‘আর ভয় পাই না, আন্দোলন চলবে’

ইরানে বিক্ষোভের মধ্যে পুলিশের মটরসাইকেলে আগুন
ফাইল ছবি: রয়টার্স

‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’ স্লোগানে প্রকম্পিত হচ্ছে বিভিন্ন শহর। রাজধানী তেহরানের প্রবেশপথে টানানো বিশাল ব্যানারে লেখা, ‘আমরা আর ভয় পাই না। আন্দোলন চালিয়ে যাব।’ এভাবে নারী অধিকারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন ইরানের তরুণ-তরুণীরা। দেশটিতে পুলিশি হেফাজতে কুর্দি তরুণী মাসা আমিনির মৃত্যুর পর শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ চতুর্থ সপ্তাহে গড়িয়েছে। আজ শনিবারও ইরানের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নেমেছেন। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই শিক্ষার্থী।

বিক্ষোভের একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে ইরানে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা কুর্দি সংস্থা হেনগাউ। আজ ধারণ করা ওই ভিডিওতে দেখা যায়, নিহত মাসা আমিনির শহর সাকেজের একটি সড়কে মিছিল করছে স্কুলপড়ুয়া মেয়েরা। হিজাব হাতে নিয়ে মাথার ওপর দোলাতে দোলাতে তাদের মুখে স্লোগান ছিল, ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’। আরেকটি ভিডিওতে কুর্দিস্তান প্রদেশের রাজধানী সানানদাজে স্কুলশিক্ষার্থীদের একই স্লোগান দিতে শোনা যায়।

বিক্ষোভকারীদের সমাবেশ ঠেকাতে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিরাপত্তাকর্মীদের দমন-পীড়নের ছবি ছড়িয়ে পড়া বন্ধে ইরানের কিছু কিছু অঞ্চলে ইন্টারনেট-সেবা বন্ধ রেখেছে সরকার। তবে নিজেদের প্রতিবাদী বার্তা ছড়িয়ে দিতে নতুন সব কৌশল বেছে নিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। তেহরানের কেন্দ্রস্থলমুখী একটি সড়কের ওভারপাসের ওপর তাঁরা বিশাল একটি ব্যানার টানিয়েছেন। তাতে লেখা, ‘আমরা আর ভয় পাই না। আন্দোলন চালিয়ে যাব।’

এদিকে শহরে শহরে বিক্ষোভকারীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনী হামলা চালাচ্ছে বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা হেনগাউ। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কুর্দিস্তানের সাকেজ, সানানদাজ ছাড়াও দিভানদারেহ শহরে বিক্ষোভকারীরা হামলার শিকার হচ্ছেন। পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশের মাহাবাদ শহরের পরিস্থিতিও একই। তেহরানের পশ্চিমের কারাজ এবং দক্ষিণের কেরমান ও শিরাজ শহরেও বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা চালাচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনী।

তেহরানে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া নিকা শাকারামি নামের এক কিশোরী গত ২০ সেপ্টেম্বর নিখোঁজ হয়েছিল। সম্প্রতি তার লাশ উদ্ধার হয়। ইরানি কর্তৃপক্ষ বলেছে, ১৬ বছর বয়সী নিকাকে ভবনের ছাদ থেকে শ্রমিকেরা ফেলে হত্যা করতে পারেন। তবে স্বজনেরা বলছেন, তাকে হত্যা করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার মার্কিন অর্থায়নে চলা রেডিও ফারদাকে পাঠানো এক ভিডিও বার্তায় নিকার মা নাসরিন শাকারামি বলেন, তিনি মেয়ের শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখেছেন, যা কর্তৃপক্ষের বক্তব্যের সঙ্গে মিলছে না।

ইরানে এই বিক্ষোভের শুরু গত মাসের মাঝামাঝিতে। হিজাব পরায় নিয়ম মানা হয়নি অভিযোগে ২২ বছর বয়সী মাসা আমিনিকে তেহরান থেকে গ্রেপ্তার করেছিল দেশটির নীতি পুলিশ। তিন দিন পর ১৬ সেপ্টেম্বর পুলিশি হেফাজতে তাঁর মৃত্যু হয়। এরপর নারী অধিকারের দাবিতে দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি স্কুলশিক্ষার্থীরাও যুক্ত হয়েছে। বিক্ষোভ ঠেকাতে নিরাপত্তাকর্মীরা সহিংস পথ বেছে নিয়েছেন। চলছে ব্যাপক ধরপাকড়। বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত অন্তত ১৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো।

বিক্ষোভ দমনে কঠোরতার পাশাপাশি ভিন্ন কৌশলও নিচ্ছে ইরান সরকার। দেশটির প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি গতকাল তেহরানের আল-জাহরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরুর অনুষ্ঠানে নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছবি তুলেছেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, ‘শত্রুরা ভেবেছিল, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের আশা পূরণ করতে পারবে। তবে তারা এটা জানে না যে আমাদের শিক্ষার্থী ও অধ্যাপকেরা জেগে আছেন। তাঁরা শত্রুদের মিথ্যা স্বপ্ন পূরণ করতে দেবেন না। তাঁরা জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ নানা ক্ষেত্রে শত্রুদের পরাজিত করবেন।’

চলমান এই বিক্ষোভে বিদেশি শক্তির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে দাবি করেছে ইরান সরকার। গত সপ্তাহে ৯ বিদেশি নাগরিককে গ্রেপ্তারের খবর জানায় তেহরান। তাঁদের মধ্য ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, পোল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসের নাগরিকেরা রয়েছেন। এ ঘটনার পর শুক্রবার নিজ দেশের নাগরিকদের ইরান ত্যাগের আহ্বান জানায় ফ্রান্স। নাগরিকদের একই ধরনের নির্দেশনা দেয় নেদারল্যান্ডসের সরকারও।