মালকির আজ আনন্দের দিন। ১০ বছর বয়সী মালকি দুই ভাই ও দুই বোন সকালে বিছানা থেকে ওঠার এক ঘণ্টা আগেই উঠে গেছে। শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক সংকটকালে স্কুল বন্ধ থাকার পর আজ বৃহস্পতিবার স্কুল খুলেছে। আজ সে নতুন করে প্রথম স্কুলে যাবে। তাই সকাল থেকেই তার আনন্দের সীমা নেই।
কিন্তু মালকির ভাইবোনের মনে সেই আনন্দ আজ নেই। কারণ, এই সংকটকালে শ্রীলঙ্কার পরিবারগুলোর সবাইকে স্কুলে পড়াশোনা করানোর সাধ্য নেই। তাই পরিবারের কোন সদস্য স্কুলে যাবে, তা বাধ্য হয়ে বেছে নিতে হয়েছে অভিভাবকদের। মালকির মা–বাবা স্কুলে পাঠানোর জন্য অন্য সন্তানদের বাদ দিয়ে মালকিকে বেছে নিয়েছেন।
বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছয় মাস আগে চরম অর্থনৈতিক সংকটে দেশটির রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়। পরিবর্তন হয় সরকারও। এখন অনেকটাই শান্ত হয়ে এসেছে দেশটি। কিন্তু গণবেকারত্ব ও অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে পরিবারগুলো দিশাহারা অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে।
মালকির মা প্রিয়ন্তিকা চরম অভাবের কারণে সন্তানদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। সন্তানদের নিয়ে তিনি আতশবাজি বিক্রি করেন। এতে যা আয় হয়, তা–ই দিয়ে কোনোরকমে সংসার চলে তাঁদের। যেদিন আয় হয় না, সেদিন মালকির পরিবারের সবাইকে না খেয়ে থাকতে হয়।
শ্রীলঙ্কায় মুদ্রাস্ফীতি সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায় ৯৫ শতাংশে পৌঁছালে খাদ্যদ্রব্যের দামও রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে গেছে।
শ্রীলঙ্কায় স্কুলশিক্ষা বিনা মূল্যে হলেও শিশুদের খাবার দেওয়া হয় না। খাবার, স্কুলের ইউনিফর্ম ও পরিবহন খরচ হিসাব করলে এ মুহূর্তে দেশটিতে স্কুলের পড়াশোনা একটি বিলাসী ব্যাপার, যা প্রিয়ন্তিকার পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়।
আজকের খাবার জোগাড় হয়ে গেলে আগামীকাল কী খাব, কীভাবে খাবার জোগাড় করব, তা নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে। এটাই এখন আমাদের জীবন হয়ে গেছে।প্রিয়ন্তিকা, মালকির মা
প্রিয়ন্তিকারা এক কক্ষের বাসায় থাকা একটি বিছানায় সবাই গাদাগাদি করে ঘুমান। তিনি কেঁদে কেঁদে বলেন, ‘যদি সব সন্তানকে এখন স্কুলে পাঠাই, তাহলে প্রতি সন্তানের জন্য দিনে ৪০০ রুপির প্রয়োজন। আগে সব সন্তানই প্রতিদিন স্কুলে যেত। কিন্তু তাদের সবাইকে স্কুলে পাঠানোর মতো অর্থ আমার কাছে নেই।’
মালকির আগের জুতা ও ইউনিফর্ম এখনো গায়ে লাগে বলে সে স্কুলে যেতে পারছে। কিন্তু তার ছোট বোন দুলাঞ্জলির জন্য সব কিনতে হবে। এ কারণে তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ। স্কুলে যেতে না পেরে বিছানায় শুয়ে কাঁদছে দুলাঞ্জলি। মা প্রিয়ন্তিকা তাকে আশ্বাস দিচ্ছেন, ‘কেঁদো না, সোনা। কাল তোমাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব।’
সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সাদা সুতির ইউনিফর্ম পরে নোংরা রাস্তায় দল বেঁধে হাঁটে স্কুলগামী শিশুরা। দুষ্টুমি করতে করতে স্কুলে পৌঁছায়। রোজ এসব দৃশ্য দেখা কলম্বোর কোটাহেনা সেন্ট্রাল সেকেন্ডারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রক্রমা ওয়ারাসিংহে এখন এই অর্থনৈতিক দুরবস্থা দেখে ক্লান্ত।
প্রক্রমা ওয়ারাসিংহে বলেন, সকালে স্কুলের ক্লাস শুরু হওয়ার আগে আমরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে অ্যাসেম্বলি করি। সেখানে ক্ষুধার যন্ত্রণায় অনেক শিক্ষার্থী অচেতন হয়ে পড়ে।
দেশটির সরকার বলছে, স্কুলগুলোয় তারা খাবার বিতরণ শুরু করেছে। তবে বেশ কয়টি স্কুল জানিয়েছে, তারা এ ধরনের কোনো সহায়তা পায়নি।
প্রক্রমা ওয়ারাসিংহে বলেন, বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী উপস্থিতি ৪০ শতাংশের মতো কমে গেছে। এর আগে তিনি শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরিয়ে আনার জন্য শিক্ষকদের অতিরিক্ত খাবার আনতে বাধ্য করেছিলেন।
সিলন শিক্ষক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জোসেফ স্ট্যালিনের মতে, অর্থনৈতিক সংকটের কারণে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়া শিক্ষার্থীদের ক্রমবর্ধমান পরিবারের সংখ্যা সম্পর্কে সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে অসচেতন।
ইউনিসেফ বলছে, সামনের মাসগুলোয় নিজেদের জন্য খাবার জোগাড় করা মানুষের পক্ষে অনেক কঠিন হবে। চালের মতো মৌলিক পণ্যের মূল্যস্ফীতি পরিবারগুলোকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। সারা দেশে আরও বিপুলসংখ্যক শিশু স্কুলে যাওয়া বন্ধ করতে বাধ্য হবে।
জোসেফ স্ট্যালিন বলেন, ‘এই অর্থনৈতিক সংকটের প্রকৃত শিকার শিশুরা। এ সমস্যার সমাধানে সরকারের কোনো চেষ্টা নেই। দেশটির সরকার যা করার কথা, তা ইউনিসেফ ও অন্যরা করছে।’
ইউনিসেফ বলছে, সামনের মাসগুলোয় নিজেদের জন্য খাবার জোগাড় করা মানুষের পক্ষে অনেক কঠিন হবে। চালের মতো মৌলিক পণ্যের মূল্যস্ফীতি পরিবারগুলোকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। সারা দেশে আরও বিপুলসংখ্যক শিশু স্কুলে যাওয়া বন্ধ করতে বাধ্য হবে।
শ্রীলঙ্কার এ চরম দুরবস্থা মোকাবিলায় দেশটির সরকার আপাতদৃষ্টে ব্যর্থ। এ কারণে দাতব্য সংস্থাগুলোকে নানামুখী পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে।
কলম্বোয় তিন দশক ধরে দরিদ্র মানুষকে সহায়তা করে আসছে ক্রিশ্চিয়ান দাতব্য প্রতিষ্ঠান সমতা সরনা। সংস্থাটির খাদ্যগুদামের সামনে এখন দৈনিক রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীরা খাবার পাওয়ার আশায় ভিড় করে থাকে। সংস্থাটি প্রতিদিন প্রায় ২০০ শিশুকে খাদ্য সহায়তা দেয়, যা চাহিদার তুলনায় খুবই সামান্য।
বন্ধুদের সঙ্গে মনোজ নামের পাঁচ বছর বয়সী এক স্কুলশিক্ষার্থীও দুপুরের খাবার পাওয়ার আশায় সমতা সরনার কার্যালয়ের সামনে লাইনে দাঁড়িয়েছে। সে বলে, ‘তারা আমাদের খাবার দেয়, বাসে করে বাড়িতে পৌঁছে দেয়। তারা আমাদের সবকিছু দেয়, যেন আমরা পড়াশোনা করতে পারি।’
প্রথম দিন স্কুল থেকে ফিরে মালকি বেশ উচ্ছ্বসিত। বন্ধুদের সঙ্গে দিনটা বেশ উপভোগ করেছে বলে সে মা প্রিয়ন্তিকাকে জানিয়েছে। কিন্তু সে এ-ও জানিয়েছে, নতুন ওয়ার্কবুক কিনতে হবে। আর স্কুলের একটি প্রকল্পের উপকরণ কেনার জন্য শিক্ষকেরা অতিরিক্ত অর্থ চেয়েছেন।
কিন্তু প্রিয়ন্তিকার পরিবারে তো কোনো অর্থই নেই। প্রিয়ন্তিকা বলেন, ‘আজকের খাবার জোগাড় হয়ে গেলে আগামীকাল কী খাব, কীভাবে খাবার জোগাড় করব, তা নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে। এটাই এখন আমাদের জীবন হয়ে গেছে।’
গত বছরের শুরুতে শ্রীলঙ্কায় জ্বালানি তেলের হাহাকার ছিল। সপ্তাহের পর সপ্তাহ ফিলিং স্টেশনে লাইনে দাঁড়িয়ে জ্বালানির পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন মোটরযানের চালকেরা। জ্বালানি তেলের সংকট থেকে শুরু হয় বিক্ষোভ। কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভে জুলাইয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে।
আর্থিক দুর্দশার কারণে শ্রীলঙ্কার সরকার ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে গত এপ্রিলে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে। ওই সময় শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলার। রাজাপক্ষের পদত্যাগের পর নতুন প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে ক্ষমতায় এসে কর ছাড়ের কিছু সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন।