স্বাধীনতার পর শ্রীলঙ্কা এই প্রথম সবচেয়ে মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়ে। এই সংকটের জেরে দেশটিতে কয়েক মাস তুমুল বিক্ষোভ হয়। বিক্ষোভ সত্ত্বেও সংকটের সমাধান হয়নি। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা এখন আর সড়কে নেই। শ্রীলঙ্কার বিক্ষোভকারীরা কেন নিশ্চুপ হয়ে গেলেন, এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজ করেছেন বিবিসির স্যাম ক্যাব্রাল।
বড়দিন ও নতুন বছর উপলক্ষে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোয় সরকারি ব্যবস্থাপনায় সাজসজ্জা করা হয়েছিল। যে স্থানে এই আয়োজন করা হয়, মাস কয়েক আগে তা ছিল বিক্ষোভের অন্যতম কেন্দ্র।
স্থানীয় অনেকেই এই সাজসজ্জার বিষয়ে তীব্র হতাশা প্রকাশ করেন। তাঁরা বলেন, শ্রীলঙ্কার বর্তমান যে অবস্থা, তাতে এমন ঘটা করে উৎসব উদ্যাপনের কোনো মানে হয় না।
অর্থনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রীলঙ্কায় গত বছরের এপ্রিলে বিক্ষোভ শুরু হয়। পরে দেশটিতে রাজনৈতিক সংকটও দেখা দেয়।
এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত বিক্ষোভকারীরা দেশটির রাজপথসহ গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনা দখলে নিয়ে আন্দোলন করেন। তাঁরা দেশটির ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের পদত্যাগ দাবি করেন।
বিক্ষোভের মুখে দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে গত ১৩ জুলাই শ্রীলঙ্কা থেকে পালিয়ে যান। পরে তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন।
গোতাবায়া ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর শ্রীলঙ্কার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে। পরে তিনি পার্লামেন্টে ভোটাভুটির মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
রনিল বিক্ষোভ দমাতে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন। তাঁর নির্দেশে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী দেশটির বিভিন্ন সরকারি ভবন বিক্ষোভকারীদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করে। নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভস্থলে অভিযান চালায়। বিক্ষোভকারীদের তাঁবু ভেঙে দেয়। অনেক বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়নি। বিদ্যুৎ, খাদ্যসহ অন্যান্য সংকট বেড়েছে। এর মধ্যে কর বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে জনগণের ওপর চাপ আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে কলম্বোয় উৎসবের আয়োজনকে ‘জঘন্য’ বলে অভিহিত করেন দেশটির বাসিন্দা স্বস্তিকা অরুলিঙ্গম। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কায় একধরনের ছদ্মস্থিতিশীলতা আছে। কিন্তু দেশের মানুষের জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়েছে। তাঁরা প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রয়েছেন।
শ্রীলঙ্কার মানুষ মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে থাকলেও তাঁরা প্রতিবাদ দেখাতে পারছেন না। এ প্রসঙ্গে স্থানীয় মানবাধিকারকর্মী শ্রীন সরুর বলেন, শ্রীলঙ্কায় এখন যেকোনো ধরনের প্রতিবাদ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের হাতে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে দেশটিতে সমালোচনা রয়েছে। গত বছর বিক্ষোভকালে দেশটির প্রেসিডেন্টের ব্যাপক ক্ষমতা হ্রাস ও সংবিধান সংস্কারের দাবি জানিয়েছিলেন বিক্ষোভকারীরা। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হয়নি।
মানবাধিকারকর্মী শ্রীন সরুর বলেন, বর্তমান প্রেসিডেন্ট রনিল তাঁর ক্ষমতা ভালোভাবেই অক্ষুণ্ন রেখেছেন। ক্ষমতা অটুট রাখার জন্য যা করা দরকার, তা তিনি করে চলছেন। এমনকি যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সামরিক বাহিনী ডাকতে হয়, তা-ও তিনি করছেন।
প্রেসিডেন্ট রনিলের হাতে কতটা ক্ষমতা আছে, তা বোঝাতে শ্রীন সরুর বলেন, তিনি চাইলেই নিরাপত্তা বাহিনী তলব ও মোতায়েন করতে পারেন। সন্ত্রাস প্রতিরোধ আইনের (পিটিএ) অধীন যে কাউকে আটক বা গ্রেপ্তারের আদেশ জারি করতে পারেন।
দেশটির বিক্ষোভকারীদের অন্যতম নেতা ক্যাথলিক ধর্মযাজক ফাদার বিভান্ত পিয়েরিস। তাঁর বিরুদ্ধে পিটিএর আওতায় বিভিন্ন ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। এসব অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ বলছেন তিনি। তিনি এখন তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ব্যাপারে আদালতে লড়াই করছেন।
ফাদার বিভান্ত বলেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে রনিলকে ভোট দিয়ে পার্লামেন্ট জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তিনি ছয়বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রনিলকে আরেক ‘অপরাধী’ হিসেবে অভিহিত করেন। তাঁর ভাষ্য, রনিলও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত।
ফাদার বিভান্ত বলেন, আপাতদৃষ্টে শ্রীলঙ্কার সংকটের সমাধান হয়ে গেছে বলে মনে হয়। কিন্তু সংকটের প্রকৃত কারণগুলোর কোনো সুরাহা হয়নি। শ্রীলঙ্কায় এখনো দুর্নীতি চলছে। অপুষ্টি, ওষুধের ঘাটতির মতো মূল সমস্যা রয়েই গেছে। নিম্নবিত্ত মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপ নিতে অক্ষম।
ফাদার বিভান্তর অভিযোগ, রাষ্ট্র তাঁর মতো নাগরিকদের ভয় দেখিয়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। কিন্তু অর্থনৈতিক অবিচার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিচার না হাওয়া পর্যন্ত এই সংকটের সমাধান হবে না।