্দার অন্তরালের কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিতে জনমত আর রাজনৈতিক মনোভাব—দুটিই অ্যান্থনি আলবানিজের অনুকূলে ছিল।
ব্যারিস্টার গ্রেগ বার্নস অস্ট্রেলিয়ায় অ্যাসাঞ্জের মুক্তির প্রচারণায় আইনি উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, এখানে রাজনীতি একটি পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সামনে অ্যাসাঞ্জের মুক্তির বিষয়ে প্রথম কথা তুলেছিল আলবানিজ সরকার। এ কাজে আলবানিজ বিরোধীদের পূর্ণ সমর্থন পেয়েছেন।
গত বছরের ২০ মে, যুক্তরাজ্যের হাইকোর্ট অ্যাসাঞ্জের মুক্তির বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। হাইকোর্ট বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যার্পণ প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে নতুন করে আপিল করতে পারবেন অ্যাসাঞ্জ। এই আদেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হলো অ্যাসাঞ্জ অস্ট্রেলিয়ার একজন নাগরিক। তাঁর মুক্তির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর বাক্স্বাধীনতার অধিকারের ধারা ব্যবহার করা যেতে পারে।
সিপিএসের প্রত্যর্পণবিষয়ক সাবেক প্রধান নিক ভামোস বলেন, ‘যুক্তরাজ্যের হাইকোর্টের এমন নির্দেশনা অ্যাসাঞ্জ ও মার্কিন কর্তৃপক্ষ—উভয় পক্ষকে আলোচনার টেবিলে বসতে ও সমঝোতা চুক্তি চূড়ান্ত করতে চাপে ফেলে দেয়। ঝুঁকির কথা মাথায় রেখেই দুই পক্ষ আলোচনার টেবিলে বসে।’
হাইকোর্টের পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা আছে আগামী ৯ ও ১০ জুলাই। উভয় পক্ষ বুঝতে পারে, পরবর্তী শুনানির আগেই সমঝোতা চুক্তির উপযুক্ত সময়।
অ্যাসাঞ্জের মুক্তির পেছনে বরাবরের মতো রাজনীতি বড় ভূমিকা রেখেছে। কিছুদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করা হয়। গত আগস্টে রাষ্ট্রদূত কেনেডি প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে প্রস্তাব দেন, একটি সমঝোতা চুক্তি অ্যাসাঞ্জকে ঘিরে অচলাবস্থার অবসান ঘটাতে পারে। শেষ পর্যন্ত উদ্যোগের সূচনা করেন অ্যাসাঞ্জের আইনজীবীরা।
গত এপ্রিলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানান, অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে চলমান বিচারপ্রক্রিয়া প্রত্যাহার করে নিতে অস্ট্রেলিয়া সরকার অনুরোধ করেছে। আর তাঁর প্রশাসন সেটা বিবেচনা করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ঐতিহাসিক বন্ধুত্বে দীর্ঘদিন ধরে ‘গলার কাঁটা’ হয়ে ছিলেন অ্যাসাঞ্জ। তাই দেশ দুটি চুক্তির বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখায়। আর বাইডেন প্রশাসন চাইছিল, আগামী নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে অ্যাসাঞ্জের বিষয়টি সমাধান করতে।
গত এপ্রিলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানান, অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে চলমান বিচারপ্রক্রিয়া প্রত্যাহার করে নিতে অস্ট্রেলিয়া সরকার অনুরোধ করেছে। আর তাঁর প্রশাসন সেটা বিবেচনা করছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ঐতিহাসিক বন্ধুত্বে দীর্ঘদিন ধরে ‘গলার কাঁটা’ হয়ে ছিলেন অ্যাসাঞ্জ। তাই দেশ দুটি চুক্তির বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখায়। আর বাইডেন প্রশাসন চাইছিল, আগামী নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে অ্যাসাঞ্জের বিষয়টি সমাধান করতে।
অন্যদিকে অ্যাসাঞ্জের সমর্থকদের অনেকের মতে, আসন্ন নির্বাচনে যুক্তরাজ্যে প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের দলের পরাজয় ঘটলে লেবার পার্টির নতুন সরকার অ্যাসাঞ্জের প্রত্যর্পণের বিষয়ে তুলনামূলক কম আগ্রহ দেখাতে পারে। কাজেই সব পক্ষের সামনেই সময় বেশ কম। সমঝোতা চুক্তির জন্য এটাই আদর্শ সময়।
গত সোমবার যুক্তরাজ্যের বেলমার্শ কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন অ্যাসাঞ্জ। এ কারাগারের একটি ছোট্ট প্রকোষ্ঠে ১ হাজার ৯০১ দিন আটক ছিলেন তিনি। এরপর তিনি প্রশান্ত মহাসাগরের নর্দার্ন মারিয়ানা আইল্যান্ডসের উদ্দেশে পাড়ি দেন।
এরপরই গতকাল মঙ্গলবার হোয়াইট হাউস প্রতিক্রিয়ায় জানায়, সমঝোতা চুক্তির বিস্তারিত নিয়ে হোয়াইট হাউসের কোনো ভূমিকা ছিল না। বরং এটা মার্কিন বিচার বিভাগের এখতিয়ারভুক্ত বিষয় ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রে বিবিসির অংশীদার সিবিএস এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, সমঝোতা চুক্তির শর্তমতে অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারে থাকতে হবে না। এমনকি যুক্তরাজ্যের কারাগারে থাকার সময়কে তাঁর সাজাভোগের সময় হিসেবে বিবেচনা করা হবে। মুক্ত জীবন পাবেন অ্যাসাঞ্জ।