মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইপে সফরের পর চীনের সামরিক মহড়াকে কেন্দ্র করে তাইওয়ান প্রণালিতে উত্তেজনা বাড়ছে। তাইওয়ানের চারপাশে এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়া চালাচ্ছে বেইজিং। ছোড়া হচ্ছে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। বেশ কয়েকটি যুদ্ধবিমান ও যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করা হচ্ছে।
তাইওয়ানে পেলোসির ভ্রমণকে চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ভয়াবহ, বেপরোয়া এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন উসকানি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে বেইজিং। এমন অবস্থায় চীন তাইওয়ানে হামলা করবে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে আল–জাজিরা।
তাইওয়ানের কাছে গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া এ সামরিক মহড়া আগামী রোববার পর্যন্ত চলবে। চীন বলছে, নিজেদের সার্বভৌমত্ব এবং এলাকাগত অখণ্ডতা বজায় রাখতে এ মহড়া চালানে হচ্ছে। আল–জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, ইতিমধ্যে এ মহড়ার কারণে অঞ্চলটিতে উত্তেজনা বেড়েছে। জাপান বলছে, চীনা বাহিনীর ছোড়া বেশ কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র তাদের সমুদ্রসীমার এক্সক্লুসিভ ইকনোমিক জোনে (ইইজেড) পড়েছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট (আসিয়ান) সতর্ক করে বলেছে যে পরিস্থিতি চলছে, তাতে শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে হিসাব-নিকাশে ভুল হওয়া, গুরুতর বিরোধ, সরাসরি সংঘাত এবং অনিশ্চিত পরিণতির শঙ্কা রয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাতে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েন একটি বিবৃতি দিয়েছেন। ওই বিবৃতিতে তিনি চীনের ‘একতরফা ও অযৌক্তিক সামরিক কর্মকাণ্ড’ নিরসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চেয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, তাইওয়ান সংঘাতে উসকানি দেবে না, তবে দৃঢ়ভাবে নিজেদের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তাকে সুরক্ষা দেবে।
চীনের উপকূল থেকে তাইওয়ানের দূরত্ব ১৮০ কিলোমিটার। চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম বলছে, তাইওয়ানের চারপাশে ছয়টি অঞ্চলে একই সঙ্গে সাগরে তাজা গোলার মহড়া এবং বিমান মহড়া চলছে। সিসিটিভির তথ্যানুযায়ী, বোমারু বিমানসহ শতাধিক যুদ্ধবিমান মহড়ায় অংশ নিয়েছে।
চীনের মহড়াকে তাইওয়ানের পানিসীমার লঙ্ঘন উল্লেখ করে নিন্দা জানিয়েছে তাইওয়ান। একে তাইওয়ান অঞ্চলের সাগর ও আকাশপথ অবরোধের শামিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
মহড়ার প্রথম দিনে তাইওয়ানের চারপাশের জলসীমায় চীনা রকেট থেকে বেশ কয়েকটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে। ১৯৯৬ সালের পর এমন ঘটনা এবারই প্রথম। তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, অঞ্চলটি লক্ষ্য করে ১১টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে। এগুলো ডংফেং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বলে শনাক্ত হয়েছে।
জাপান বলছে, ইইজেডে কমপক্ষে পাঁচটি ক্ষেপণাস্ত্র পড়েছে।
তাইওয়ান কর্তৃপক্ষ ওই এলাকায় ভ্রমণকারী জাহাজ ও বিমানকে বিকল্প পথ খুঁজে বের করতে বলেছে। বৃহস্পতিবার তাইওয়ানের রাজধানী তাইপেতে তাইওয়ান বিমানবন্দরে বেশ কয়েকটি ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম বলছে, মহড়া চলায় এক-দুই দিনের জন্য তাইওয়ানের সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার কোরিয়ান এয়ার এবং এশিয়ান এয়ারলাইনসের ফ্লাইট স্থগিত করা হয়েছে।
তাইওয়ান কি চীনে আক্রমণ করতে পারবে, এটি কতটা কঠিন হতে পারে
চীনের নজিরবিহীন মহড়ার কারণে আবারও প্রশ্ন উঠেছে, বেইজিং তাইওয়ানে হামলা চালাবে কি না, তা নিয়ে। বিশেষ করে চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমসে যেসব বিশেষজ্ঞ মত প্রকাশ হচ্ছে তাতে দেখা গেছে, এ মহড়াকে ‘পুনর্মিলনের মহড়া’ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে।
এর একটি প্রতিবেদনে চীনা মূল ভূখণ্ডের সামরিক বিশ্লেষক সং ঝংপিংকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, এখন যে অভিযানের মহড়া চলছে, তা ভবিষ্যতে সামরিক সংঘাতের ক্ষেত্রে সরাসরি যুদ্ধাভিযানে পরিণত করা হতে পারে।
বিভিন্ন গুঞ্জন সত্ত্বেও বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলছেন, চীন কিংবা যুক্তরাষ্ট্র কেউই চায় না তাইওয়ানে যুদ্ধ হোক। অন্তত শিগগিরই যুদ্ধ বাধুক, তা তারা চায় না।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান মার্শাল ফান্ডের এশিয়াবিষয়ক পরিচালক বোন্নি গ্লেজার বলেন, ‘চীনের রেডলাইনকে চ্যালেঞ্জ করে অতিরিক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও তাইওয়ানকে সতর্ক করতে চাইছে চীন।
বোন্নি আল–জাজিরাকে বলেন, তাইওয়ানে অবরোধ আরোপের সক্ষমতা জানান দিচ্ছে তারা। তবে সি চিন পিং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে চাইছেন না। তাইওয়ানে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেননি তিনি।
চীন যদি জোর করে তাইওয়ানের দখলও নিতে চায়, তবে এতে উল্লেখজনক ঝুঁকি রয়েছে। পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, ১০ হাজারের বেশি সেনা নিয়ে চীনা বাহিনীকে তাইওয়ান প্রণালি অতিক্রম করতে হবে। তখন তাঁরা বিমান ও জাহাজ থেকে ছোড়া বোমা হামলার শিকার হতে পারেন। সেনারা যদি তাইওয়ানের উপকূলে পৌঁছেও যায়, তারপরও তীরে নামতে তাঁদের বেগ পেতে হবে। কারণ, অসমতল উপকূল রেখায় তাঁদের সশস্ত্র সেনা, সাঁজোয়া যান, ট্যাংক ও গোলাবারুদ নামানোর মতো উপযুক্ত তীর এলাকার সংখ্যা হাতে গোনা।
এ ছাড়া চীন তাইওয়ানে আক্রমণ করলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যেও বড় ধরনের সংঘাত বেধে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে আনুষ্ঠানিকভাবে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও ১৯৭৯ সালের তাইওয়ান রিলেশনস অ্যাক্ট অনুযায়ী, দেশটি দ্বীপ অঞ্চলটিকে সহযোগিতা করতে বাধ্য। গত মে মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, চীন আক্রমণ করলে তাইওয়ানের সুরক্ষায় সহযোগিতা করবে যুক্তরাষ্ট্র।
২ কোটি ৩০ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত অঞ্চল তাইওয়ানকে নিজেদের এলাকা বলে দাবি করে চীন। যদিও দেশটির সরকার কখনো তাইওয়ান শাসন করেনি। তাইপে ও ওয়াশিংটনের মধ্যে সব ধরনের আনুষ্ঠানিক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও আপত্তি জানিয়ে থাকে চীন সরকার। এমন অবস্থায় পেলোসির তাইওয়ান সফরকে উসকানি ও সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন হিসেবে দেখছে বেইজিং।
সম্প্রতি বাইডেনের সঙ্গে ফোনালাপে সি চিন পিং হুঁশিয়ার করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যেন তাইওয়ান ইস্যুতে আগুন নিয়ে খেলা না করে। তিনি কঠোরভাবে তাইওয়ানের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছেন। বহিরাগত বাহিনীর হস্তক্ষেপ মেনে নেওয়া হবে না বলেও সতর্ক করেছেন তিনি।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, পেলোসির এ সফরের কারণে বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যকার বিরোধ আরও বেড়ে যেতে পারে এবং তাইওয়ান প্রণালিতে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিতে পারে।
বেইজিংভিত্তিক সেন্টার ফর চায়না অ্যান্ড গ্লোবালাইজেশনের প্রেসিডেন্ট হেনরি হুইইয়াও ওয়াং বলেছেন, পেলোসির দিক থেকে এটি সত্যিই বাজে পদক্ষেপ ছিল।
কারণ, তিনি এমন একসময়ে এসেছেন, যখন কিনা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। এমন একসময়ে তিনি সফর করেছেন, যখন বিশ্বে মহামারি, ইউক্রেন সংকট ও জ্বালানি–সংকটসহ আরও অনেক কিছু চলছে।
ওয়াং মনে করেন, এতে শুধু চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, বরং চীন ও তাইওয়ানের সম্পর্কে গুরুতর সংকট দেখা দেবে। ভবিষ্যতে এর পরিণাম ভোগ করতে হবে বলেও সতর্ক করেছেন তিনি।