মিয়ানমারকে ঐক্যবদ্ধ করা কতটা সম্ভব

মিন অং হ্লাইং
ছবি: রয়টার্স

মিয়ানমারে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনা–অভ্যুত্থানের পর জান্তাবিরোধী দলগুলো বৃহত্তর জোট গঠনে করেছে। কিন্তু জান্তাকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে নানা সংঘাত–সংঘর্ষে তাদের মধ্যে অনৈক্য ও বিভক্তিই বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকে মিয়ানমারের রাজনীতিতে ঐক্যের প্রশ্নটি বারবার সামনে এসেছে। নানা জাতিগোষ্ঠী, বর্ণ ও স্বার্থের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশটি কীভাবে পরিচালিত হবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

মিয়ানমারের জাতিগত সবচেয়ে বড় গ্রুপ বামার। দেশটির রাজনীতিতে তাদেরই একচ্ছত্র আধিপত্য। কিন্তু তারা কখনোই পুরো ভূখণ্ডের মানুষকে এক ছাতার নিচে আনতে পারেনি। সামরিক জান্তার বেশির ভাগ শীর্ষ কর্মকর্তাও এই বামার জাতিগোষ্ঠীর।

মিয়ানমার ও বিদেশের অন্তত দুই ডজন বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকের সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে। সবারই একই কথা, মিয়ানমারে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, এমন কোনো নেতা নেই, যিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে প্রতিরোধ লড়াই চালিয়ে নেবেন।

মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চলে মূলত বামার জনগোষ্ঠীর বসবাস বেশি। আর অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী ঐতিহ্যগতভাবে বসবাস করে সীমান্ত অঞ্চলে। আর প্রায় প্রতিটি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে। এসব অঞ্চল চাষাবাদের জন্য বেশ উর্বর জায়গা।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর কৌশল হলো তারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে

বিভক্ত দেশ

গত ৭৫ বছরে কোনো সরকারই পুরো দেশকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি। সর্বশেষ সামরিক জোট ও অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) সরকারও এই কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক জান্তার ক্ষমতা দখল, সু চি ও অন্য বেসামরিক নেতাদের গ্রেপ্তারের পর ক্ষমতা ভাগাভাগির চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। সংঘাত ও প্রতিরোধ আন্দোলনের জেরে এখন দেশটি প্রায়ই রক্তাক্ত হচ্ছে।

সামরিক জান্তার অভ্যুত্থানের পর কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন বলে ধারণা করা হয়। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) বলছে, অভ্যুত্থানের পর থেকে গত মার্চ পর্যন্ত দেশে প্রায় ১৭ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়েছে।

মিয়ানমারের জাতিগত সবচেয়ে বড় গ্রুপ বামার। দেশটির রাজনীতিতে তাদেরই একচ্ছত্র আধিপত্য। কিন্তু তারা কখনোই পুরো ভূখণ্ডের মানুষকে এক ছাতার নিচে আনতে পারেনি। সামরিক জান্তার বেশির ভাগ শীর্ষ কর্মকর্তাও এই বামার জাতিগোষ্ঠীর।

ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ

মিয়ানমারের স্বাধীনতার পর থেকে সেনাবাহিনী বেশির ভাগ সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকেছে। মজার বিষয় হচ্ছে, মিয়ানমারের মানুষের মধ্যে কোনো ঐক্য না থাকলেও সেনাবাহিনীর মধ্যে সব সময় একধরনের ঐক্য দেখা গেছে। আর সেই ঐক্য হচ্ছে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার ঐক্য। এভাবে তারা ক্ষমতায় থেকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিশ্চিহ্ন করতে না পারলেও বিভক্ত করে রেখেছে।

২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি বামার–অধ্যুষিত অঞ্চলেও জান্তাবিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এতে আশা জেগেছিল, এবার জান্তাকে পরাজতি করতে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলা যাবে। এ জন্য লক্ষ্য ছিল, বামার ও অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে জান্তাবিরোধী বৃহত্তর জোট গঠন।

কিন্তু এখানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, তারা কেবল একটি বিষয়ে একমত। আর সেটি হচ্ছে সামরিক জান্তাকে প্রত্যাখ্যান ও ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা। আর অন্যান্য বিষয়, বিশেষ করে সবাই নিজের স্বার্থকে বড় করে দেখছে। রয়েছে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস। এই অবিশ্বাস দূর আর ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য এখন কেবল একটি শব্দই সামনে আসছে ‘ফেডারেল কাঠামো’।

অং সান সু চি

কমিটি রিপ্রেজেন্টিং পাইডাউঙ্গসু লুত্তাও (সিআরপিএইচ) দল ২০২০ সালের নির্বাচনী ফল অনুযায়ী নিজেদের পার্লামেন্টের শক্তিশালী দল মনে করে থাকে। অভ্যুত্থানে দলটিও ক্ষমতাচ্যুত হয়। তারা অভ্যুত্থানের দুই মাস পর একটি গণতান্ত্রিক সনদ ঘোষণা করে।

অস্পষ্ট কাঠামো

সিআরপিএইচের রোডম্যাপ অনুযায়ী, প্রতিরোধ আন্দোলন পরিচালনার জন্য ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) নামে একটি ছায়া প্রশাসন গড়ে তোলা হয়। এ ছাড়া জান্তাবিরোধী পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) গঠন করা হয়। অবশ্য এই পিডিএফের সব ইউনিট এনইউজির নিয়ন্ত্রণে নেই।

ফেডারেল ব্যবস্থার বিষয়ে আরও বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে ন্যাশনাল কনসালটেটিভ কাউন্সিল (এনইউসিসি) আহ্বান করা হয়। এনইউসিসিতে সিআরপিএইচ, এনইউজিসহ প্রভাবশালী জাতিগোষ্ঠীগুলোর গ্রুপ, সুশীল সমাজ, ব্যবসায়ীসহ নানা মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অবশ্য এনইউসিসির পরিচালনা পর্ষদে কারা আছেন, সে সম্পর্কে প্রকাশ্যে কখনো কিছু জানানো হয়নি।

২০২২ সালের জানুয়ারিতে তথাকথিত ফার্স্ট পিপলস অ্যাসেম্বলির পর একটি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ৫ শ্রেণির ৩৩ সদস্য নিয়ে এনইউসিসি গঠিত হয়েছে। এতে কারা সদস্য, তাঁরা কোন শ্রেণি–পেশার—এসব বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি।

ফেডারেল ব্যবস্থা নিয়ে কোনো চুক্তি নেই

শুরু থেকেই এটি পরিষ্কার যে সব বিরোধী পক্ষ এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে একমত নয়। ২০২১ সালের অক্টোবরে কয়েকটি জাতিগোষ্ঠী এনইউসিসি ত্যাগ করে। ২০২৩ সালের মার্চে একটি জাতিগোষ্ঠীর এক প্রতিনিধি ডয়চে ভেলেকে বলেছিলেন, তিনি কোনো বিপ্লব দেখছেন না।

তিনি বলেন, ‘বিপ্লব অর্থ হচ্ছে, আপনি সত্যিই নতুন কিছু করতে চান। কিন্তু আমি যা দেখছি, তাতে মনে হচ্ছে, তারা অভ্যুত্থানের আগের অবস্থায় ফিরে যেতে চায়। এটাকে বিপ্লব নয়, কেবল প্রতিরোধ বলতে পারেন।’

এই প্রতিনিধি বলছেন, অভ্যুত্থানের আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, বামারের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আবার ফিরিয়ে আনা, যা সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীকে প্রান্তিক অবস্থায় রেখে দেবে।

নেতৃত্বের অভাব

এখন অং সান সু চির মতো এমন একজন ক্যারিশম্যাটিক নেতা দরকার, যিনি দেশকে ঐক্যবদ্ধ করতে ফেডারেল ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেবেন। কিন্তু এমন অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতা এখন নেই।

মিয়ানমার ও বিদেশের অন্তত দুই ডজন বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকের সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে। সবারই একই কথা, মিয়ানমারে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এমন কোনো নেতা নেই, যিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে প্রতিরোধ লড়াই চালিয়ে নেবেন।

গ্রহণযোগ্য নেতৃত্বের অভাব মানে, বিরোধী দল ও জাতিগোষ্ঠীগুলোকে একই ছাতার মধ্যে আনা কঠিন হবে। এমনকি জান্তাবিরোধী বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে পদ–পদবি নিয়ে ব্যাপক বিভক্তি রয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সামরিক জান্তা আগামী আগস্টে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছে। এনএলডির কিছু নেতা এতে অংশ নিতে চান বলে ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু দেশের বাইরে থাকা অনেকে এই নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁরা বলছেন, এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের অর্থ সামরিক জান্তাকে বৈধতা দেওয়া।

গত দুই বছরে সামরিক জান্তা দেশের বেশির ভাগ শহর ও যোগাযোগব্যবস্থার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। তবে এবার বিপুল জনগোষ্ঠী সমর্থিত প্রতিরোধ গ্রুপগুলো দেশের বিভিন্ন এলাকায় জান্তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। সাগাইং ও মগওয়ে রাজ্যের মতো অনেক অঞ্চলে ব্যাপক লড়াই হচ্ছে, যেখানে জান্তার নিয়ন্ত্রণ অনেকটা কমে গেছে।

কেউ কেউ বলছেন, ব্রিটিশ উপনিবেশ যেভাবে মিয়ানমারের ভূখণ্ড রেখে গেছে, সেটা স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরও ঐক্যবদ্ধ হয়নি। এখন বরং ‘একটি রাজনৈতিক একক’ হিসেবে মিয়ানমারকে চিন্তার বিষয়টি বাদ দেওয়া হবে বুদ্ধিমানের কাজ। এখন বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দিয়ে ভাবতে হবে।

পুরো দেশকে একক ভেবে শাসনের চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিলে সব পক্ষই শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। এই দেশে একক নিয়ন্ত্রণ মোটেই মঙ্গল বয়ে আনবে না।