মধ্যপ্রাচ্যে এত দিন যুক্তরাষ্ট্র একা সব কলকাঠি নাড়লেও সে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে।
দুই সপ্তাহ আগে মস্কোয় যে রাজকীয় প্রাসাদে চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মিলিত হন, তার আনুষ্ঠানিক নাম বালশয় দোভারেস, ইংরেজিতে গ্র্যান্ড ক্রেমলিন প্যালেস। এই প্রাসাদের সুসজ্জিত দরবারকক্ষের এক প্রান্ত থেকে হেঁটে এলেন সি, অন্য প্রান্ত থেকে পুতিন। দুজনই দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায়, দুজনই অতিসম্প্রতি আজীবন প্রেসিডেন্ট থাকার আইন-কানুন অনুগত আইন পরিষদ থেকে পাস করিয়ে নিয়েছেন।
এদের একজনের বিরুদ্ধে আবার যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এসেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে। অন্যজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নিজ দেশের উইঘুর মুসলিম ও অন্য সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করছেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একে গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করেছে।
প্রেসিডেন্ট সি প্রেসিডেন্ট পুতিনের হাতে হাত রেখে মুচকি হেসে বললেন, ঝিজি, মানে প্রিয় বন্ধু। জবাবে পুতিন বললেন, দরোগোই দ্রুগ, মানে প্রিয় বন্ধু। সফরের আগে সি বলেছিলেন, তিনি ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে শান্তির প্রস্তাব নিয়ে আসছেন। যাঁরা ভেবেছিলেন তিনি হয়তো এই যুদ্ধে নিজেকে নিরপেক্ষ রেখে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেবেন, সে আশার গুড়ে বালি। ওই ‘হ্যালো’ থেকেই প্রেসিডেন্ট সি নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে দিলেন।
বিশ্বে চীন এখন দ্বিতীয় প্রধান পরাশক্তি। শুধু অর্থনীতি নয়, সামরিক ক্ষেত্রেও দেশটি দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তিক্ষেত্রে তার উল্লম্ফন অভাবিত। এই চীন এখন চাইছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর মার্কিন নেতৃত্বে যে বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তাকে পাশ কাটিয়ে একটি বিকল্প বৈশ্বিক ব্যবস্থা নির্মাণ করতে। একা নয়, এই কাজে সে পাশে চায় রাশিয়াকে। এই দুই দেশ ইতিমধ্যে তাদের ‘অনিঃশেষ বন্ধুত্বের’ কথা ঘোষণা করেছে। সেই বন্ধুত্বকে কাজে লাগিয়ে চীন চাইছে এক নয়া বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে।
গত ৭০ বছরে রুশ-চীন সম্পর্কে নানা চড়াই-উতরাই গেছে। ১৯৪৯ সালে চীনা বিপ্লবের সময় বন্ধুত্ব দিয়ে যে সম্পর্কের শুরু, সোভিয়েত একনায়ক স্তালিনের মৃত্যুর পর সে সম্পর্ক গড়ায় শত্রুতায়। ১৯৬৯ সালে দুই দেশের মধ্যে বড় ধরনের সীমান্ত যুদ্ধও হয়। নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর দুই দেশের সম্পর্কে আবার পালাবদল হয়। পরবর্তী দুই দশকে এই দুই দেশ ক্রমেই একে অপরের কৌশলগত মিত্র হয়ে ওঠে। উভয়েরই অভিন্ন শত্রু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা সামরিক জোট। এই নতুন মৈত্রী জোটে নেতা চীন, রাশিয়া তার ‘জুনিয়র পার্টনার’।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে চীনের ওপর রাশিয়ার নির্ভরশীলতা বেড়ে গেছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে তাকে তেল–গ্যাস বিক্রির জন্য চীনের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এতে চীনেরই বেশি লাভ। সে সস্তায় তেল পাচ্ছে, তদুপরি ডলার বা রুবলের বদলে রেনমিনবিতে তেল বিক্রিতে রাশিয়া রাজি হওয়ায় নিজ দেশের মুদ্রাকে ডলারের বিকল্প হিসেবে দাঁড় করানোর কাজে বড় রকম সমর্থন পেল সে। চীনের অন্য ফায়দা, সে রাশিয়ার কাছ থেকে অব্যাহত তেল-গ্যাস সরবরাহের দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছে। মস্কোয় এই দুই দেশের নেতারা সাইবেরিয়া থেকে চীন সীমান্ত পর্যন্ত দেড় হাজার মাইল লম্বা নতুন গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণে সম্মত হয়েছেন, যার ফলে কম করে হলেও বছরে ৫০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস রপ্তানি করা সম্ভব হবে।
রাশিয়া অবশ্য শুধু তেল-গ্যাস বিক্রি নয়, সে চীনের কাছ থেকে অস্ত্র চায়, যা দিতে চীন খুব একটা আগ্রহী নয়। তার অর্থনীতি ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। শুধু সম্পৃক্তই নয়, বহুলাংশে নির্ভরশীল। এই অবস্থায় রাশিয়ার কাছে অস্ত্র বিক্রির ফলে যদি চীনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসে, তাহলে অনেক কিছু কেচে যেতে পারে। সে বিবেচনায় সি এ মুহূর্তে মস্কোকে অস্ত্র সরবরাহে কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি।
শুধু তেল-গ্যাসের খোঁজে মস্কোয় আসেননি প্রেসিডেন্ট সি। তাঁর লক্ষ্য আরও গভীর। তিনি নিজেকে ও নিজের দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘বিকল্প’ পরাশক্তি হিসেবে উপস্থিত করতে চান। চীন অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে যত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা ক্রমেই তীব্রতর হয়েছে। ওয়াশিংটন খোলামেলাভাবেই বেইজিংকে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী—কূটনৈতিক ভাষায় ‘কম্পিটিটর’ হিসেবে বিবেচনা করছে।
বাইডেন প্রশাসন বলেছে, রাশিয়া বা ইসলামি জঙ্গিবাদ নয়, চীনই তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য প্রধান হুমকি। মাসখানেক আগে এক শীর্ষস্থানীয় মার্কিন জেনারেল এমন কথাও বলেছেন যে তাইওয়ানকে নিয়ে আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ অনিবার্য।
এই চিত্রনাট্য চীনের অজানা নয়। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে উঠতে দেয়নি, তাকেও দেবে না, সে হিসাব মাথায় রেখেই চীন প্রধানত তার নিজ ‘প্রভাব বলয়’ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সামরিক, বিশেষত সমুদ্রভিত্তিক উপস্থিতি সংহত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। তাইওয়ানকেও সে নিজের অঙ্গীভূত করতে চায়। এই চেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের চোখ এড়ায়নি, পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে সেও এই অঞ্চলে তার সামরিক শক্তি ও আঁতাত জোরদার করেছে। জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারতকে সঙ্গে নিয়ে নতুন সামরিক আঁতাত গড়ে তুলেছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যকেও সে কাছে টেনে নিয়েছে।
এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে নিজের সঙ্গী খুঁজতে গিয়ে রাশিয়ার দিকে হাত বাড়িয়েছে চীন। হতে পারে রাশিয়া অর্থনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের তুলনায় নস্যি, কিন্তু পারমাণবিক শক্তি হিসেবে সে কারও চেয়ে কম নয়। এই দুই দেশ এবং তার সঙ্গে যদি ব্রাজিল, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইরানের মতো দেশকে সঙ্গে পাওয়া যায়, তাহলে যে ‘বিকল্প’ বিশ্বব্যবস্থার কথা চীন ভেবেছে, তার বাস্তবায়ন অসম্ভব হবে না।
ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দেওয়ার মতো একটি বড় কাজ করেছে চীন। গত মাসে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে দীর্ঘদিনের পুরোনো শত্রুতার অবসান ঘটিয়ে এই দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে। ২০১৬ সালের পর থেকে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইরান-সৌদি আরবের মধ্যে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। এই যুদ্ধে শিয়া হুতিদের পক্ষে ইরান আর ইয়েমেনি সুন্নিদের পক্ষে সৌদি আরব। এই রক্তক্ষয়ী প্রতিদ্বন্দ্বিতা ইরান ও সৌদি আরব উভয়ের জন্যই বিপর্যয়ের কারণ হয়ে উঠেছে। উভয় দেশই চায় এই অবস্থার অবসান।
মধ্যপ্রাচ্যে এত দিন যুক্তরাষ্ট্র একা সব কলকাঠি নাড়লেও সে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। সৌদির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান যুক্তরাষ্ট্রকে, বিশেষত বাইডেন প্রশাসনকে, মোটেই বিশ্বাস করেন না। অন্যদিকে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিবাদ পুরোনো, এই দুই দেশের আনুষ্ঠানিক কোনো কূটনৈতিক সম্পর্কও নেই। ফলে ইয়েমেনের যুদ্ধ বন্ধে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা পালন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে অসম্ভব। এই অবস্থায় যে কূটনৈতিক শূন্যতা ছিল, তা পূরণে এগিয়ে আসে চীন। তারই দূতিয়ালিতে ইরান ও সৌদি আরব তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সম্মত হয়।
শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, সারা বিশ্বেই নিজেকে আরও বড় ‘খেলোয়াড়’ হিসেবে দেখতে চায় চীন। এই নতুন প্রকল্পে সে মস্কোকেও পাশে চায়, তবে তার ‘জুনিয়র পার্টনার’ হিসেবে। একসময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে মস্কোকে একঘরে করতে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র হাতে হাত মিলিয়েছিল। এখন চীন ও রাশিয়া হাতে হাত মেলাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা সামরিক জোটকে একঘরে করতে। সোভিয়েত আমলে চীন ছিল দুর্বল ও অক্ষম এক প্রতিবেশী, যাকে মস্কো যেমন খুশি ধমক দিয়ে ঠান্ডা রাখতে পারত। সে অবস্থা পাল্টে গেছে। এখন নীতিনির্দেশ আসবে বেইজিং থেকে, বিনা প্রতিবাদে তা পালন করবে মস্কো। সির সামনে পুতিনের শুকনো মুখ দেখে সে কথা বেশ বোঝা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা কার্নেগি এন্ডাউমেন্টের নামজাদা রুশ বিশ্লেষক আলেকসান্দর গাবুয়েভ ইতিহাসের এই পালাবদলের এক ব্যাখ্যায় লিখেছেন, এ কথা ঠিক যে একসময় চীন রাশিয়ার ‘ছোট ভাই’ ছিল, কিন্তু এখন সে বড় ভাই। বিশ্বের দুই নম্বর শক্তি হিসেবে তার বৈশ্বিক প্রভাব রাশিয়ার তুলনায় অনেক বেশি। তা ছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধে বেকায়দায় পড়ে চীনের নেতৃত্ব মেনে নেওয়া ছাড়া রাশিয়ার হাতে ভিন্ন কোনো অস্ত্রও নেই।
আলেকসান্দর গাবুয়েভ বলেন, আগামী বছরগুলোয় চীনের ওপর রাশিয়ার নির্ভরশীলতা বাড়বে বৈ কমবে না। নিজের তেল-গ্যাস রপ্তানির জন্য চীন হবে রাশিয়ার এক নম্বর বাজার। রুশ ভোক্তারাও চীনা পণ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। চীনা মুদ্রার মাধ্যমে পণ্য কেনাবেচায় রাজি হওয়াতে আগামী বছরগুলোয় রেনমিনবাই আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে অধিক গ্রহণযোগ্যতা পাবে। তার চেয়ে বড় কথা, ওয়াশিংটনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এই রুশ-চীনা আঁতাত বেইজিংয়ের জন্য এক কার্যকর অস্ত্র হয়ে উঠবে।
গাবুয়েভ মনে করেন, পুতিন এখন সির পকেটে। এই নতজানু অবস্থা যাতে অব্যাহত থাকে, সে জন্য তিনি চান পুতিন যাতে ক্ষমতায় টিকে থাকেন। তাঁকে সরিয়ে যদি পশ্চিমাপন্থী কেউ রাশিয়ায় ক্ষমতায় আসেন, তা চীনের জন্য হবে মস্ত শিরঃপীড়ার কারণ।
চীন যে নিজেকে যুক্তরাষ্ট্র–নিয়ন্ত্রিত বৈশ্বিক ব্যবস্থার বিকল্প নির্মাণে আগ্রহী, তার আরেক প্রমাণ ‘বৈশ্বিক নিরাপত্তা উদ্যোগ’ (গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ)। গত বছর এপ্রিলে সি চিন পিং এক ভাষণে প্রথম এই উদ্যোগের কথা বলেন। সে ভাষণে তিনি সব দেশকে মিলেমিশে থাকার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ‘কারণ, আমরা সবাই একই নৌকার যাত্রী, সবাই আমরা নিরাপত্তা চাই।’ এ বছর ২১ ফেব্রুয়ারি বেইজিং এই উদ্যোগের সবিস্তার ব্যাখ্যা হিসেবে যে ‘শ্বেতপত্র’ প্রকাশ করে, তাতে স্পষ্ট যে চীন চলতি পশ্চিমা আধিপত্যবাদী (হেজিমোনিক), একপার্শ্বিক (ইউনিল্যাটারাল) ও সংরক্ষণবাদী (প্রটেকশনিস্ট) বিশ্বব্যবস্থার পরিবর্তন চায়।
কীভাবে এই পরিবর্তন আসবে, তার ছবিটি খুব স্পষ্ট নয়, তবে চীনা নেতাদের কথা থেকে স্পষ্ট যে তারা পশ্চিমা হস্তক্ষেপমূলক রাজনীতির স্থলে জাতীয় সার্বভৌমত্বকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কেন্দ্রীয় সূত্র হিসেবে দেখতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে কথায় কথায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলে, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে, চীন তার অবসান চায়। এই প্রস্তাবের উৎস সম্ভবত সতেরো শতকের ওয়েস্টফালিয়ান মডেল। সে মডেলের কেন্দ্রীয় ভাবনা ছিল ‘সার্বভৌমত্ব অলঙ্ঘনীয়’ নীতি। কিন্তু রাশিয়া যেভাবে প্রতিবেশী ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করা সত্ত্বেও চীন তার নিন্দা করেনি, তাতে এই সব প্রস্তাব যে নিঃস্বার্থ কোনো ব্যাপার নয়, তা পরিষ্কার হয়ে গেছে।
কোনো কোনো মার্কিন বিশেষজ্ঞ এই উদ্যোগকে ‘একনায়কের ইশতেহার’ বলে উপহাস করেছেন। আটলান্টিক পত্রিকায় মাইকেল শুম্যান লিখেছেন, এই নয়া ব্যবস্থার লক্ষ্য, বিশ্বের একনায়কেরা যাতে স্বস্তির সঙ্গে ক্ষমতা ভোগ করতে পারেন, তা নিশ্চিত করা। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, ’বেইজিং আসলে যা চায়, তা হলো, ৭৫ বছর ধরে যে আইনভিত্তিক ব্যবস্থা আমরা ধরে রেখেছি, তা গুঁড়িয়ে এমন এক ব্যবস্থা নির্মাণ করা, যেখানে চীনের মতো কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা বৈধ বলে বিবেচিত হবে।’
চীন যে চলতি পশ্চিমা ধাঁচের বহুপক্ষীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে একমাত্র বৈধ ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না, তা কোনো গোপন কথা নয়। প্রেসিডেন্ট বাইডেন তাঁর আহূত ‘গণতন্ত্র’ সম্মেলনে চীন বা রাশিয়া কাউকে দাওয়াত দেননি, তাতে ঠোঁট উল্টিয়ে চীন বলেছে, কে বলেছে যুক্তরাষ্ট্র যাকে গণতন্ত্র বলে, সেটাই গণতন্ত্রের একমাত্র মডেল? গণতন্ত্র যেমনই হোক, আসল কথা হলো, তাতে ফল মিলছে কি না। চীনের দাবি, তাদের গণতান্ত্রিক মডেলে অবশ্যই ফল মিলছে।
ভয়টা এখানেই। চীন একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা, সেখানে শুধু যে একদলীয় শাসন তা–ই নয়, শাসনতান্ত্রিকভাবে সে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান আমৃত্যু ক্ষমতায় থাকতে পারেন। উইঘুর মুসলিম নিগ্রহ ও কোভিড অতিমারির প্রশ্নে চীনা নেতৃত্বের অবস্থান থেকে স্পষ্ট, ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের যেকোনো রকম সমালোচনা তার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। একুশ শতকে এসে কি আমরা এই কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থাকেই সেরা ব্যবস্থা হিসেবে মেনে নেব?
সন্দেহ নেই, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে অনেকেরই আপত্তি রয়েছে। তাকে এড়িয়ে যদি একটি বিকল্প বৈশ্বিক ব্যবস্থা গঠনে চীন সক্ষম হয়, তাহলে তাকে সমর্থন করে, এমন দেশ ও নেতার অভাব হবে না। বস্তুত, শান্তির লক্ষ্যে যদি চীনের এই উদ্যোগ পরিচালিত হয়, তাতে আখেরে আমাদের লাভই হবে। কিন্তু তা যদি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে পরিচালিত হয়, অথবা তার ‘ঝিজি’ পুতিনকে রক্ষা করা লক্ষ্য হয়, তাহলে কিছু লোককে হয়তো কিছু সময়ের জন্য বোকা বানানো যাবে, কিন্তু সবাইকে সব সময়ের জন্য বোকা বানানো সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
৩০ মার্চ ২০২৩, নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক