অনূঢ়া কুমার দিশানায়েকে
অনূঢ়া কুমার দিশানায়েকে

মুইজ্জুর পর অনূঢ়া দিশানায়েকে, ভারতের নতুন চ্যালেঞ্জ

প্রতিবেশীদের নিয়ে চিন্তার শেষ নেই ভারতের। মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জুর উত্থানের পর এবার নয়াদিল্লির চিন্তা শ্রীলঙ্কার বামপন্থী প্রেসিডেন্ট অনূঢ়া কুমার দিশানায়েকেকে নিয়ে।

চিন্তার প্রথম কারণ, অনূঢ়া চীনপন্থী। যদিও মুইজ্জুর মতো প্রকটভাবে চীনের প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রকাশ করেননি। দ্বিতীয় কারণ, দেশের তামিল জনসাধারণ তাঁকে সিংহলীদের কাছের নেতা হিসেবে বিবেচনা করেন। এ জন্য এবারের ভোটে তামিল–অধ্যুষিত ত্রিঙ্কোমালি, জাফনা, বাত্তিকালোয়া, ভান্নি জেলার মানুষ ঢেলে সমর্থন দিয়েছিল এসজেবি দলের প্রার্থী সাজিথ প্রেমদাসাকে। অনূঢ়া দিশানায়েকের তা জানা। তাঁর প্রতি তামিল জনগণের অনাস্থা তামিলনাড়ুর রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে।

তৃতীয় কারণ, মুইজ্জুর মতো অতটা উগ্রভাবে না হলেও এই ভোটে অনূঢ়া ভারতবিরোধী আবেগে কিছুটা উসকানি দিয়েছিলেন। এ জন্য ভারত কিছুটা সাবধানী। সাউথ ব্লকের ধারণা, সংসদ ভেঙে শিগগিরই নির্বাচনের ঘোষণা দেবেন অনূঢ়া দিশানায়েকে। নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পরই বোঝা যাবে, নতুন প্রেসিডেন্ট ভারতকে কতটা কাছে টানবেন অথবা কতটা দূরে ঠেলার চেষ্টা করবেন।

শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ অবশ্য গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল ভারত। দুই বছর আগের অর্থনৈতিক সংকট, সেই সংকট ঘিরে সামাজিক অসন্তোষ তীব্র হয়ে ওঠা, অসন্তোষের সামাল দিতে না পেরে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের দেশত্যাগ ক্রমেই জনপ্রিয় করে তুলছিল অনূঢ়া দিশানায়েকেকে। সেই জনরোষের নেতৃত্বও দিয়েছিলেন তিনি। ভারতের নীতিনির্ধারকদের চোখে তা ধরা পড়েছিল।

তখন থেকেই চীনপন্থী বাম দল জনতা বিমুক্তি পেরামুনার (জেভিপি) নেতা অনূঢ়া দিশানায়েকের সঙ্গে ভারত একটা সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়। এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে জেভিপি ও এনপিপি জোটের এক প্রতিনিধিদল ভারত সফর করে। বিজিতা হেরাথ, নিহাল আবেসিংঘে, অধ্যাপক অনিল জয়ন্তের সঙ্গে প্রতিনিধিদলে ছিলেন অনূঢ়া কুমার দিশানায়েকে। তাঁরা গুজরাটেও গিয়েছিলেন। সেই সফরে দিল্লিতে ভারতীয় নেতৃত্ব ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অনূঢ়া বৈঠকও করেন। সাউথ ব্লকের এক সূত্র এ প্রসঙ্গে বলেন, দিল্লির কাছে অনূঢ়া দিশানায়েকে তাই একেবারে অজানা নন। সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টাও গোড়া থেকে শুরু করতে হবে না।

এ কারণে নির্বাচনের পর কালক্ষেপ না করেই প্রেসিডেন্ট অনূঢ়া দিশানায়েকেকে অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ‘এক্স’ মারফত তিনি বলেন, ‘ভারতের “প্রতিবেশী প্রথম” নীতিতে শ্রীলঙ্কার এক বিশেষ অবস্থান আছে। দুই দেশ ও এই অঞ্চলের জনগণের মঙ্গলের জন্য দুই দেশের বহুমুখী সহযোগিতার বন্ধন আরও দৃঢ় করতে আপনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ শুরুর অপেক্ষায় থাকছি।’

অনূঢ়া দিশানায়েকেও কালক্ষেপ না করে ওই দিনই (২৩ সেপ্টেম্বর) ‘এক্স’ হ্যান্ডলে মোদির উদ্দেশে লেখেন, ‘আপনার মহানুভবতা ও সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ। আমাদের দুই দেশের সম্পর্ক দৃঢ় করতে আপনার সঙ্গে আমিও সহমত। দুই দেশের জনগণ ও সমগ্র অঞ্চলের মানুষের কল্যাণ সাধনে আমরা দুজন মিলে সহযোগিতার ক্ষেত্র বিস্তার করতে পারি।’

অভিনন্দন জানানো ও কালবিলম্ব না করে তার প্রত্যুত্তরকে সাউথ ব্লক ইতিবাচক বলেই মনে করছে। ভারত মনে করছে, চীনের স্বার্থ উপেক্ষা না করলেও অনূঢ়া দিশানায়েকে ভারতের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে বাস্তববাদী হয়ে উঠতে পারেন। পারস্পরিক সেই বিশ্বাসের আধার তৈরি করা গেলে সম্পর্ক আর যা-ই হোক, আড়ষ্ট হবে না।

এক কূটনীতিকের কথায়, মালদ্বীপের সঙ্গে কিছু দিন আগেও যে আড়ষ্টতা বিদ্যমান ছিল, এখন তা অনেকটাই সহজ হয়েছে। এটা কূটনৈতিক সাফল্য। আশা করা যায়, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের শুরুটা মালদ্বীপের মতো হবে না। তিনি অবশ্য বলেন, সম্পর্কের প্রকৃত গতিপ্রকৃতি বোঝা যাবে পার্লামেন্ট নির্বাচনের পর। তত দিন পর্যন্ত ভারত তার মতো করে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে যাবে।

অনূঢ়া দিশানায়েকে এখন যে জেভিপির নেতৃত্বে, অতীতের ছায়া থেকে আজ তা অনেকটাই সরে এসেছে। ১৯৭১ ও ১৯৮৭ সালে জেভিপির উগ্র জাতীয়তাবাদ দুই অসফল রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল। সেই বিপ্লবের অভিমুখ ছিল ভারত। আজকের জেভিপি সেই খোলস ত্যাগ করেছে। এখন তারা অনেক বেশি বাস্তববাদী। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের জনমুখী অবস্থান কখনো কখনো ভারতবিরোধিতায় পর্যবসিত হয়। দল ও জোটের এই অংশকে অনূঢ়া দিশানায়েকে প্রশ্রয় দিয়ে আসছেন। কাজেই জনমুখী নীতি গ্রহণের রাস্তা থেকে তিনি কতটা সরবেন, সেদিকে ভারতের দৃষ্টি থাকবে।

নির্বাচনী প্রচারের সময় অনূঢ়া দিশানায়েকে উত্তর শ্রীলঙ্কায় আদানি গোষ্ঠীর সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিলের হুমকি দিয়ে রেখেছেন। কলম্বোয় কনটেইনার বন্দর প্রকল্পও রয়েছে এই গোষ্ঠীর হাতে। ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে সেটিও। রাষ্ট্রায়ত্ত অর্থনৈতিক বিকাশের সমর্থক অনূঢ়া দিশানায়েকে এ ধরনের ব্যক্তিমালিকানার প্রকল্প বাতিল করতে উদ্যোগী হলে সম্পর্কের প্রবাহ কোন দিকে যেতে পারে, সেই চিন্তা ভারতের থাকছে। ভারত অবশ্যই দৃষ্টি রাখবে শ্রীলঙ্কায় চীন বাড়তি কতটা প্রভাব বিস্তার করে, তার ওপরও।

অনূঢ়া দিশানায়েকের উত্থান ভারতের তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে কী প্রভাব ফেলবে, তা এখনো অজানা। এআইএডিএমকে ছাড়া আর কোনো তামিল দল এখনো প্রতিক্রিয়া দেয়নি। এআইএডিএমকে অনূঢ়া দিশানায়েকেকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানালেও বলেছে, তারা চায় তিনি শ্রীলঙ্কার সংখ্যালঘু তামিল জনগোষ্ঠীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলোর দ্রুত মীমাংসা করবেন।

স্পষ্টতই, তামিলনাড়ুর রাজনৈতিক দলগুলো পরিস্থিতি বুঝতে সময় নিচ্ছে। তবে বামপন্থী অনূঢ়া দিশানায়েকেকে ভারতের দুই কমিউনিস্ট দল সিপিআই ও সিপিএম স্বাগত জানিয়েছে। সিপিএমের কাছে শ্রীলঙ্কায় কোনো বামপন্থীর প্রেসিডেন্ট হওয়া এক ‘ঐতিহাসিক মুহূর্ত’। সিপিআই মনে করে, এই জয় দক্ষিণ এশিয়ার বামপন্থী আন্দোলনকে উৎসাহিত করবে। দুই কমিউনিস্ট দলই নতুন প্রেসিডেন্টকে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়েছেন।

নেপালে পুরোনো ভারতবিদ্বেষী কে পি ওলি আবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। মালদ্বীপের ভার বর্তেছে ঘোষিত ভারতবিদ্বেষী ও চিনপন্থী মুইজ্জুর ওপর। এই দুই দেশেই ভারত সতর্ক পদচারণা করছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কীভাবে এগোবে, তা এখনো অজানা। যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম বৈঠকে বসলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। শ্রীলঙ্কায় অনূঢ়া দিশানায়েকের উত্থানও ভারতকে ফেলে দিল নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে। এই চ্যালেঞ্জ বোঝাবে ভারতের ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতি কতটা সফল আর কতটাই ব্যর্থ।