শিগগিরই সংকট কাটা নিয়ে সংশয়

বিক্ষোভকারীরা না চাইলেও ক্ষমতাসীন দল ঘোষণা দিয়েছে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তারা রনিল বিক্রমাসিংহেকেই সমর্থন দেবে।

রনিল বিক্রমাসিংহে

তুমুল বিক্ষোভের মুখে দেশ ছেড়ে পালানো শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছে পার্লামেন্ট। সেই সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে।

ইতিমধ্যে পার্লামেন্টের মহাসচিব ধামিকা দেশনায়েকে ২০ জুলাই নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করেছেন। আর এ দৌড়ে এগিয়ে আছেন রনিল বিক্রমাসিংহেই। তবে বিক্ষোভকারীরা তাঁকে মানছেন না। ফলে দেশটির রাজনৈতিক সংকট শিগগিরই কাটছে, নাকি তা আরও জোরালো হচ্ছে, সেটি এখনই স্পষ্ট নয়।

গতকাল শুক্রবার স্পিকার মাহিন্দা ইয়াপা আবেবর্ধনে এক ঘোষণায় বলেন, ‘শ্রীলঙ্কার সংবিধানের ৩৮.১(বি) ধারা অনুযায়ী আমি প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছি।’ ১৪ জুলাই ২০২২ থেকে এ পদত্যাগপত্র কার্যকর হবে। তিনি আরও বলেন, এ পরিস্থিতিতে নতুন প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দেওয়ার সাংবিধানিক প্রক্রিয়া শুরু হবে। প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্টের কার্যক্রম ও দায়িত্বগুলো পালন করবেন।

স্পিকারের এ ঘোষণার পর প্রধান বিচারপতি জয়ন্থা জয়াসুরিয়ার কাছে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন রনিল বিক্রমাসিংহে। ব্যাপক জনবিক্ষোভের মুখে গোতাবায়া রাজাপক্ষে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই কার্যত ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করে আসছেন ৭৩ বছর বয়সী রনিল।

শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে সদ্য পদত্যাগ করা প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের দল শ্রীলঙ্কা পদুজানা পেরামুনার (এসএলপিপি)। দলটির মহাসচিব সাগারা কারিয়াবাসাম জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাঁরা রনিলকেই সমর্থন দেবেন।

পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ আইনপ্রণেতার সমর্থন পেলেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া সম্ভব। সে ক্ষেত্রে রনিল বিক্রমাসিংহে এ দৌড়ে এগিয়ে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, গোতাবায়া রাজাপক্ষের বড় ভাই দেশটির দীর্ঘদিনের প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষে এবং ছোট ভাই বাসিল রাজাপক্ষেও রনিলকে সমর্থন দিচ্ছেন। যদিও পার্লামেন্টে রনিলের দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির (ইউএনপি) আসনসংখ্যা মাত্র একটি।

চলতি বছরের মে মাসে ষষ্ঠবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন রনিল বিক্রমাসিংহে, এখন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবেও নিয়োগ পেয়েছেন। যাঁরা দেশটির শীর্ষ পদ পেতে আগ্রহী, তিনিও তাঁদের মধ্যে আছেন বলে দুটি রাজনৈতিক সূত্র বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছে। এ ছাড়া এসএলপিপির একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দলটির নেতারা মনে করছেন, শ্রীলঙ্কা যে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে, রনিল (যিনি অর্থমন্ত্রীও) তা ভালোভাবে সামাল দিতে পারবেন।

যদিও বিক্ষোভকারীরা রনিলকে অপছন্দ করেন। পদত্যাগের দাবিতে প্রথমে ব্যক্তিগত বাড়িতে এবং পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও হামলা চালিয়েছিলেন বিক্ষোভকারীরা। রনিল প্রসঙ্গে বিক্ষোভকারী মানুরি পাবাসারি বিবিসিকে বলেন, ‘তাঁর (বিক্রমাসিংহে) জনসমর্থন নেই। এ ছাড়া তিনি নিজে রাজাপক্ষে পরিবারের সমর্থক। আমরা চাই যাঁরা নতুন প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট হবেন, তাঁরা রাজাপক্ষেদের সমর্থক হবেন না।’

জনসমর্থন না থাকলেও ক্ষমতাসীন রাজাপক্ষের দলের আইনপ্রণেতাদের সমর্থন পেলেই রনিল প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন। তবে তাঁকে বিক্ষোভকারীরা শেষ পর্যন্ত মেনে নেবেন কি না, সেটি দেখার বিষয়।

এমন এক পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট পদের জন্য লড়াইয়ের ঘোষণা দেওয়া আরেকজন হলেন প্রধান বিরোধী দল এসজেবির নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা। যদিও পার্লামেন্টে তাঁর দলের সদস্যসংখ্যা মাত্র ৫৪। অবশ্য বিরোধী অন্য দলগুলোর সমর্থন পাচ্ছেন তিনি।

লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসে পড়াশোনা করা সাজিথ শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসার ছেলে। ১৯৯৩ সালে এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় রানাসিংহে নিহত হওয়ার পর সাজিথ রাজনীতিতে আসেন। ২০০০ সালে তিনি পার্লামেন্টের সদস্য হন। ২০১৮ সালে গৃহনির্মাণ ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান। তাঁর দল এসজিবি চলমান আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত। জনগণের দুর্দশার বিষয়ে তাঁর বোঝাপড়া আছে বলে দাবি করেছেন এসজিবির জ্যেষ্ঠ নেতা এরান বিক্রমারত্নে।

শ্রীলঙ্কার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে থাকা তৃতীয় প্রার্থী সাবেক সাংবাদিক দুল্লাস আলাহাপেরুমা। অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত হলেও ক্ষমতাসীন এসএলপিপির জ্যেষ্ঠ এ আইনপ্রণেতা সব হিসাব–নিকাশ উল্টে দিতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। তিনি তাঁর দলের সহকর্মীদের একটি অংশের মধ্যমণি হয়ে উঠেছেন। রয়টার্সের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, পার্লামেন্টে ক্ষমতাসীন দলের ১১৭টির মতো ভোট আছে। এ ভোট তাঁর পক্ষে কাজে লাগানো গেলে তিনি জয়ী হতে পারেন বলে মনে করেন এসএলপিপির আইনপ্রণেতা চারিথা হেরাথের।

১৯৯৪ সালে পার্লামেন্টে প্রবেশ করা আলাহাপেরুমা শ্রীলঙ্কার গণমাধ্যমমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এপ্রিলে আন্দোলনকারীরা প্রেসিডেন্টের বাসভবন ঘেরাও করলে মন্ত্রিসভা বিলুপ্ত করা হয়। তখন আলাহাপেরুমা পদত্যাগ করেন।

শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন সাবেক সেনাপ্রধান ও দেশটির প্রথম ফিল্ড মার্শাল শরৎ ফনসেকা। তিনি বলেছিলেন, ‘ক্ষমতাসীন এসএলপিপির বড় একটি অংশ আমাকে প্রেসিডেন্ট পদে লড়ার অনুরোধ করেছে।’

প্রেসিডেন্ট হতে যিনিই চান না কেন, আসনসংখ্যার হিসাবে তাঁকে ক্ষমতাসীন দলের আইনপ্রণেতাদের সমর্থন পেতেই হবে। যদিও বিক্ষোভকারীরা চাইছেন শ্রীলঙ্কার রাজনীতি রাজাপক্ষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে আসুক। এ প্রসঙ্গে বিক্ষোভকারী উইমাল জয়াসুরিয়া বলেন, ‘আমরা যে পরিবর্তনের জন্য কঠোর আন্দোলন করেছিলাম, সেই পরিবর্তন রনিল বিক্রমাসিংহের হাত ধরে আসবে না।’ প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে তাঁর কার্যালয়ের উল্টো দিকে আমরণ অনশনে বসেছিলেন এই বিক্ষোভকারী। তিনি আরও বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট হিসেবে রনিলের নিয়োগ আমরা মেনে নেব না। এসএলপিপির আইনপ্রণেতাদের উচিত জনগণের পাশে দাঁড়ানো।’

সংকটময় পরিস্থিতিতে স্পিকার গতকাল ঘোষণা করেছেন, সংবিধান মেনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হবে। সেটা খুব দ্রুত সম্পন্ন হবে।

অর্থনৈতিক সংকটকে কেন্দ্র করে শ্রীলঙ্কায় রাজনৈতিক সংকটের সূচনা। রিজার্ভ–সংকট দেখা দিলে চলতি বছরের শুরুতে জ্বালানি তেল, ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর আমদানিতে টান পড়ে। এ কারণে পণ্যের দাম বেড়ে গেলে চলতি বছরের মার্চে রাস্তায় নামে জনগণ। সেই বিক্ষোভ এখনো চলছে। বিক্ষোভের জেরে গত এপ্রিলে ২৬ জন মন্ত্রী পদত্যাগ করেন। ৯ মে মাহিন্দা রাজাপক্ষে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান। কিন্তু এতেও বিক্ষোভ না থামলে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে।

মাহিন্দা ও বাসিলের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

শ্রীলঙ্কার সুপ্রিম কোর্ট গতকাল এক আদেশে বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে ও তাঁর ভাই দেশটির সাবেক অর্থমন্ত্রী বাসিল রাজাপক্ষে দেশ ছাড়তে পারবেন না। ২৮ জুলাই পর্যন্ত এ আদেশ বহাল থাকবে। তাঁদের দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে একটি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দিলেন আদালত।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার দেশত্যাগ না করার বিষয়ে আদালতে মুচলেকা দিয়েছিলেন এই দুজন। শ্রীলঙ্কার ডেইলি মিরর–এর খবরে বলা হয়েছিল, মাহিন্দা ও বাসিল তাঁদের আইনজীবীদের মাধ্যমে দেশটির সুপ্রিম কোর্টে মুচলেকা দেন। তাঁরা অঙ্গীকার করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া আবেদনের শুনানি না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা দেশ ছাড়বেন না।