মিয়ানমারজুড়ে প্রতিরোধ দমন করতে ব্যর্থ হওয়ার পর সামরিক সরকারের প্রধান মিন অং হ্লাইং ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা ধরে রাখতে চান তিনি। এর মধ্যে জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী ও সামরিক কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করাসহ ব্যবসায়িক বন্ধুদের প্রতিষ্ঠা করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে তাঁকে। ক্ষমতা পোক্ত করতে ইতিমধ্যে নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধানের মতো কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করেছেন মিন অং হ্লাইং।
আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মিন অং হ্লাইংয়ের জান্তা প্রশাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেও অবস্থানকে সুসংহত করার চেষ্টা করছেন হ্লাইং। এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে দেশটির অর্থনৈতিক সংকট ও সীমান্ত এলাকায় জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিদ্রোহ। তবুও টলানো যায়নি হ্লাইংকে। টিকে থাকতে চারপাশের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের ক্ষমতা কমিয়ে আনছেন।
গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল করেন হ্লাইং। এরপর থেকে দেশটির অর্থনীতি ২০ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, এ বছর আরও ৩ শতাংশ অর্থনীতি হ্রাস পাবে। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে দেশটির অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য এ ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে।
ইয়াঙ্গুনে একজন পশ্চিমা কূটনীতিক আল জাজিরাকে বলেন, জান্তাপ্রধান নিজের পক্ষের লোকজনকে বরখাস্ত করে ব্যবসায়িক বন্ধুদের প্রতিষ্ঠিত করছেন। এ থেকে তাঁর নাজুক অবস্থান ও অনিরাপদ নেতৃত্বের বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাঁর প্রধান অগ্রাধিকার এখন যেকোনো মূল্যে টিকে থাকা। এর ওপর দেশটির অর্থনীতি বিপর্যস্ত। এ পরিস্থিতির মূল্য বহন করতে হচ্ছে জনগণকে।
গত ২৫ জুলাই মিয়ানমারের জান্তা সরকার চার বিক্ষোভকারীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। এ ঘটনা সারা বিশ্বে সমালোচনার জন্ম দেয়। মিয়ানমারের সাবেক ডাচ রাষ্টদূত লেতিতা ভ্যান ডেন আসুম বলেন, মৃত্যুদন্ড প্রমাণ করে যে সামরিক সরকারের শর্তে না মিললে দেশটির ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো সংলাপ প্রত্যাখ্যান করছে জান্তা সরকার। তবে অভ্যুত্থান করে যা অর্জন করতে চেয়েছিল, সে প্রচেষ্টা অনেক আগেই ব্যর্থ হয়েছে। তাঁদের অন্ধবিশ্বাস যে চার রাজনৈতিক বন্দীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। যদিও জান্তার পদক্ষেপ ব্যাপকভাবে প্রতিরোধ আন্দোলনকে শক্তিশালী করছে।
নীতি বিশ্লেষক ম্যাথিউ আর্নল্ড মনে করেন, মিন অং হ্লাইংকে এই বার্তা পাঠাচ্ছেন যে তিনি আরও সহিংসতার পথ বেছে নিতে প্রস্তুত। তিনি বলেন, কাঠামো, প্রোটোকল, সংবিধান–নির্বিশেষে মিন অং হ্লাইং কেবল অনুগতদের নিতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করছেন।
আর্নল্ড বলেন, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে জনসাধারণকে ভয় দেখানোর পাশাপাশি মিন অং হ্লাইংকে নিজের লোকজনের কাছে বিশেষ করে কট্টরপন্থীদের কাছে ক্ষমতা প্রদর্শন করেছেন।
জান্তার চরম সহিংসতা, নীতিগত ব্যর্থতা এবং বিশৃঙ্খলা শুধু প্রতিবাদকারীদেরই নয়, পর্যবেক্ষক এবং রক্ষণশীল ব্যবসায়ীদেরও হতবাক ও হতাশ করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জান্তার বর্তমান অবস্থা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকে দুর্বল করেছে। এ ছাড়া সামরিক শাসনের ক্ষেত্রে জেনারেলের ওপর ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার বিষয়টিও সামনে এসেছে।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, মিয়ানমারের শাসনব্যবস্থা তিনটি সত্তার মধ্যে বিভক্ত করা হয়েছে। একটি হচ্ছে স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিল (এসএসি) বা দেশটির শাসনকার্যে নিয়োজিত শীর্ষ কর্মকর্তাদের সত্তা, আরেকটি হচ্ছে জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের সত্তা ও সর্বশেষ মন্ত্রিসভা। তবে এসব সত্তা ছাপিয়ে মিন অং হ্লাইং ক্রমশ প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন। সশস্ত্র বাহিনী প্রধান এবং অভ্যুত্থানকারী নেতা হিসেবে অভ্যুত্থানের পর থেকে স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিলের পাশাপাশি অন্য ক্ষেত্রগুলোতে তিনি ক্ষমতা ধরে রেখেছেন। তাঁর কথাতেই নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল টিন অং সান, বিমানবাহিনীর প্রধান জেনারেল মং মং কিয়াও, বিচারক অ্যাডভোকেট জেনারেল লেফটেন্যান্ট জেনারেল অং লিন ডুয়ে এবং জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের কমান্ডার জেনারেল মায়া তুন উকে তাঁদের সামরিক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশিষ্ট বিশ্লেষক হেইট মাইন মিন তুন বলেন, এসব কর্মকর্তার সরে যাওয়ার কারণ অবসর বা দায়িত্বসম্পন্ন হওয়ার কথা বলা হয়েছে; কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এর কারণ হচ্ছে, হ্লাইং তাঁর পদ আরও সুসংহত করতে চান।
সিঙ্গাপুরভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক আইএসইএএস-ইউসুফ ইশাক ইনস্টিটিউটের গবেষণা ফেলো থুজার বলেন, গত বছরের আগস্টে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের সময়ও শাসকের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছেন হ্লাইং। এ ছাড়া গত কয়েক মাসে বিভিন্ন মন্ত্রীকে বরখাস্ত করে নিজের কাছের লোকজনকে নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। এগুলো তাঁর ক্ষমতা পোক্ত করার অভিপ্রায় বলেই প্রমাণ হয়।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, মিয়ানমারে জাতিসংঘের নবনিযুক্ত বিশেষ দূত নোয়েলিন হেইজার গত মঙ্গলবার দেশটিতে সফর শুরু করেছেন। দুর্নীতির দায়ে মিয়ানমারের ক্ষমতাচ্যুত নেত্রী অং সান সু চিকে জান্তার আদালতে আরও ছয় বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার এক দিনের মাথায় তাঁর এ সফর শুরু হয়েছে। হেইজার নেপিদো পৌঁছানোর পর মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তাঁকে স্বাগত জানান। তিনি সেখানে মিন অং হ্লাইংসহ সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। জাতিসংঘ প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, ক্রমাগত অবনতির দিকে থাকা পরিস্থিতি মোকাবিলা, অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়াসহ তাঁর কাজের বিভিন্ন অগ্রাধিকারের বিষয়গুলোকে আলোচনায় জোর দেবেন হেইজার। বুধবার বৈঠকের বিষয়ে হেইজার বলেন, ‘আশা করি বৈঠকে ভালো কিছু হবে।’
এদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর আঞ্চলিক জোট আসিয়ানের পরবর্তী সম্মেলনে মিয়ানমারের সামরিক নেতৃত্বকে না রাখার সমালোচনা করেছে নেপিদো। তারা বলছে, বাহ্যিক চাপের কারণেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে আসিয়ান।
আল–জাজিরা, এএফপি ও রয়টার্স অবলম্বনে মো. মিন্টু হোসেন