ইরানে পুলিশি হেফাজতে এক তরুণীর মৃত্যুর প্রতিবাদে দেশজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ চলছে। বিক্ষোভ দমনে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। সপ্তাহখানেকের বিক্ষোভ–সহিংসতায় এরই মধ্যে ৪১ জন নিহত হয়েছেন। দেশটির কিছু এলাকায় ইন্টারনেট–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। হোয়াটসঅ্যাপ ও ইনস্টাগ্রামের মতো সেবাগুলোও বন্ধ করে দিয়েছে সরকার।
কঠোর ইসলামি শাসনে থাকা মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে এই বিক্ষোভের সূচনা ১৬ সেপ্টেম্বর, কুর্দি তরুণী মাসা আমিনির (২২) মৃত্যুর পর। ‘যথাযথ নিয়ম মেনে’ হিজাব না পরার অভিযোগে তিন দিন আগে তাঁকে আটক করেছিল তেহরানের ‘নৈতিকতা পুলিশ’।
ইরানের কুর্দিস্তান থেকে পরিবারের সঙ্গে তেহরানে ঘুরতে গিয়েছিলেন মাসা আমিনি। আটকের পর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে তেহরানের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। এর প্রতিবাদে প্রথমে ইরানের কুর্দি–অধ্যুষিত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিক্ষোভ শুরু হলেও তা পরে দেশটির অন্যান্য শহরেও ছড়িয়ে পড়ে।
৯ দিন ধরে চলা বিক্ষোভ নিয়ে ইরানি পাঁচ নাগরিকের অভিজ্ঞতা, তাঁরা কেন এই বিক্ষোভে যুক্ত হয়েছেন, তা উঠে এসেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের একটি প্রতিবেদনে।
ইরানের দক্ষিণাঞ্চলের সিরাজ অঞ্চলের ৩৭ বছর বয়সী ফারাহ বলেন, ‘আমি বাইরে গিয়ে প্রতিবাদে যোগ দিতে সাহস পাচ্ছি না। কারণ, তারা লোকজনকে হত্যা করছে। কিন্তু আমার বন্ধুরা বিক্ষোভে যোগ দিচ্ছে এবং তারা আমাকে এ বিষয়ে সব বলেছে। এটাই স্বাধীনতা ও শান্তি অর্জনের সর্বোত্তম উপায় কি না, তা আমি জানি না। তবে আমি মনে করি, এর মধ্য দিয়ে তারা নারীদের জন্য নিরাপদ ব্যবস্থা আনতে পারে। এর আগে সব বিক্ষোভ মূলত পুরুষেরা করেছেন। কিন্তু এবারের ঘটনাটি খুবই আলাদা। নারীরা এটি শুরু করেছেন এবং পুরুষেরা তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। পুলিশ যখন নারীকে হিজাব পরতে বাধ্য করছে, তখন পুরুষ তাদের সঙ্গে লড়াই করছেন। অধিকাংশ বিক্ষোভকারী তরুণ, কিন্তু বয়স্করাও তাঁদের সমর্থন করছেন।’
ফারাহ বলেন, ‘ইরানে নারী ও মেয়েদের কোনো অধিকার নেই। তা নিয়েই এই প্রতিবাদ। এখানে আদালতে দুজন নারীর সাক্ষ্যকে একজন পুরুষের সাক্ষ্যের সমান ধরা হয়। যদি কোনো নারী স্বামীর অনুমতি ছাড়া বাবা–মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান, তাহলে স্বামী তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেন। আমার সাবেক স্বামীর অনুমতি ছাড়া ছেলেকে নিয়ে আমি অন্য শহরে নিয়ে যেতে পারি না। এর আগে স্কুলে পড়ার সময় আমার চুল পুরোপুরি না ঢাকার জন্য বা জোরে হাসার জন্য মার খেয়েছি। এই বিক্ষোভ বিগত বছরগুলোর বঞ্চনার প্রতিবাদ। আমি মনে করি, তরুণ প্রজন্ম এই নিপীড়ন আর সহ্য করবে না।’
তেহরানের সোবহান নামের ১৯ বছর বয়সী এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভে অংশ নিয়েছি। আজ (শনিবার) প্রায় ১০০ বাসিজিস (স্বেচ্ছাসেবী আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য) বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আটক করেছে। আমার এক বন্ধুকে গ্রেপ্তার করে আদালতে নেওয়া হয়েছে। সে বলেছে, প্রতিবাদ চালিয়ে যাবে, এমনকি এর জন্য প্রাণ দিতে হলেও। এভাবেই আমরা বেঁচে আছি। আমরা জানি না, আবার বন্ধুদের জীবিত দেখতে পাব কি না। নিজে হারিয়ে যেতে পারি, সেই ভয়ের মধ্যে আছি।’
সোবহান বলেন, ‘এখন যেহেতু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তাই মানুষ জড়ো হয়ে দেখছে কী ঘটে। নারী–পুরুষ সবাই রাস্তায় নেমে এসেছেন। তবে আমার মনে হয়েছে, নারীরাই বেশি সাহসী। তাঁরা হিজাব খুলে বিক্ষোভ করছেন। পরিবারকে না জানিয়েই আমি বিক্ষোভে যোগ দিয়েছি। এদিকে আমার মা আমাকে মুঠোফোনে বার্তা পাঠিয়ে বিক্ষোভে অংশ নিতে অনুরোধ জানিয়েছেন। গত রাত থেকে অনেকে ঘরের বাইরে বেরোতে ভয় পাচ্ছেন। রাস্তা এখন বিপজ্জনক এবং কখন কী ঘটে বলা যায় না। তরুণদের পাশাপাশি প্রবীণেরাও বিক্ষোভ করছেন। অনেকেই তাঁদের মায়েদের সঙ্গে বিক্ষোভে এসেছেন।’
তেহরানে বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করা ৪৪ বছর বয়সী ফারবোদ বলেন, ‘আমি খুবই হতাশ ও ক্ষুব্ধ। আমি একজন সাধারণ মানুষ, শুধু পরিবারকে নিরাপদ ও সুখী রাখতে চাই। কিন্তু সরকার তা অসম্ভব করে তুলেছে। তারা সবকিছু ধ্বংস করেছে। অর্থনীতি, রপ্তানি, আমদানি, সংস্কৃতি সবকিছু ধ্বংস করেছে। আমার একটি কিশোর বয়সী ছেলে রয়েছে। সে মুক্তভাবে বাঁচতে চায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতে চায়। তার পছন্দমতো পোশাক পরতে চায়। কিন্তু সে তা পারে না।’
ফারবোদ বলেন, ‘মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট বন্ধ। কয়েক দিন ধরে শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রায় পুলিশের নিষ্ঠুরতা দেখেছি। তারা কাঁদানে গ্যাসের শেল ও বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার যন্ত্র ব্যবহার করছে। তারা মানুষকে হত্যা করছে। এর মধ্যে তরুণ, প্রবীণ, নারী ও পুরুষ রয়েছেন। মানুষ তথ্যের স্বাধীনতা চায়। তাদের ভাগ্য বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা চায়।’
ইরানের মধ্যাঞ্চলের ইয়াজদ এলাকার ২৯ বছর বয়সী আমিন বলেন, ‘ইয়াজদ একটি ছোট ধর্মীয় শহর। এখানে গত কয়েক দিনে বিক্ষোভকারীদের তুলনায় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য বেশি ছিল। লোকজনকে ছত্রভঙ্গ করতে সরকার বলপ্রয়োগ করছে। বিক্ষোভকারীদের মারধর করা হচ্ছে, এমনকি গুলিও করা হচ্ছে। ভয়ে আমি এখনো বিক্ষোভে যোগ দিইনি। তবে সামনের দিনগুলোতে আমি বিক্ষোভে যাব। রাস্তায় অনেক মানুষ লড়াই করছে। বিশেষ করে সাহসী নারী ও তরুণীরা লড়াই করছেন। দশকের পর দশক কট্টর ইসলামি শাসন তাঁদের দমিয়ে রেখেছে। তাঁরা এখন বেরিয়ে এসেছেন এবং নিজেদের অধিকারের জন্য লড়ছেন। আমি জানি, বহু নারী তাঁদের হিজাব ছুড়ে ফেলতে চান। আমার বোন ও বান্ধবীদের অনেকেই এমনটা ভাবে। এটা নারীদের বিদ্রোহ। আমার মা–বাবাও এই বিক্ষোভের পক্ষে। কিন্তু অন্য অনেকের মতো তাঁরাও এ বিষয়ে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন।’
ফারবোদ আরও বলেন, ‘ইরানের নেতারা তাঁদের কর্তৃত্ব ঠিক রাখতে যেকোনো শক্তি ব্যবহার করছেন। তাঁরা ইসলামকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন। আমি বিজ্ঞাপন নিয়ে কাজ করি। আমার কাজ, আমার জনগণ ও সমাজকে জানা। আমি মনে করি, ইরানের জনগণ (ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা) খামেনি, মোল্লাতন্ত্র ও জোর করে চাপিয়ে দেওয়া ধর্মীয় অনুশাসন চায় না। ইরানের তরুণেরা কয়েক বছর ধরেই সরকারকে শান্তিপূর্ণভাবে এ বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাঁদের এ জন্য কারাগারে দেওয়া হচ্ছে, নির্যাতন করা হচ্ছে, এমনকি হত্যা করা হচ্ছে। পুরোনো প্রজন্মের লোকজনও পরিবর্তন চান। কিন্তু তাঁরা সন্তানদের নিয়ে চিন্তিত। এ ছাড়া তাঁরা অতীতে ব্যর্থতাও দেখেছেন। আমার দেশের মানুষ এখন ক্লান্ত। তারা ইসলামিক রিপাবিলক নিয়ে অসুস্থ। তারা তেহরান, খাসান বা কউম যেখানকার বাসিন্দাই হোক না কেন।’
বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কুর্দিস্তান প্রদেশের সানন্দাজের বাসিন্দা ৩৮ বছর বয়সী শমী বলেন, ‘আমি কুর্দিস্তানের বাসিন্দা। মাশা আমিনিও ওই প্রদেশের বাসিন্দা ছিলেন। এবারের বিক্ষোভ আগের চেয়ে আলাদা। নতুন প্রজন্ম ভয়–ডরহীন। তারা পাল্টা লড়াই চালাচ্ছে আর তা খালি হাতেই। তারা জানে, এতে তাদের জীবন চলে যেতে পারে। তরুণদের সাহসে বলীয়ান হচ্ছে পুরোনো প্রজন্মও। এতে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে একতা তৈরি হয়েছে।’
শমী আরও বলেন, ‘এর আগে ২০১৯ সালের বিক্ষোভের সময় আরব, তুর্কি, কুর্দিবাসীর মধ্যে ঐক্য ছিল না। কিন্তু এখন তাবরিজ থেকে সানন্দাজ, তেহরান থেকে মাশাদ—সব জায়গায় একই স্লোগান। আমার প্রদেশের লোকজন সুন্নি। আমার এলাকার লোকজন এ বিক্ষোভে খুশি। গত সোমবার বিক্ষোভের সময় মাশা আমিনির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সবাই দোকানপাট বন্ধ রাখেন।’
শমী আরও বলেন, ইরানে তরুণ নাস্তিকদের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। ইরানে আজকের রক্ষণশীলরাও ১০ বছর আগের মতো নেই। ইরাকের বিরুদ্ধে ৮ বছরের যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ইরানিরা যেকোনো মূল্যে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই আবেগ এখন পাল্টে গেছে। পবিত্র মাশাদের মতো শহরেও পতিতাবৃত্তি বেড়ে গেছে। এর পেছনে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাপকভাবে দায়ী।
শমী বলেন, বিক্ষোভে এখন তারকারাও যোগ দিয়েছেন। এর আগে তাঁরা সরকারকে সমর্থন জানালেও এখন বুঝতে পারছেন, বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে। তাই তাঁরা সুর পাল্টেছেন। এই বিক্ষোভের একটা বড় অর্থ আছে। এটি এখন রক্ষণশীল এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়ছে। সরকারের ওপর মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে।