জুনিয়াস রিচার্ড জয়াবর্ধনে শ্রীলঙ্কার দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট ও সপ্তম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। গত শতকের সত্তর ও আশির দশকে টানা ১২ বছর দ্বীপরাষ্ট্রটি শাসন করেন তিনি। অসম্ভব ধূর্ত একজন রাজনীতিক হিসেবে তাঁর পরিচিতি রয়েছে। অনেকেই তাঁকে ‘ধূর্ত শিয়াল’ বলে ডাকতেন। ব্যক্তিগত পরিচয়ে তিনি শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহের চাচা। আজ বুধবার রনিল সংকটে থাকা দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। অনেকের মতে, চাচার চেয়েও ‘ধূর্ত’ রনিল।
তুমুল গণ-আন্দোলনের মুখে পালিয়ে যাওয়া গোতাবায়া রাজাপক্ষের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন রনিল। এর আগে তিনি ছয়বার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন। সর্বশেষ গত মে মাসে অর্থনৈতিক সংকট ও বিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষের পদত্যাগের পর ওই পদে রনিলকে বসান গোতাবায়া। পরে গোতাবায়ার দেশ ছেড়ে পালানোর পর ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করলেও আজ প্রথমবারের মতো শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন রনিল।
শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপ্রধানের পদে যেতে রনিলের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল। ১৯৯৯ ও ২০০৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়েও সফল হতে পারেননি পশ্চিমাপন্থী এই নেতা। গতকালের নির্বাচনে গোতাবায়ার রাজনৈতিক দল শ্রীলঙ্কা পদুজানা পেরামুনার (এসএলপিপি) পূর্ণ সমর্থন পাওয়ায় রনিলের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।
রনিল একদিন দেশের প্রেসিডেন্ট হবেন, এমন প্রত্যাশা ছিল তাঁর চাচা জুনিয়াসের। ১৯৯৬ সালে মারা যাওয়ার আগে জুনিয়াস পরিবারের সদস্যদের কাছে এই প্রত্যাশার কথা জানিয়েছিলেন। তাঁর হাত ধরেই রাজনীতিতে আসা রনিলের। এখন রনিলকে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের চাপ সামলাতে হবে। এর আগে তাঁর প্রতি বিক্ষোভকারীদের বিশ্বাস অর্জনের চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হবে।
বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, দেশ চালানোর বিস্তর অভিজ্ঞতা রয়েছে রনিলের। তবে সামনের পথটা খুব একটা মসৃণ হবে না তাঁর জন্য। কেননা দেশটিতে জনগণের ক্ষোভের মুখে পতন ঘটেছে প্রভাবশালী রাজাপক্ষে পরিবারের। রনিল বিক্ষোভকারীদের কাছে রাজাপক্ষে পরিবারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। এমনকি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গোতাবায়ার দলের সমর্থনে জয় পেয়েছেন তিনি। তাই দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন চাওয়া বিক্ষোভকারীরা তাঁকে আস্থাভাজন না-ও ভাবতে পারেন। এটাই রনিলের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
রনিলের জন্ম ধনী রাজনৈতিক পরিবারে। শুরুতে তিনি সাংবাদিকতা করেছেন। গত শতকের সত্তরের দশকে শ্রীলঙ্কার সাবেক ও বিশ্বের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে রনিলের পারিবারিক ব্যবসা জাতীয়করণ করলে তিনি আইন পেশা শুরু করেন। পরে রাজনীতিতে আসেন। এক সাক্ষাৎকারে রনিল বলেন, ‘আমি সাংবাদিকতাই করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বন্দরনায়েক আমাকে রাজনীতিতে টেনে আনেন।’
রাজনীতিতে আসার দুই দশকের কম সময়ে রনিল শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৯৩ সালে প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসা আত্মঘাতী হামলায় নিহত হওয়ার পর টালমাটাল পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন রনিল। ১৯৯৯ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার লড়াইয়ে নামেন রনিল। নির্বাচনের তিন দিন আগে আত্মঘাতী হামলায় মারাত্মক আহত হন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা। এতে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি চন্দ্রিকার পক্ষে যায়। এর ফলে প্রেসিডেন্ট হওয়া স্বপ্ন অধরা রয়ে যায় রনিলের।
শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক ব্যবস্থা দুর্নীতিতে ভরপুর হলেও রনিলের ভাবমূর্তি বেশ পরিচ্ছন্ন। এ জন্য দেশটিতে চলমান অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সংকট থেকে মুক্তির জন্য তাঁর প্রতি ভরসা করেছেন সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া। তবে ২০১৫-১৯ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বন্ড কেলেঙ্কারিতে রনিলের নাম এসেছিল। তিনিই এখন ৫ হাজার ১০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক ঋণের দায়ে জর্জরিত দেশটিকে টেনে তোলার দায়িত্ব পেয়েছেন।
পশ্চিমাপন্থী, মুক্ত বাজার সংস্কারবাদী রনিল ইতিমধ্যে দেউলিয়া হয়ে পড়া দেশটির অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে আলোচনা আরও সাবলীলভাবে এগিয়ে নিতে পারবেন ও একইসঙ্গে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারবেন বলে আশা করা হচ্ছে। তা না হলে জনগণের সামনে নতুন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে পারেন রনিল।