ভূমধ্যসাগরে গ্রিস উপকূলের কাছে গত জুনে একটি মাছ ধরার ট্রলার ডুবে যায়। লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইতালি যাচ্ছিল সেটি। ট্রলারটিতে কয়েক শ অভিবাসনপ্রত্যাশী ছিলেন। সেটি ডুবে নিখোঁজ হন প্রায় ৫০০ অভিবাসী। ভাগ্যের জোরে যাঁরা বেঁচে গিয়েছিলেন, তাঁদের একজন উসমান সিদ্দিকী (২৭)।
উসমানের বাড়ি পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের গুজরাট শহরে। পরিবারে রয়েছেন মা–বাবা ও স্ত্রী–সন্তান। তিনি পুলিশ কনস্টেবল ছিলেন। এ থেকে আয়ে সংসার চলছিল না। তাই ভাগ্য ফেরাতে লিবিয়ায় পাড়ি জমান। সেখান থেকে যাওয়ার কথা ছিল ইতালি। পথিমধ্যে ভূমধ্যসাগরে কীভাবে তিনি মৃত্যুর কবল থেকে ফিরেছিলেন, তা শুনিয়েছেন ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে।
উসমান বলেন, ‘ট্রলারটি ডুবে যাওয়ার পাঁচ–ছয় ঘণ্টা পর আমাদের উদ্ধার করা হয়। আমার অবস্থা তখন শোচনীয়। শরীরে কোনো কাপড়চোপড় ছিল না। নিজেকে বাঁচাতে কেউ হয়তো আমার প্যান্ট টেনে ধরেছিলেন। আমি তখন ট্রলার থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছিলাম। শেষ পর্যন্ত কোনো উপায় না দেখে প্যান্টটা খুলে ফেলি।’
ওই ট্রলারে উসমানের পাশে ছিলেন তাঁরই এক বন্ধু। উসমান বলেন, ‘আমার মনে হয় ডুবে যাওয়ার সময় সে ট্রলার থেকে বের হতে পারেনি। তবে আমি বের হওয়ার পথটা চিনতাম। আমার মাথাও ঠিকঠাক কাজ করেছিল। এতে আমি প্রাণে বেঁচে যাই। বলা চলে, আমি ভাগ্যবান ছিলাম।’
ট্রলারটি থেকে বের হওয়ার পর পানিতে একটি লাইফ জ্যাকেট ভাসতে দেখেন উসমান। তিনি সেটি নিজের কাছে নিয়ে আসেন। দেখতে পান লাইফ জ্যাকেটটির ভেতরে একটি শিশুর মরদেহ। উসমান জানান, এরপর তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়েন, আর মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। সে সময় নিজেদের নৌযান থেকে কোস্টগার্ড তাঁদের পানিতে ভাসতে দেখেছিল, কিন্তু এগিয়ে আসেনি।
তবুও বাঁচার আশায় কোস্টগার্ডের নৌযানটির দিকে সাঁতরে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন উসমান। কিন্তু বড় বড় ঢেউয়ের আঘাতে দূরে সরে যাচ্ছিলেন। এমন সময় একটি কাঠ পান তিনি। সেটি ধরেই ভাসতে থাকেন।
একসময় সন্ধ্যা হয়ে আসে। দুটি স্পিডবোট এসে উদ্ধার করে উসমানকে। এর কয়েক ঘণ্টা বাদে তাঁকে একটি সাদা রঙের বড় জাহাজে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রিসে পৌঁছাতে সেটির আট ঘণ্টা সময় লাগে। সেখানে দুই দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন উসমান। এরপর তাঁকে জাতিসংঘের অভিবাসনবিষয়ক সংস্থা আইওএমের সহায়তায় পাকিস্তানে ফিরিয়ে আনা হয়।
ট্রলারটি থেকে বের হওয়ার পর পানিতে একটি লাইফ জ্যাকেট ভাসতে দেখেন উসমান। তিনি সেটি নিজের কাছে নিয়ে আসেন। দেখতে পান, লাইফ জ্যাকেটটির ভেতরে একটি শিশুর মরদেহ।
বেঁচে থাকাটা উসমানের কাছে অতি আশ্চর্যের বিষয় বলে মনে হয়। তিনি বলেন, ‘আমি বেঁচে আছি, এটা একটা অলৌকিক ঘটনা। আশা একদম ছেড়ে দিয়েছিলাম। যাত্রাপথে ছয় দিন কিছু খেতে পাইনি। ট্রলারে ওঠার আগে কিছু খাবার কিনেছিলাম। কিন্তু ওজন বেড়ে যাবে বলে তা নিতে দেয়নি ট্রলারের লোকজন। এক সেট পোশাক ছাড়া সঙ্গে কিছুই ছিল না।’
অথচ ট্রলারে খাবার ও লাইফ জ্যাকেটের জন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে ট্রলারের লোকজন ১০০ ডলার (১০ হাজার টাকার বেশি) নিয়েছিলেন বলে জানান উসমান। ওই অর্থ নেওয়ার পরও কিছুই খেতে দেওয়া হয়নি তাঁদের। ট্রলারের ওপরতলায় যাঁরা ছিলেন, তাঁদের সামান্য খাবার ও পানি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু উসমানসহ যাঁরা নিচতলায় ছিলেন, তাঁদের কপালে কিছুই জোটেনি।
পরিবারের ভালোর জন্যই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন উসমান। তিনি দেখেছিলেন, তাঁর শহরের অনেকে ইউরোপে যাচ্ছে। পরিবারের জন্য অর্থ পাঠাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমি সন্তানকে সুশিক্ষা দিতে চেয়েছিলাম। মা-বাবাকে সাহায্য করারও ইচ্ছা ছিল। আমাদের বাড়িটি খুবই ছোট। কেউ বেড়াতে এলে এক রাত থাকতে দেওয়ার মতো জায়গাও নেই। তাই মনস্থির করেছিলাম ইতালি যেতে পারলে পরিবারের ভাগ্য বদলাতে পারব। সন্তানকে পড়ালেখা করিয়ে কর্মকর্তা বানাব।’
উসমান বলেন, ‘আমার বাবার বয়স বাড়ছে। ব্যথাসহ নানা জটিলতা নিয়ে তিনি এখনো কাজ করছেন। আমি চাই বাবা এখন বিশ্রাম নিক। তিনি আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছেন। আমি মনে করি, এখন তাঁর জন্য কিছু করা আমার দায়িত্ব।’
অভিবাসনের আশায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে নৌকাডুবি আর প্রাণহানির ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। উসমানের ক্ষেত্রেও তা ঘটল। তবে এসব মর্মান্তিক ঘটনা জেনেও মানুষ ঝুঁকি নেওয়া কমাবে বলে মনে করেন না উসমান। তিনি বলেন, ‘কয়েক দিন আগে লিবিয়া থেকে পরিচিত কয়েকজন আমাকে জানিয়েছে, গ্রিসে ট্রলারডুবির পর দালালেরা আপাতত লোক পাঠানো বন্ধ রেখেছে। কিন্তু বেশি দিন এটা বন্ধ থাকবে না। বড়জোর এক সপ্তাহ। এরপর আবারও একই কাজ শুরু করবে তারা।’
সাগর পথে ইতালিতে যাওয়ার জন্য অন্তত ২০ হাজার পাকিস্তানি লিবিয়ায় অবস্থান করছেন বলে জানান উসমান। তিনি বলেন, ‘আমার ছয় বন্ধু এরই মধ্যে ইউরোপে পৌঁছে গেছে। আমি দুই মাস লিবিয়ায় ছিলাম। ওই দুই মাসে লিবিয়া থেকে ছেড়ে যাওয়া ১১টি জাহাজ ইতালি পৌঁছেছে।’
প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মেহেদি হাসান।