সুনামিতে হারানো স্ত্রীর খোঁজে এখনো সাগরে ছুটে যান ইয়াসু তাকামাতসু
সুনামিতে হারানো স্ত্রীর খোঁজে এখনো সাগরে ছুটে যান ইয়াসু তাকামাতসু

হারানো স্ত্রীর খোঁজে সাগরে ৬০০ বার

এখন ৬৭ বছর বয়স তাঁর। সাগরের পানি তাঁর ত্বক মলিন করে দিয়েছে। তবে ভালোবাসায় ভাটা ফেলতে পারেনি। ১৩ বছর হলো স্ত্রী ইয়োকোকে হারিয়েছেন তিনি। ২০১১ সালে জাপানের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় ওনাগাওয়া সমুদ্রসৈকতে আছড়ে পড়া সুনামিতে নিখোঁজ হন ইয়োকো। কিন্তু এত বছরেও প্রিয়তম স্ত্রীর স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়ায় তাঁকে। তাই তো আজও তাঁকে পাওয়ার আশায় তিনি সাগরে ছুটে যান।

ভালোবাসার এ গল্প জাপানি নাগরিক ইয়াসু তাকামাতসুর।

‘তুমি কি ঠিক আছো? আমি বাসায় যেতে চাই’—স্ত্রী ইয়োকোর কাছ থেকে ইয়াসুর শোনা সর্বশেষ কথা এটি। এ কথাটুকুই তাঁর খোঁজে আজও সাগরে ছুটে যেতে ইয়াসুকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। স্ত্রীকে খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে এখনো আশাবাদী তিনি। সেই আশা থেকে ইয়াসু সাগরে ডুবুরির পোশাকে ডুব দিয়ে চলেছেন।

১১ মার্চ ২০১১। জাপানের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানে প্রলয়ংকরী সুনামি (সাগরের ঢেউ)। এতে দেশটির উত্তর–পূর্ব উপকূলের বড় অংশ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মারা যান হাজারো মানুষ। নিখোঁজ হন অনেকে। ইয়োকোও তাঁদেরই একজন।

আমি ভেবেই ছিলাম, এটি কঠিন কাজ। বাস্তবেও খুব কঠিন পেয়েছি। কিন্তু স্ত্রীকে পেতে আমার সামনে একমাত্র এ কাজটিই রয়েছে। তাঁর খোঁজে অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়া ছাড়া বিকল্প কোনো পথ আমার নেই। সাগরে গেলে আমি তাঁকে খুব নিবিড়ভাবে অনুভব করি।
ইয়াসু তাকামাতসু, ইয়োকোর স্বামী

ইয়োকোকে উদ্ধারে গভীর সাগরে নামার জন্য ৫৬ বছর বয়সে ডাইভিং শেখার সিদ্ধান্ত নেন ইয়াসু। এরপর ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৬০০ বার সাগরে নেমে ইয়োকোকে খুঁজেছেন তিনি। দুর্ভাগ্যবশত তাঁর দেহাবশেষের সন্ধান এখনো পাননি। যা হোক, ইয়োকোর জন্য অক্ষয় ভালোবাসা তাকামাতসুকে এতটুকু হতোদ্যম করতে পারেনি। তাঁর বিশ্বাস, একদিন না একদিন তাঁকে খুঁজে পাবেন তিনি।

নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইয়োকো–ইয়াসু জুটির প্রথম সাক্ষাৎ ১৯৮৮ সালে। তখন ইয়োকো ২৫ বছরের তরুণী। কাজ করতেন ওনাগাওয়ার সেভেনটি সেভেন ব্যাংকে। অন্যদিক তাকামাতসু ছিলেন জাপানের গ্রাউন্ড সেলফ–ডিফেন্স ফোর্সের একজন সেনা। ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা ইয়োকোর সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেন।

জাপানে ২০১১ সালে ভয়াবহ সুনামি হয়।

প্রথম সাক্ষাতেই পরস্পরকে ভালোবেসে ফেলেন ইয়োকো-ইয়াসু। একপর্যায়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ইয়াসু তাঁর স্ত্রীর ব্যাপারে বলেন, ‘ও ছিল ভদ্র। আমি তার হাসি ও বিনয়ী স্বভাব পছন্দ করতাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইয়োকো ক্ল্যাসিক্যাল সংগীত শুনতে ভালোবাসত। ছবি আঁকায় ছিল প্রবল ঝোঁক। ক্যানভাসে ব্যবহার করত জলরং। তবে এসব ছবি আমাকে ছাড়া আর কাউকে দেখাত না।’

সাগরে হারিয়ে যাওয়া স্ত্রীর দেহাবশেষের সন্ধান তাকামাতসুর জন্য কোনো সহজ কাজ নয়; তা–ও যখন ১৩টা বছর পেরিয়ে গেছে। একরকম দুঃসাধ্য এ কাজ চালিয়ে যেতে অনেকেই তাঁকে নিরুৎসাহিত করেছেন। কেননা বিস্তীর্ণ সাগরের নিচ থেকে ইয়োকোর দেহাবশেষ বের করে আনার কাজ যেন বিরাট খড়ের গাদা থেকে সুচ বের করে আনা। কিন্তু তাকামাতসু নাছোড়বান্দা। তিনি বলেন, ‘৫৬ বছর বয়সে আমি ডাইভিং শিখেছি এ কারণে যে আমি সাগর থেকে আমার স্ত্রীকে খুঁজে বের করে আনতে চাই।’

কাজটা যে সহজ নয় তা স্বীকার করেন তাকামাতসুও। বলেন, ‘আমি ভেবেই ছিলাম, এটি কঠিন কাজ। বাস্তবেও খুব কঠিন পেয়েছি। কিন্তু স্ত্রীকে পেতে আমার সামনে একমাত্র এ কাজটিই রয়েছে। তাঁর খোঁজে অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়া ছাড়া বিকল্প কোনো পথ আমার নেই। সাগরে গেলে আমি তাঁকে খুব নিবিড়ভাবে অনুভব করি।’

‘তুমি কি ঠিক আছো? আমি বাসায় যেতে চাই’—স্ত্রী ইয়োকোর কাছ থেকে ইয়াসুর শোনা সর্বশেষ কথা এটি। এ কথাটুকুই তাঁর খোঁজে ইয়াসুকে আজও সাগরে ছুটে যেতে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। স্ত্রীকে খুঁজে উদ্ধার করে বাসায় নিয়ে যেতে চান তিনি।

সুনামির কয়েক মাস পর তাকামাতসু স্ত্রীর মুঠোফোন তাঁর কর্মস্থলের গাড়ি পার্কিংয়ের স্থানে পান। মুঠোফোনে একটি খুদে বার্তা লেখা ছিল; যদিও সেটি সময়মতো পাননি তিনি। বার্তায় লেখা ছিল, ‘অনেক বড় সুনামি।’

সাগরে ভেসে যাওয়া মরদেহের বিষয়ে কথা বলেছেন সেন্দাইয়ে তোহোকু মেডিকেল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ইউনিভার্সিটির ফরেনসিক প্যাথলজিস্ট তেতসুইয়া তাকাগি।

তেতসুইয়া বলেন, ‘কোনো মরদেহ সাগরে ভেসে হারিয়ে গেলে সে ব্যাপারে কিছু বলা কঠিন। তা সাগরের ঢেউয়ে ভেসে কোন দিকে যাবে, কেউ বলতে পারে না। অবশ্য একটি নির্দিষ্ট গভীরতায় মরদেহ ডুবে থাকলে সেখানে তা রয়ে যেতে পারে। আবার সেখানেও সেটি অক্ষত না থাকতে পারে।’

এদিকে ইয়াসু তাকামাতসুর জীবন নিয়ে নির্মিত হয়েছে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে এটি প্রদর্শনও করা হয়েছে। ‘নোহয়ার টু গো বাট এভরিহয়ার’ (কোথাও যাওয়ার নেই, কিন্তু সবখানেই) শিরোনামের এ তথ্যচিত্র পরিচালনা করেছেন এরিক শিরাই ও মাসাকো সুমুরা।