মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বাহিনী ও জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংঘাতে জর্জরিত এবং রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের আবাসস্থল রাখাইন রাজ্যে শিগগিরই চরম দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)।
গতকাল বৃহস্পতিবার ইউএনডিপির প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি মারাত্মক পরিস্থিতি তৈরি হতে যাচ্ছে, যা পশ্চিম রাখাইনকে ‘অভূতপূর্ব বিপর্যয়ের কিনারায়’ ঠেলে দিতে পারে।
মিয়ানমার ও প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে পণ্য প্রবাহে সীমাবদ্ধতা, বাসিন্দাদের আয়রোজগারের অভাব, মুদ্রাস্ফীতির উচ্চ হার, খাদ্য উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য হ্রাস এবং প্রয়োজনীয় সেবা ও সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার অভাবের মতো একাধিক পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত সমস্যার কথা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
ইউএনডিপি জানিয়েছে, অত্যন্ত বিপন্ন এই জনগোষ্ঠী সামনের মাসগুলোতে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে পারে।
বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমার বহুদিন ধরেই রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যালঘুদের বাংলাদেশ থেকে আসা ‘বাঙালি’ হিসেবে দেখে আসছে। যদিও তাদের পরিবার বহু প্রজন্ম ধরে দেশটিতে বসবাস করছে। ১৯৮২ সাল থেকে প্রায় সবাইকে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ-এপ্রিল নাগাদ রাখাইনের অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন সেখানকার চাহিদার মাত্র ২০ শতাংশ পূরণ করতে পারবে।
২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের একটি গোষ্ঠীর হামলার পর সেনাবাহিনী নির্মম অভিযান শুরু করে। এতে প্রায় ৭ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক ধর্ষণ, হত্যাযজ্ঞ ও হাজার হাজার ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
২০২১ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করে। এর পর থেকে গণতন্ত্রপন্থী গেরিলা ও বিভিন্ন জাতিগত সংখ্যালঘু সশস্ত্র গোষ্ঠী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
গত নভেম্বরে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকার থেকে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আরাকান আর্মি (এএ) রাখাইনে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে এবং রাজ্যের অর্ধেকের বেশি শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। রাখাইন জাতিগত সংখ্যালঘু আন্দোলনের সশস্ত্র বাহিনী হিসেবে পরিচিত এই আরাকান আর্মি সামরিক বাহিনীকে উৎখাতের চেষ্টা চালানো সশস্ত্র জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর জোটেরও সদস্য।
ইউএনডিপি সতর্ক করে বলেছে, জরুরি ব্যবস্থা না নিলে ৯৫ শতাংশ জনগণ বেঁচে থাকার সংগ্রামে পিছিয়ে পড়বে। তারা দেশীয় উৎপাদনে ব্যাপক হ্রাস, চরম মূল্যবৃদ্ধি, ব্যাপক বেকারত্ব এবং ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে নিজেদের মতো করে টিকে থাকতে বাধ্য হবে।’
ইউএনডিপি তাদের ২০২৩ ও ২০২৪ সালের সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে জানায়, রাখাইনের অর্থনীতি কার্যত অচল হয়ে গেছে। সেখানে বাণিজ্য, কৃষি ও নির্মাণের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো প্রায় স্থবির অবস্থায় রয়েছে।
ইউএনডিপি জানায়, অবরোধের কারণে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য রপ্তানি বন্ধ থাকায় মানুষের আয় কমে গেছে এবং একই কারণে কৃষি খাতে কর্মসংস্থান কমে যাচ্ছে।
এ ছাড়া সিমেন্ট আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ‘ব্যাপক দাম বেড়েছে’ এবং চাকরির প্রধান কর্মস্থল হিসেবে পরিচিত নির্মাণশিল্পও অচল হয়ে পড়েছে।
‘রাখাইন: এক দুর্ভিক্ষের সূত্রপাত’ শিরোনামের এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘রাখাইন শিগগিরই চরম দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হতে পারে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ-এপ্রিল নাগাদ রাখাইনের অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন সেখানকার চাহিদার মাত্র ২০ শতাংশ পূরণ করতে পারবে।
জাতিসংঘ বলছে, বীজ ও সারের সংকট, বৈরী আবহাওয়া ও চাষাবাদের অভাবে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং চলমান সংঘাতের কারণে চাল উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে গেছে। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য প্রায় সম্পূর্ণই স্থবির হয়ে পড়া ২০ লাখের বেশি মানুষকে অনাহারের ঝুঁকিতে ফেলবে।
রাখাইনে পণ্য ও মানবিক সহায়তা প্রবেশে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ, ত্রাণের কর্মীদের অবাধ প্রবেশাধিকার, তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং কৃষি খাত পুনরুদ্ধারে জরুরি অর্থায়নের আহ্বান জানিয়েছে ইউএনডিপি।
ইউএনডিপি সতর্ক করে বলেছে, জরুরি ব্যবস্থা না নিলে ৯৫ শতাংশ জনগণ বেঁচে থাকার সংগ্রামে পিছিয়ে পড়বে। তারা দেশীয় উৎপাদনে ব্যাপক হ্রাস, চরম মূল্যবৃদ্ধি, ব্যাপক বেকারত্ব এবং ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে নিজেদের মতো করে টিকে থাকতে বাধ্য হবে।
সংস্থাটি আরও বলেছে, বাণিজ্য রুট বন্ধ ও ত্রাণ কার্যক্রমে কঠোর নিষেধাজ্ঞার কারণে রাখাইন গভীর মানবিক সংকটাপন্ন সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।