মাঝ আকাশে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পড়া সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজটির যাত্রীরা তাঁদের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, ঝাঁকুনির সময় উড়োজাহাজের ভেতরে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে উড়োজাহাজের ভেতরে যাত্রীরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছিটকে পড়েছিলেন। মালামালগুলোরও একই অবস্থা হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজ আকাশে প্রতিকূল পরিস্থিতির (টারবুলেন্স) কবলে পড়ে। এ সময় ৭৩ বছর বয়সী ব্রিটিশ নাগরিক জিওফ কিচেনের মৃত্যু হয়। ধারণা করা হচ্ছে, তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও বেশ কয়েক যাত্রী। উড়োজাহাজটি যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডন থেকে সিঙ্গাপুরে যাচ্ছিল।
ব্রিটিশ নাগরিক অ্যান্ড্রু ডেভিস বিবিসিকে বলেন, ‘ঘটনার শুরুতে কয়েক সেকেন্ড ভয়ংকর রকমের চিৎকার শোনা যাচ্ছিল এবং ধপধপ শব্দ হচ্ছিল। আমার যতটুকু মনে পড়ে, বাতাসে জিনিসপত্র উড়ে যাচ্ছিল। আমার পুরো শরীর কফিতে ভরে যায়। অত্যন্ত মারাত্মক ধরনের ঝাঁকুনি ছিল এটি।’
আরেক যাত্রী বলেন, উড়োজাহাজটি হঠাৎই ওপর থেকে নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং দুলতে থাকে।
ওই উড়োজাহাজের যাত্রী, ২৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থী জাফরান আজমির বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘যা ঘটছিল, তাতে আমি খারাপ কিছুর জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। হঠাৎই এটি নাটকীয়ভাবে নিচের দিকে নামতে শুরু করল। উড়োজাহাজের আসনে বসে থাকা যাত্রীদের যাঁদের সিটবেল্ট বাঁধা ছিল না, তাঁরা সবাই দ্রুত উড়োজাহাজের ছাদের সঙ্গে ধাক্কা খেতে থাকেন।’
মাঝ আকাশে ঝাঁকুনির কবলে পড়া উড়োজাহাজটিকে ব্যাংককের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। স্থানীয় সময় বেলা ৩টা ৪৫ মিনিটের দিকে উড়োজাহাজটি ব্যাংককে অবতরণ করা হয়। উড়োজাহাজটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর মডেলের। এক বিবৃতিতে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস জানিয়েছে, এসকিউ-৩২১ নামের ওই ফ্লাইটে ২১১ জন যাত্রী ও ১৮ জন ক্রু সদস্য ছিলেন।
এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ আরও বলেছে, উড়োজাহাজের ৩১ যাত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে নিহত যাত্রী কিচেনের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানানো হয়েছে।
উড়োজাহাজ প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তা বলেন, প্রায় ১০ ঘণ্টা ওড়ার পর হঠাৎই উড়োজাহাজটি ঝাঁকুনির কবলে পড়ে। এটি তখন মিয়ানমারের ইরাবতী অববাহিকার ৩৭ হাজার ফুট ওপর দিয়ে উড়ছিল।
সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ বলেছে, যাত্রীদের চিকিৎসার ব্যাপারে তারা থাই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে। সহযোগিতার জন্য ব্যাংককে একটি প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছে তারা।
এলিসন বারকার নামের এক নারী বলেন, তাঁর ছেলে জশ ওই উড়োজাহাজে ছিলেন। ছেলের কাছ থেকে তিনি একটি বার্তা পেয়েছেন। ওই বার্তায় জশ লিখেছেন, ‘আমি তোমাদের দুশ্চিন্তায় ফেলতে চাই না। তবে আমি ফ্লাইটে এক উদ্ভট পরিস্থিতির মধ্যে আছি। উড়োজাহাজটি জরুরি অবতরণ করছে। তোমাদের সবার জন্য ভালোবাসা।’
ওই বার্তা পাওয়ার এলিসন বারকা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। ছেলে আবার কখন বার্তা পাঠাবে, তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন তিনি। দুই ঘণ্টা পর ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ হয়।
জশ তাঁর মাকে বলেছেন, ওই ঘটনায় তিনি সামান্য আহত হয়েছেন। তবে মায়ের আশঙ্কা, আঘাত সামান্য হলেও তাঁর ছেলের মনের ওপর এ ঘটনার দীর্ঘ প্রভাব পড়তে পারে।
ওই ফ্লাইটে ছিলেন ৬৮ বছর বয়সী ব্রিটিশ নাগরিক জেরি, তাঁর স্ত্রীও। জেরি বলেন, উড়োজাহাজটি নিচের দিকে নামতে শুরু করার আগে তাঁরা কোনো সতর্কসংকেত পাননি।
ভয়ংকর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে জেরি বলেন, ‘উড়োজাহাজের ছাদের সঙ্গে আমার ও আমার স্ত্রীর মাথা ধাক্কা খায়। যাঁরা উড়োজাহাজের ভেতরে হাঁটাহাঁটি করছিলেন, তাঁরা উল্টে পড়েন।’
গলায় আঘাত পাওয়া আরেক ব্রিটিশ নাগরিক বলেন, এ ঘটনায় তিনি এবং পরিবারের কেউ যে মারা যাননি, তাতে তাঁরা নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করছেন।
থাই হাসপাতাল থেকে বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ওই যাত্রী বলেন, ‘কোনো ঝাঁকুনি ছিল না, উড়োজাহাজে একেবারেই কোনো দুলুনি ছিল না। হঠাৎই আমি ছাদের সঙ্গে গিয়ে ধাক্কা খাই। সবকিছু হঠাৎই ঘটেছে, হঠাৎ করেই আমি ওভাবে ওপরে উঠে গেলাম। আমার দুই সারি পেছনে থাকা আমার ছেলে মেঝেতে পড়ে যায়। আমি শুনেছি, এক ব্যক্তি টয়লেটের ছাদের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছেন। তিনিও খুব বাজেভাবে আহত হয়েছেন।’
সিঙ্গাপুরের পরিবহনমন্ত্রী চি হং তাত বলেন, তাঁদের সরকার যাত্রী ও তাঁদের পরিবারকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেবে।
সাধারণত উড়োজাহাজগুলো মেঘাচ্ছন্ন আকাশে প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। তবে মাঝেমধ্যে পরিষ্কার আকাশেও প্রতিকূল অবস্থা তৈরি হতে পারে, যা উড়োজাহাজের আবহাওয়া–সংক্রান্ত রাডারে ধরা পড়ে না।
বেসামরিক উড়োজাহাজ চলাচল বিশেষজ্ঞ জন স্ট্রিকল্যান্ড বিবিসিকে বলেন, উড়োজাহাজে মারাত্মক ঝাঁকুনি বা এতে হতাহত হওয়ার ঘটনা বিরল।