মিয়ানমারের স্বাধীনতার জনক জেনারেল অং সান। তিনি দেশটির সেনাবাহিনীরও (তাতমাদো) প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৪৭ সালের ১৯ জুলাই তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শুরুতেই ছাত্রদের ইউনিয়নে যুক্ত হন। নেতৃত্ব দেন ইউনিয়নের। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ছাত্রজীবনেই জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে নাম লেখান। মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র ছয় মাস আগে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তিনি।
তিনি মিয়ানমারের স্বাধীনতার জনক জেনারেল অং সান। দেশটির সেনাবাহিনীরও (তাতমাদো) প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ব্রিটিশবিরোধী ও কট্টর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এই বিপ্লবীর মেয়ে অং সান সু চি, যিনি মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী হিসেবে বহুল পরিচিত। বাবার মতো তাঁর জীবনও সংগ্রামমুখর।
অং সানের জন্ম ১৯১৫ সালে, ব্রিটিশশাসিত তৎকালীন বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) মাগওয়ে জেলার নাতমাউকে। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান তিনি। ৯ ভাইবোনের মধ্যে ছিলেন সবার ছোট।
মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে অং সান ১৯৩৩ সালে রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। অচিরেই তিনি ছাত্রনেতা বনে যান। তাঁকে ক্যারিশমাটিক, রাজনীতিতে প্রবল আগ্রহী হিসেবে বর্ণনা করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির সমসাময়িক শিক্ষার্থীরা।
অং সান নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের (আরইউএসইউ) নির্বাহী কমিটিতে পদ পান। পরে আরইউএসইউ থেকে প্রকাশিত সাময়িকীর সম্পাদক হন।
শিক্ষার্থীদের সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি সমালোচনামূলক নিবন্ধের লেখকের নাম প্রকাশে অস্বীকৃতির জেরে অং সানকে ১৯৩৬ সালে বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তিন মাসব্যাপী তুমুল ছাত্র ধর্মঘটের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারে বাধ্য হয়। এ ঘটনা তাঁকে দেশব্যাপী পরিচিতি এনে দেয়।
১৯৩৭ সালে ইংরেজি সাহিত্য, আধুনিক ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন অং সান। স্নাতক শেষে আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন তিনি।
অং সান ১৯৩৮ সালে রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়ন ও সর্ব-বার্মা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৩৮ সালের শেষ দিকে পড়াশোনা ছেড়ে পুরোদস্তুর রাজনীতিতে সক্রিয় হন তিনি।
রাজনীতিতে নেমে জাতীয়তাবাদী সংগঠন ‘আওয়ার বার্মা অ্যাসোসিয়েশন’-এ যুক্ত হন অং সান। ১৯৩৯ সালে তিনি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হন। একই বছর সংগঠনটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার উৎখাতে শক্তি প্রয়োগের ঘোষণা দেয়। এই ঘোষণার জেরে দমনপীড়ন শুরু হয়। সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে অং সানকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। পরে অবশ্য অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। কারামুক্তির পর অং সান দেশব্যাপী ধর্মঘট, কর-বিরোধিতা ও গেরিলা বিদ্রোহের মাধ্যমে বার্মার স্বাধীনতা অর্জনের একটি কৌশল প্রস্তাব করেন।
১৯৩৯ সালের আগস্টে কমিউনিস্ট পার্টি অব বার্মা (সিপিবি) প্রতিষ্ঠিত হয়। সিপিবির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও প্রথম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন অং সান। সিপিবি প্রতিষ্ঠার অল্প সময়ের মধ্যে তিনি আরেকটি একই ধরনের সংগঠন গড়ে তোলেন। পিপল’স রেভল্যুশনারি পার্টি বা বার্মা রেভল্যুশনারি পার্টি নামের মার্ক্সবাদী এই দল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ছিল, ব্রিটিশদের কাছ থেকে বার্মার স্বাধীনতা অর্জন। পরে দলটির নাম বদল করে রাখা হয় বার্মা সোশ্যালিস্ট পার্টি।
১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। অক্টোবরে ‘ফ্রিডম ব্লক’ নামের আরেকটি জাতীয়তাবাদী সংগঠন গড়তে সহায়তা করেন অং সান। এই পর্যায়ে বার্মার স্বাধীনতার জন্য তিনি বিদেশি সমর্থন চান।
ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহ গড়ে তোলার চেষ্টার অভিযোগে অং সানের বিরুদ্ধে বার্মায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। তিনি ১৯৪০ সালে বার্মা থেকে পালিয়ে চীন যান। পরে যান জাপানে। তাঁকে বার্মা ইনডিপেনডেন্স আর্মি (বিআইএ) গঠনে সহায়তা করে জাপান।
১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে জাপানের দখলে থাকা থাইল্যান্ডের ব্যাংককে আনুষ্ঠানিকভাবে বিআইএ গঠিত হয়। বিআইএর চিফ অব স্টাফ হন অং সান। তিনি মেজর জেনারেল পদ গ্রহণ করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে বিআইএর সহযোগিতায় ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ বার্মা দখল করে জাপান। জাপানের সামরিক প্রশাসন বার্মার দায়িত্বভার গ্রহণ করে।
১৯৪২ সালের জুলাইয়ে অং সান বিআইএ পুনরায় সংগঠিত করেন। গড়ে তোলেন বার্মা ডিফেন্স আর্মি (বিডিএ)। তিনি এই বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে থাকেন। এবার তিনি কর্নেল পদ গ্রহণ করেন। ১৯৪৩ সালের মার্চে তিনি আবার পদোন্নতি পেয়ে মেজর জেনারেল হন।
১৯৪৩ সালের ১ আগস্ট জাপান ঘোষণা দেয়, বার্মা হবে একটি স্বাধীন দেশ। অং সানকে জাপান-সমর্থিত যুদ্ধকালে সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী করা হয়। তাঁর অধীন সেনাবাহিনীর নাম আবার বদল করা হয়। এবার নাম রাখা হয় বার্মা ন্যাশনাল আর্মি (বিএনএ)।
জাপানি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অং সানের সহযোগিতার সম্পর্ক ছিল স্বল্পস্থায়ী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল জাপানের বিরুদ্ধে যাচ্ছিল। অন্যদিকে বার্মার সত্যিকারের স্বাধীনতার বিষয়ে জাপানের প্রতিশ্রুতি নিয়েও সন্দিহান হয়ে পড়েন অং সান। তা ছাড়া বর্মী জনগণের প্রতি জাপানের আচরণে তিনি অসন্তুষ্ট হন। এবার তিনি বার্মা থেকে জাপানিদের তাড়ানোর গোপন পরিকল্পনা করেন। ভারতে ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি।
১৯৪৪ সালের আগস্টে অং সান গঠন করেন অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট পিপলস ফ্রিডম লিগ (এএফপিএফএল)। ১৯৪৫ সালে তিনি জাপানি দখলদারদের বিরুদ্ধে বিএনএর বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। জাপানিদের পরাজিত করতে মিত্রশক্তিকে সহায়তা করেন।
জাপানি দখলদারি শেষে বার্মায় ব্রিটিশ শাসন ফিরে আসে। এক বছরের মধ্যে ১৯৪৭ সালের ২৭ জানুয়ারি বার্মার স্বাধীনতার নিশ্চয়তা-সংবলিত একটি চুক্তি সই করেন অং সান ও তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি।
গণপরিষদ গঠনের জন্য ১৯৪৭ সালের এপ্রিলে বার্মায় সাধারণ নির্বাচন হয়। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় অং সানের এএফপিএফএল।
অং সান আশঙ্কা করছিলেন, কেউ তাঁকে হত্যা করতে পারে। তাঁর আশঙ্কা সত্যি হতে বেশি সময় লাগেনি।
১৯৪৭ সালের ১৯ জুলাই। সকালে অং সানের নেতৃত্বাধীন বার্মার স্বাধীনতাপূর্ব অন্তর্বর্তী সরকারের মন্ত্রিসভার বৈঠক চলছিল রেঙ্গুনের সচিবালয় ভবনে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সেখানে একটি সামরিক জিপ আসে। জিপে ছিলেন সামরিক পোশাকধারী বেশ কয়েকজন সশস্ত্র ব্যক্তি। কয়েকজন ওপরে উঠে যান। তাঁরা মন্ত্রিসভার বৈঠকে ঢুকে পড়েন। বলেন, ‘বসে থাকুন, কেউ নড়বেন না।’ অং সান উঠে দাঁড়াতেই তাঁর বুকে গুলি করা হয়। অং সান ছাড়াও সেদিন তাঁর ভাই বা উইনসহ মন্ত্রিসভার ছয় সদস্যকে হত্যা করা হয়।
অং সান হত্যার বিচারে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ইউ স দোষী সাব্যস্ত হন। ফাঁসি দিয়ে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তবে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানা ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ চাউর হয়। অং সান হত্যায় ব্রিটিশদের জড়িত থাকার গুজব রটে।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ব্রিটিশদের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা অর্জন করে বার্মা। দেশটির জনগণের কাছে অং সান আধুনিক মিয়ানমারের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচিত হন। তবে গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে তাঁর স্মৃতি মুছে ফেলতে শুরু করে মিয়ানমারের সামরিক সরকার। অথচ তিনিই দেশটির সামরিক বাহিনীর জনক।
তথ্যসূত্র:
থান্ট মিন্ট-ইউ (২০০৮), দ্য রিভার অব লস্ট ফুটস্টেপস: আ পারসোনাল হিস্ট্রি অব বার্মা, ফেবার অ্যান্ড ফেবার।
ইরাবতী, ব্রিটানিকা, নিউওয়ার্ল্ডএনসাইক্লোপিডিয়া