কম্বোডিয়ার নম পেনে বৃষ্টিতে ভিজে মোটরসাইকেল নিয়ে সড়কে বের হয়েছেন অনেক মানুষ। মিছিল করছেন, উৎসবে মেতেছেন তাঁরা। তাঁদের পরনে আকাশি–নীল শার্ট। মাথায় একই রঙের টুপি। উল্লাস করছেন, আনন্দে মেতেছেন তাঁরা।
তাঁদের এই উল্লাস কম্বোডিয়ার গতকাল রোববারের সাধারণ নির্বাচন ঘিরে। আকাশি-নীল পরিহিত সবাই কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টির (সিপিপি) সমর্থক। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়ের দাবি দলটির। তাই সমর্থকেরা দলের পতাকা হাতে সড়কে নেমেছেন, উল্লাস করছেন। বড় পরিসরে বিজয় উৎসবের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন।
কম্বোডিয়ার ক্ষমতাসীন দল সিপিপি। দলটির নেতা হুন সেন ৩৮ বছর ধরে দেশটির নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি ‘নির্বাচিত’ শাসকও তিনি। গতকাল সমর্থকদের উদ্দেশে হুন সেনের ৪৫ বছর বয়সী ছেলে এবং কম্বোডিয়ার সেনাপ্রধান হুন মানেট বলেন, শুধু সিপিপির দেশ পরিচালনার সক্ষমতা রয়েছে।
দীর্ঘ ৩৮ বছরের শাসনামলে হুন সেন নিজেই এই পরিস্থিতি তৈরি করেছেন। হুন সেনের বয়স এখন ৭০ বছর ছুঁয়েছে। শাসনামলের শুরুর দিকে তিনি ভিয়েতনামপন্থী কমিউনিস্ট শাসক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এরপর কম্বোডিয়ায় জাতিসংঘ–সমর্থিত বহুদলীয় ব্যবস্থা চালু হয়। তখনো প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হুন সেন। বর্তমানে হুন সেন দেশটিতে একনায়কতান্ত্রিক শাসন চালু রেখেছেন।
‘আমরা এবারের নির্বাচনকে জালিয়াতির নির্বাচন বলতে পারব না। বরং আমরা এটাকে এমন একটি নির্বাচন বলতে পারি, যা হুন সেনের বিজয় নিশ্চিত করে। এর মধ্য দিয়ে হুন সেনের দল তাঁর ছেলেকে দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী বাছাই করবে এবং হুন পরিবারের সাম্রাজ্য অব্যাহত রাখবে’—মু শোচুয়া, কম্বোডিয়ার সরকারবিরোধী রাজনীতিক
সিপিপি ও হুন সেনের শাসন চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে, এমন একটি রাজনৈতিক দল রয়েছে কম্বোডিয়ায়। দলটির নাম ক্যান্ডেললাইট পার্টি। তবে এবারের নির্বাচনে দলটি অংশ নিতে পারেনি। নিবন্ধনসংক্রান্ত ত্রুটির অজুহাত দেখিয়ে চলতি বছরের মে মাসে এই দলকে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।
কম্বোডিয়ার ক্ষমতাসীন দল সিপিপি। দলটির নেতা হুন সেন ৩৮ বছর ধরে দেশটির নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি ‘নির্বাচিত’ শাসকও তিনি।
এই সিদ্ধান্ত কম্বোডিয়ায় ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। সমালোচকদের মতে, কম্বোডিয়ায় গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের পরিসর সংকুচিত করার ক্ষেত্রে হুন সেনের আরেকটি পদক্ষেপের উদাহরণ এটি। কেননা, এবারের নির্বাচনে অংশ নেওয়া বাকি ১৭টি দলের মধ্যে কোনোটিরই সিপিপির বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলার সক্ষমতা নেই। এই কারণে এবারের নির্বাচনকে কম্বোডিয়ায় কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক বলছেন সমালোচকেরা।
ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ‘নিরঙ্কুশ বিজয়’ দাবি করেছে সিপিপি। বলা হয়েছে, ৮০ শতাংশের বেশি ভোট তাদের ঝুলিতে পড়বে।
এদিকে আশা করা হচ্ছে, নির্বাচনে জয়ের পর বাবা হুন সেনের স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন ছেলে হুন মানেট। তাই এটাকে সাধারণ নির্বাচন না বলে বরং ছেলের রাজ্যাভিষেক বলা ভালো, এমনটাই মত বিশ্লেষকদের।
অন্যদিকে ২০১৭ সালে নিষিদ্ধ আরেকটি বিরোধী রাজনৈতিক দল সিএনআরপির সদস্য এবং নির্বাসিত সাবেক মন্ত্রী মু শোচুয়া বলেন, ‘আমরা এবারের নির্বাচনকে জালিয়াতির নির্বাচন বলতে পারব না। বরং আমরা এটাকে এমন একটি নির্বাচন বলতে পারি, যা হুন সেনের বিজয় নিশ্চিত করে। এর মধ্য দিয়ে হুন সেনের দল তাঁর ছেলেকে দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী বাছাই করবে এবং হুন পরিবারের সাম্রাজ্য অব্যাহত রাখবে।’
সরকারপ্রধান হওয়ার জন্য হুন মানেট দীর্ঘদিন ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ধারণা করা হচ্ছে, নির্বাচনের পর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তিনি বাবার স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন। তাই এবারের নির্বাচনকে ‘রাজ্যাভিষেক’ বলছেন বিশ্লেষকদের অনেকেই।
এত কিছুর পরও সিপিপি নেতাদের নির্বাচনের আগে কিছুটা দ্বিধান্বিত দেখা গিয়েছিল। এ জন্য তাঁরা ব্যালট নষ্ট করা বা নির্বাচন বয়কটে উৎসাহ দেওয়াকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে দ্রুত আইন পাস করে। এর আওতায় বিরোধী দল ক্যান্ডেললাইট পার্টির কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তারও করা হয়।
ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ‘নিরঙ্কুশ বিজয়’ দাবি করেছে সিপিপি। আশা করা হচ্ছে, নির্বাচনে জয়ের পর বাবা হুন সেনের স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন ছেলে হুন মানেট। তাই এটাকে সাধারণ নির্বাচন না বলে বরং ছেলের রাজ্যাভিষেক বলা ভালো, এমনটাই মত বিশ্লেষকদের।
এ বিষয়ে কম্বোডিয়ার থিঙ্কট্যাংক ফিউচার ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ওউ ভিরাক বলেন, তাঁরা জানতেন, তাঁরা নির্বাচনে জিততে চলেছেন। এটা তাঁদের জন্য সহজ ফলাফল ছিল। কিন্তু নির্বাচনের বৈধতা অর্জন করা বেশ কঠিন ছিল। বিরোধী দলকে দুর্বল করে রাখতে হবে। একই সঙ্গে জনগণকেও খুশি রাখতে হবে। এ দুটি বিষয় অর্জন করতে গিয়ে রাজপথের বিক্ষোভের মতো প্রতিবন্ধকতাগুলো আগেভাগে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছিল।
কম্বোডিয়ার ভোটার প্রাক সোপহেপের একটি মন্তব্য বর্তমান পরিস্থিতি বুঝতে সহায়তা করবে। তিনি বলেন, ‘হুন সেন সব সময় এমন নীতির (উইন-উইন পলিসি) কথা বলেন, যাতে জড়িত সব পক্ষের লাভ হয়। কিন্তু আমরা বুঝতে পারি, আখেরে তিনি একাই লাভবান হন। আমরা শান্তিতে থাকতে পারি না।’