বিশ্বকে বদলে দিতে পারে একটি ছবি

সত্তরের দশকের ভিয়েতনাম যুদ্ধের ‘নাপাম গার্ল’ ছবিটি বিশ্বজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। ছবির ‘বিষয়বস্তু’ ছিল নাপাম বোমার ভয়াবহতার শিকার ৯ বছরের মেয়েশিশু কিম ফুক প্যান থি। বর্তমানে তিনি ইউনেসকোর শুভেচ্ছাদূত; যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে শিশুদের সহায়তায় কাজ করছেন। ১৯৭২ সালের ৮ জুন ছবিটি তুলেছিলেন বার্তা সংস্থা এপির তৎকালীন আলোকচিত্রী নিক উত। বর্তমানে তিনি ফ্রিল্যান্সার আলোকচিত্রী, থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। ভিয়েতনাম যুদ্ধ বন্ধে ভূমিকা রাখা সেই ছবির ৫০ বছর এমন একসময় পূর্ণ হলো যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। তাইওয়ান ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে চলছে চীনের সামরিক মহড়া। আফগানিস্তান, ইরাক, ফিলিস্তিনসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চলছে সশস্ত্র সংঘাত। ভিয়েতনাম যুদ্ধের ভয়াবহতা স্মরণ করে নিক উত নিবন্ধ লিখেছেন ওয়াশিংটন পোস্ট–এ। নিবন্ধটি অনুবাদ করেছেন হাসান ইমাম

নাপাম গার্ল’ ছবির সামনে কিম ফুক প্যান থি এবং নিক উত। ২০১২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জার্মানির কোলন শহরে এক অনুষ্ঠানে
ছবি: রয়টার্স

যুদ্ধের সমাপ্তিতে কি একজন আলোকচিত্রী ভূমিকা রাখতে পারেন?

ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আলোকচিত্রীদের পাঠানো ছবিগুলো রাশিয়ার আগ্রাসনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরছে, জানা যাচ্ছে নিরপরাধ সাধারণ মানুষের চরম দুর্দশা। ৫০ বছর আগে এই আলোকচিত্রীদের মতো আমিও একই কাজ করেছি; এপির হয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধে ছবি তুলেছি।

আমার ভাই এপির আলোকচিত্রী ছিলেন, তাঁর গুরু ছিলেন মহান হর্স্ট ফাস (প্রয়াত জার্মান আলোকচিত্রী)। আমার আলোকচিত্রী হওয়ার পেছনে প্রেরণা জুগিয়েছেন আমার ভাই। তিনি আমাকে শিখিয়েছিলেন কীভাবে ক্যামেরা চালাতে হয়। একটি যুদ্ধক্ষেত্র কাভার করতে গিয়ে মারা যাওয়ার আগে তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি আশা করি, তুমি একদিন এমন একটি ছবি তুলবে, যা যুদ্ধ থামিয়ে দেবে।’

সামাজিক ন্যায়বিচারের পক্ষে আলোকচিত্র ভূমিকা রাখতে পারে—আমার ভাইয়ের মতো আমিও তা বিশ্বাস করতাম।

নিক উত

দুই.

১৯৭২ সালের ৭ জুন। আমি জানতে পারি ত্রাং ব্যাং নামের একটি ছোট্ট গ্রামে লড়াই চলছে। গ্রামটি উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলীয় সাইগন থেকে প্রায় ৩০ মাইল দূরে অবস্থিত। পরদিন সকালে ত্রাং ব্যাংয়ের উদ্দেশে যাত্রার কথা এখনো স্পষ্ট মনে আছে।

সূর্য তখন মাথার ওপরে। মনে হলো, আমার যেমনটা দরকার ছিল সকাল থেকে তেমন ছবি তুলতে পেরেছি। আমি ফেরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ দক্ষিণ ভিয়েতনামের সেনারা একটি ইয়োলো স্মোক বোমা ফেলল কাছের একটি এলাকায়। এর কয়েক সেকেন্ড পর আরেকটি গ্রামের ওপর বিমান থেকে চারটি বোমা ফেলা হলো। সেই ছবি তুললাম।

আমরা কাছাকাছি যেতেই দেখতে পেলাম লোকজন দৌড়ে পালাচ্ছে। দেখলাম, একজন নারীর বাঁ পা খুব খারাপভাবে পুড়ে গেছে। সেই অবস্থায় তিনি পালাচ্ছেন। স্পষ্ট মনে আছে, একজন বয়স্ক নারী কোলে করে একটি শিশুকে নিয়ে যাচ্ছিলেন, শিশুটি আমার সামনেই পড়ে মারা যায়। আরেক নারীর ছুটছিলেন শিশু কোলে নিয়ে; শিশুটির শরীর থেকে চামড়া উঠে আসছিল।

এমন সময় একটি শিশুর চিৎকার শুনতে পাই, ‘নং কুয়া! নং কুয়া!’ (কী ভয়ংকর জ্বলুনি! কী ভয়ংকর জ্বলুনি!) আমি আমার ক্যামেরা ভিউফাইন্ডার দিয়ে দেখতে পেলাম, একটি মেয়ে তার শরীরে জ্বলতে থাকা জামাকাপড় খুলে ফেলছে এবং আমার দিকেই দৌড়ে আসছে। আমি তার ছবি তুলতে শুরু করলাম।

কিছুক্ষণ পর মেয়েটি তার ভাইয়ের কাছকাছি চলে আসে এবং খাওয়ার জন্য পানি চায়। আমি তৎক্ষণাৎ আমার ক্যামেরা নামিয়ে রাখলাম, যাতে করে তাকে কিছুটা সাহায্য করা যায়। আমি জানতাম, ছবি তোলার চেয়ে তখন তাকে সেবা দেওয়া অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

সেই হতবিহ্বল অবস্থায় সবার চিৎকার–চেঁচামেচির মধ্যেই সেখানকার সব শিশুকে আমি এপির গাড়িতে তুলে নিলাম। তাদের কু চি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল, মেয়েটি আমার গাড়িতেই মারা যাবে। হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারলাম, তার নাম কিম ফুক প্যান থি। তার শরীরের ৩০ শতাংশ পুড়ে গেছে।

যখন পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হয়, কু চি থেকে সাইগনের শিশু হাসপাতালে পাঠানো হয় কিম ফুককে। কিন্তু তার আঘাত শুধু শারীরিক ছিল না, দগ্ধ হওয়ার যন্ত্রণায় শুধু কাতর ছিল না। সে তার দুটি ভাতিজাকে হারিয়েছিল এবং তার ভাই মারাত্মকভাবে জখম হয়েছিল।

বার্ন ইউনিটে এক বছর কাটানোর পর কিম ফুককে বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো। সেদিনই আমি তাকে দেখতে গেলাম।

তিন.

১৯৭৫ সালে সাইগনের পতনের পর কিম ফুককে আমি আর দেখিনি। এরপর ১৯৮৯ সালে তার সঙ্গে দেখা হয় কিউবায়। একটা অ্যাসাইনমেন্টে আমি সেখানে গিয়েছিলাম আর সে গিয়েছিল স্প্যানিস ও ফার্মাকোলজি পড়ার সুবাদে। সে তার বাগদত্তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল, তার নাম তোয়ান। তোয়ানের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগপর্যন্ত কিম ফুক ভাবত, কেউ তাকে কোনো দিন ভালোবাসবে না এবং কেউ তাকে বিয়ে করতে চাইবে না। কেননা, তার সারা শরীরে পোড়ার স্থায়ী দাগ।

এখন তাদের দুটি সন্তান। থাকে টরন্টোয়। কিম ফুক ইউনেসকোর একজন চমৎকার দূত। তার বাড়িতে যুদ্ধের ওপর অনেক বই আছে, কিন্তু সে কোনো যুদ্ধেরই কোনো ছবি দেখে না। সেই দুঃস্বপ্ন মনে করতে চায় না সে। কিন্তু আমি তার যন্ত্রণা দেখতে পাই এবং ৫০ বছর আগে সে যা সহ্য করেছে, তা–ও যেন দেখতে পাই।

যদিও কিম ফুক শুরুতে ছবিটিকে (নাপাম গার্ল) অপছন্দ করত, কিন্তু এখন সে এটা মানে যে এটি তাকে জীবনের সামনে সুযোগও এনে দিয়েছে।

কিম ফুক ও আমি—আমরা দুজনই ইতিহাসে পরস্পরযুক্ত।

যুদ্ধে ভয়াবহতা দেখা মানুষের মধ্যে আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। যুদ্ধে মৃত্যু ও ধ্বংসের মধ্যেও মানবিকার দ্যুতি ছড়ায়—প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ইউক্রেনীয়রা একে অন্যকে সাহায্য করছে—এমন ছবি দেখলেই আমার এই কথাটই মনে আসে।

অন্তরের অন্তস্তল থেকে বিশ্বাস করি, যখন কোনো নিষ্পাপ ইউক্রেনীয় বালিকার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন রুশ সেনারা, তারাও আমার মতো একইভাবে আবেগাক্রান্ত হবেন, অস্ত্র সরিয়ে রেখে তারা মানবতার সেবায় নিয়োজিত হবেন।

আমার ছবিটিকে ঘিরে বিশ্বজুড়ে যত আলাপ–আলোচনা ও আবেগ, তাতে আমি শ্লাঘা বোধ করি। সত্যের সচল থাকার প্রয়োজন আছে। যদি একটিমাত্র ছবিও আলাদা হয়ে ওঠে, যুদ্ধের সমাপ্তিতে তা ভূমিকা রাখতে পারে। (সংক্ষেপিত)

নিবন্ধটি ওয়াশিংটন পোস্ট–এ গত ২ জুন প্রকাশিত